উপেক্ষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার

ছেঁড়াফাটা টাকা নিয়ে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা দিশাহারা

প্রকাশ : ১২ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

বাংলাদেশ ব্যাংক এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছিল দেশের সব ছেঁড়া-ফাটা টাকা আগুনে পোড়া অর্থাৎ সাধারণে অচল টাকা ফেরৎ নিয়ে তা বদলে দেওয়া হবে। এই ঘোষণা শুনে অনেকেই আশায় বুক বেঁধেছিলেন। তারা তাদের অচল নোটগুলো জমাও দিয়েছেন। কিন্তু দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও সেই কাঙ্ক্ষিত বদল নোট এখনো মেলেনি। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে একাধিকবার ফোন করে টাকা নিয়ে যাবার কথা বলা হলেও কার্যত সেটি এখন সাপলুডু খেলায় দাঁড়িয়েছে। এমনি অভিযোগ করলেন ছেঁড়া টাকা জমা দেওয়া এক ব্যবসায়ী। তারা গত ২ বছর ধরে ব্যাংকের এই খামখেয়ালির শিকার। এদিকে ব্যাংকের মুলো ধরিয়ে রাখা ঘোষণায় বিপাকে পড়েছেন ছেঁড়া-ফাটা নোট বিনিময়ে যুক্ত ৫০০ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। তারা বাজারে প্রচলিত ময়লাযুক্ত ছেঁড়া-ফাটা, আগুনে ঝলসানো, ড্যাম্প, মরিচাযুক্ত, অধিক কালিযুক্ত, অধিক লেখালেখি, স্বাক্ষরযুক্ত, বিভিন্ন খণ্ডে খণ্ডিত টাকা জমা দিয়েও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পরিচ্ছন্ন টাকা আনতে পারছেন না। এ নিয়ে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের দুর্দিন তাদের পিছু হটছে না। এদিকে ১ থেকে দেড় কোটি টাকা রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক তথা সরকার।

ছেঁড়া-ফাটার সঙ্গে যুক্ত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা জানান, দীর্ঘদিন ধরে সারা দেশের বিভিন্ন গ্রাম, হাট-বাজার থেকে ছিঁড়া টাকা সংগ্রহ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী পরিবর্তন করে আসছিল। বর্তমানে তারা ছেঁড়া-ফাটা টাকা পরিবর্তন করতে পারছে না। এ বিষয়ে গত ২২ জুন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বরাবরে একটি অভিযোগ দায়ের করেন ছেঁড়া-ফাটা টাকা বিনিময় ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. নিজাম উদ্দিন ও সাধারণ সম্পাদক মো. আবুল হোসেন।

অভিযোগে তারা বলেছেন, দীর্ঘদিন যাবৎ সারা দেশের বিভিন্ন গ্রাম, হাট-বাজার থেকে ছিঁড়া টাকা সংগ্রহ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী অন্য ব্যাংকে ভালো ছিঁড়া, সামান্য খাওয়া নোট পরিবর্তন করে আসছিল ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। কিন্তু পোকা খাওয়া, ইঁদুরে খাওয়া ড্যাম টাকা অন্য ব্যাংকে জমা দেওয়া যায় না। পোকা খাওয়া, ইঁদুরের খাওয়া ও ড্যাম টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দিতে হয়। কিন্তু কোনো আইনি নিষেধাজ্ঞা ছাড়াই বেশ কিছু দিন যাবৎ তাদের ছেঁড়্া-ফাটা ব্যবসায়ীর কোনো লোককে বাংলাদেশ ব্যাংকের অভ্যন্তরে ঢুকতে দেয়া হয় না।

কারণ জানতে চাইলে গেটের সিকিউরিটি সদস্যরা জানান, উপরের নির্দেশে রয়েছে বিধায় তাদের ঢুকতে দেয়া হবে না। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশ ব্যাংকে ঢুকতে না দেয়ায় তাদের পোকা খাওয়া, ইঁদুরে খাওয়া ও ড্যাম টাকা ছোট-বড় নোট পরিবর্তন করতে পারছেন না। ফলে ছেঁড়া-ফাটা টাকা ব্যবসায়ী সদস্যদের পরিবার পরিজন নিয়ে কষ্টের মধ্যে দিন-যাপন করছেন।

মো. জাকির হোসেন (৬৫)। রাজধানীর বাসাবো দক্ষিণ মুগদাপাড়ার বাসিন্দা। ক্ষুদ্র ব্যবসা করে সংসার পরিচালনা করে আসছেন। তিনি বলেন, গত ২২ মে ১০টি ত্রুটিযুক্ত নোট মোট ৫ হাজার টাকা জমা দেই। ২ মাস ১২ দিন পর গত ৩ আগস্ট সকাল ১১টা ২৯ মিনিটে ৮৮০২৫৫৬৬৫০০৩ নম্বর থেকে আমার মোবাইলে ম্যাসেস আসে নতুন টাকা নেয়ার। এই ম্যাসেস প্রাপ্তির পরে বাংলাদেশ ব্যাংকে গেলে আমাকে ঢুকতে দেয়া হয়নি। স্লিপ দেখালেও সিকিউরিটি গার্ড সাহাবুদ্দিন ও সুপারভাইজার আফজাল ঢুকতে দেয়নি। তাহলে কি আমার টাকা নেই? ১০টি ত্রুটিযুক্ত নোট জমার স্লিপ নং-খম-৩৯০২/ক। স্লিপ দেখালেও আমাকে ঢুকতে দেয়া হয় না। তিনি অভিযোগ করে আরো বলেন, আমার মত স্লিপধারী শতাধিক লোক রয়েছে। সবমিলিয়ে কয়েক কোটি টাকা জমা রয়েছে। এ বিষয়ে ছেঁড়া-ফাটা টাকার বিনিময় ব্যবসায়ী সমিতির (রেজি নং-০০০৪৮) সভাপতি মো. নিজাম উদ্দিন বলেন, আমরা ছেঁড়া-ফাটা নোট ব্যাংকে জমা দিতে পারিনি। দেড় থেকে ২ কোটি টাকা আমাদের কাছে পড়ে রয়েছে। এই ছেঁড়া-ফাটা নোট পরিবর্তন করতে পারলে বাংলাদেশ ব্যাংকও ৪০ লাখ টাকা কমিশন পেত। আমরা ছেঁড়া-ফাটা নোট জমা দিয়ে নতুন টাকা পেতে চাই।

সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. আবুল হোসেন বলেন, আমাদের সমিতির ৫০০ সদস্য দুর্দশার মধ্যে আছে। ছেঁড়া-ফাটা টাকা পরিবর্তন করতে না পেরে আমাদের ছেলে-মেয়েদের লেখা পড়া বন্ধ হয়ে গেছে। সারা দেশের ৫০০ লোক এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এমনকি আমাদের লোকদের বাংলাদেশ ব্যাংকে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। এ বিষয়ে আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের কারেন্সি অফিসার, নির্বাহী পরিচালক (প্রশাসন বিভাগ) ও গভর্নর বরাবরে আবেদন করেছি। কিন্তু তারা কেনো সাড়া দেননি।

এসব অভিযোগের বিষয়ে কী বলছে বাংলাদেশ ব্যাংক? এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র বলছে, বাজার থেকে ছেঁড়া-ফাটা ও অপ্রচলনযোগ্য নোট তুলে নিয়ে এর বিপরীতে পরিচ্ছন্ন নোট সরবরাহ নিশ্চিত করা হবে। এ লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে পরিচ্ছন্ন নোট নীতিমালা জারি করা হয়েছে। এর আওতায় বাজার থেকে অপ্রচলনযোগ্য, ছেঁড়া-ফাটা ও ময়লাযুক্ত সব নোট পর্যায়ক্রমে তুলে নেওয়া হবে। এর বিপরীতে পরিচ্ছন্ন নোট ছাড়া হবে। এ লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় নোট ছাপানোর ক্ষেত্রে কালি ও কাগজসহ অন্যান্য উপকরণ যাতে দীর্ঘস্থায়ী হয় সে বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়ার বিষয়টি সক্রিয়ভাবে ভাবা হচ্ছে।

এ বিষয়ে গত ২৪ জুলাই সোমবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে একটি সার্কুলার জারির মাধ্যমে এ বিষয়ে নতুন নীতিমালা ঘোষণা করা হয়। এটি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের কাছে পাঠানো হয়েছে। নীতিমালায় বলা হয়, বাজারে বর্তমানে প্রচলিত ময়লাযুক্ত ছেঁড়া-ফাটা, আগুনে ঝলসানো, ড্যাম্প, মরিচাযুক্ত, অধিক কালিযুক্ত, অধিক লেখালেখি, স্বাক্ষরযুক্ত, বিভিন্ন খণ্ডে খণ্ডিত নোট রয়েছে। এগুলো বাজার থেকে পর্যায়ক্রমে প্রত্যাহার করা হবে। এর বিপরীতে পরিচ্ছন্ন নোট সরবরাহ করা হবে। বাজারে প্রচলিত নোটের স্থায়িত্ব বৃদ্ধির লক্ষ্যে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। পর্যাপ্ত পরিমাণে পুনঃপ্রচলনযোগ্য নোট সরবরাহ করা হবে। নোটের স্থায়িত্ব বৃদ্ধির লক্ষ্যে জনসচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকেও সম্পৃক্ত করা হবে। নোট ব্যবহারে অধিক যত্নবান হওয়ার বিষয়ে গণমাধ্যমে প্রচারণা চালানো হবে।

নীতিমালায় বলা হয়, পরিচ্ছন্ন নোট সরবরাহের লক্ষ্যে নোটের সর্টিং, প্যাকেজিং, ব্যান্ডিং নোটের প্যাকেটে ফ্লাইলিফ লাগানো ও স্ট্যাপলিং বিষয়ক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা পরিপূর্ণভাবে পালন করতে হবে। ওই নির্দেশনা অনুযায়ী নোটের বান্ডিলে কোনো স্ট্যাপলিং করা যাবে না। একই সঙ্গে নোটের বান্ডিল সুঁইয়ের মাধ্যমে ছিদ্র করে সুতা দিয়ে বাধা যাবে না। চাহিদা নিরূপণ করে নোট উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়ানো হবে। এটি উৎপাদনে দীর্ঘস্থায়ী, আধুনিক ও উন্নতমানের কাগজ, কালি ও নিরাপত্তাবৈশিষ্ট্য ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।

এই সার্কুলার জারির পরেও ছেঁড়া-ফাটার সঙ্গে জড়িত ক্ষুদ্র ব্যাবসায়ীরা বাংলাদেশ ব্যাংকে ঢুকতে পারছেন না। বিষয়টি অবাক করার মতো ঘটনা বলেই মনে করেন ভুক্তভোগীরা। এ বিষয়ে সিকিউরিটি ইনচার্জ মো. রবিউল এর মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি অফিসে গিয়ে কথা বলতে বলেন। পরের দিন বাংলাদেশ ব্যাংকে গিয়েও তাকে পাওয়া গেল না। বাংলাদেশ ব্যাংকের কারেন্সি অফিসার প্রকাশ চন্দ্র বৌরাগীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনিও কোনো সাড়া দেননি।