ঢাকা ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৯ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

৪৮ বছরেও পলাতক

বঙ্গবন্ধুর পাঁচ খুনির ফাঁসির অপেক্ষায় জাতি

বঙ্গবন্ধুর পাঁচ খুনির ফাঁসির অপেক্ষায় জাতি

৭৫-এর ১৫ আগস্ট সুনসান নীরবতায় দেশের মানুষ ঘুমে অচেতন। এরমধ্যেই রাজধানী ঢাকার ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কে অবস্থিত বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ঘিরে ফেলে একদল বিশ্বাসঘাতক। বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে প্রবেশ করে একে একে নির্মমভাবে হত্যা করে জাতির পিতাসহ তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের। এরা এতটাই উন্মাদ আর নির্দয় ছিল যে, তাদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি ১০ বছরের শিশু ও অন্তঃসত্ত্বা নারীও। এই নৃশংস হত্যাকারী ১২ আসামির মৃত্যুদণ্ডের রায় দেন আদালত। এর মধ্যে ছয়জনের রায় কার্যকর করা হয়েছে। দণ্ডিত আসামি আবদুল আজিজ পাশা পলাতক অবস্থায় ২০০২ সালে জিম্বাবুয়েতে মারা যান। ৪৮ বছরেও পলাতক রয়েছে বঙ্গবন্ধুর পাঁচ খুনি। তাদের কবে নাগাদ ফাঁসিতে ঝোলানো হবে সেই অপেক্ষার প্রহর যেন শেষ হচ্ছে না।

সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্যদিয়ে রচিত হয় ইতিহাসের এক নিষ্ঠুরতম আর কলঙ্কজনক অধ্যায়। তবে প্রতিবছর আগস্ট মাস এলেই ফিরে যাওয়া হয় ১৫ আগস্টে। দিনটি জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালনের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী ও তাদের দোসরদের শাস্তি নিশ্চিত করা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা করা হয়। অথচ বিস্ময়কর হলেও সত্য, ঘৃণিত হত্যাকারীদের কেউ কেউ আইনের ফাঁক গলিয়ে বেরিয়ে গেছে। হত্যাকারীদের দায় থেকে মুক্তি দিতে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়। খুনিদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দেওয়া হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রায় ৪৮ বছর পরেও দুই খুনি এএম রাশেদ চৌধুরী এবং নূর চৌধুরীকে দেশে ফিরিয়ে আনার জোর চেষ্টা করছে সরকার।

সংশ্লিষ্টরা জানান, সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্যদিয়ে ঘাতকরা সুদূরপ্রসারী ও গভীর রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র করেছিল। পরবর্তীতে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। এটা নিয়ে বিতর্ক করা অর্থহীন যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যেমন অনেকেই ছিলেন, তেমনি বিপক্ষ শক্তিও ছিল। সেটা যেমন দেশের ভেতরে ছিল, তেমনি দেশের বাইরেও ছিল। ফলে হত্যাকারী ও তাদের দোসররা এ দেশ শাসন করেছে।

জানা গেছে, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর খুনিদের বাঁচাতে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছিল, তাদের নানা পদ দিয়ে পুরস্কৃতও করা হয়েছিল। ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ইতিহাসে চিহ্নিত কালো ওই অধ্যাদেশ বাতিলের পর জাতির পিতার খুনের বিচারের পথ খোলে। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী মহিতুল ইসলাম তখন ধানমন্ডি থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর ঢাকার তখনকার জেলা ও দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল ১৫ জন সাবেক সেনা কর্মকর্তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন। আপিলের রায়ে এই ১৫ জনের মধ্যে তিনজন খালাস পান। যে ১২ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে উচ্চ আদালত, তাদের একজন আজিজ পাশা পলাতক অবস্থায় ২০০২ সালে জিম্বাবুয়েতে মারা যান। বাকি ১১ জনের মধ্যে সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশীদ, মহিউদ্দিন আহমদ, একে বজলুল হুদা ও একেএম মহিউদ্দিন বন্দি অবস্থায় আদালতে রিভিউ আবেদন করলে তা খারিজ হয়ে যাওয়ার পর ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি ফাঁসিতে ঝুঁলিয়ে আসামি সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খান, মহিউদ্দিন আহমদ (ল্যান্সার), একে বজলুল হুদা ও একেএম মহিউদ্দিনের (আর্টিলারি) মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করা হয়। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের মধ্যে আবদুল মাজেদ ছাড়াও খন্দকার আবদুর রশিদ, এএম রাশেদ চৌধুরী, শরিফুল হক ডালিম, এসএইচএমবি নূর চৌধুরী, আবদুল মাজেদ ও রিসালদার মোসলেম উদ্দিন খান সে সময় পলাতক ছিলেন। শেষ পর্যন্ত মাজেদ ধরা পড়ে ফাঁসিকাষ্ঠে গেলেও বাকিদের শাস্তি নিশ্চিত করার কাজটি বাকি রয়ে গেছে। এই পাঁচ আসামির মধ্যে রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে এবং নূর চৌধুরীর কানাডায় আছেন। তাদের ফিরিয়ে আনতে সরকারের তরফ থেকে যোগাযোগ করা হলেও যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা সরকারের সাড়া মেলেনি। আরেক আসামি মোসলেম উদ্দিন পাকিস্তানে আছেন বলে তথ্য ছিল ইন্টারপোলের বাংলাদেশ শাখা ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরোর (এনসিবি) কাছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশের তরফ থেকে যোগাযোগ করা হলেও পাকিস্তান কোনো জবাব দেয়নি। আর রশিদ ও ডালিম এখন কোথায় আছেন, সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনো তথ্য এখনো জানতে পারেনি সরকার।

জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলে সিনিয়র সাংবাদিক মনজুরুল আহসান বুলবুলের লেখা ‘পনেরো আগস্টের নেপথ্য কুশীলব’ শীর্ষক বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে গত মঙ্গলবার আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার ষড়যন্ত্রকারীদের খুঁজতে কমিশন গঠন করা হবে। এই কমিশন গঠনের প্রারম্ভিক কাজ হলো আইন তৈরি করা। এই আইনের ড্রাফট এরইমধ্যে তৈরি করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি পেলে সেটি জাতীয় সংসদে নিয়ে যাওয়া হবে।

আনিসুল হক বলেন, ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎকে বদলে দেওয়ার জন্য যে কলঙ্কিত চেষ্টা করা হয়েছিল, যে নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছিল, তার সঙ্গে কারা কারা জড়িত ছিল, সেটা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে জানানোই হবে কমিশনের উদ্দেশ্য। কমিশনের কাজ প্রতিহিংসামূলক হবে না, ভবিষ্যতে কেউ যেন প্রশ্ন তুলতে না পারে।

আইনমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দুই খুনি এএম রাশেদ চৌধুরী এবং নূর চৌধুরীকে দেশে ফিরিয়ে আনার জোর চেষ্টা চলছে। দুই খুনির মধ্যে এএম রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছে। নুর চৌধুরী আছে কানাডায়। নুর চৌধুরীকে ফিরেয়ে আনার ব্যাপারে কানাডা যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে, সেটা আমরা উত্তরণের চেষ্টা করছি। আমরা কানাডিয়ান সরকারকে অনুধাবন করানোর চেষ্টা করছি। একটা স্টেজে গিয়ে আমরা বলব, আমাদের যে এতদিনের বন্ধুত্ব, সেই বন্ধুত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যাবে, যদি তাকে ফেরত না দেওয়া হয়। অন্যদিকে রাশেদ চৌধুরী সম্পর্কে এতটুকু বলতে পারি, আমরা আলোচনা করছি। আপাতত এর থেকে বেশি আর কিছু বলতে চাই না।

তিনি আরো বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচারের আরো দুই-তিনটা তাৎপর্য আছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার না হওয়ার কারণে মানুষের মধ্যে একটা ধারণা ছিল যে, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারই হয় না, সেখানে আমাকে কেউ খুন করলে সেটার তো বিচার হবেই না। এটা মনস্তাত্ত্বিকভাবে মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছিল। এখন কিন্তু দেশ সেই জায়গা থেকে উঠে এসেছে। এটি দেশের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মাত্র সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় চীনের চেয়েও বেশি ছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জাতীয় অর্থনীতিতে ভঙ্গুর অবস্থা সৃষ্টি হয়। জাতি এক অন্ধকার পথে যাত্রা শুরু করেছিল। যারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে, তাদের বিচার হলেও ষড়যন্ত্রকারীদের বিচার হয়নি। সেই ষড়যন্ত্রকারীদের বিচার হওয়া জরুরি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যারা রাষ্ট্রনায়কদের হত্যা করেছে; সেখানে হত্যাকারীদের বিচার যেমন হয়েছে; একই সঙ্গে ষড়যন্ত্রকারীরাও বিচারের আওতায় এসেছে।

তিনি আরো বলেন, বঙ্গবন্ধু মানুষের জন্য কাজ করেছিলেন এবং সারাজীবন মানুষের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেন। তিনি ১৯৭২ সালে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। দেশে ফিরে এসে তিনি বৃদ্ধ মা-বাবা কিংবা পরিবারের কাছে যাননি। তিনি সেদিন সেই রেসকোর্স ময়দানে জনগণের কাছে ফিরে আসেন, যে ময়দানে ৭ মার্চের ভাষণে তিনি বলেছিলেন- তোমাদের যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। বঙ্গবন্ধু সেদিনও জনসমুদ্রে তার বক্তব্যে বলেছিলেন, পাকিস্তানিরা চলে গেলেও তাদের দোসররা রয়ে গেছে। ষড়যন্ত্রকারীরা যে রয়ে গেছে- তা বঙ্গবন্ধুও আঁচ করতে পেরেছিলেন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত