অপরিকল্পিত নগরায়ন

টানা বৃষ্টিতে রাজধানীজুড়ে যানজট-জলজটে ভোগান্তি

* উন্নয়নকাজে সেবা সংস্থাগুলোর সমন্বয়ের ঘাটতি * অর্থ অপচয় বন্ধে দ্রুত মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা উচিত : নগর পরিকল্পনাবিদ

প্রকাশ : ১৪ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

অপরিকল্পিতভাবে রাজধানী ঢাকায় যখন-তখন যত্রতত্র উন্নয়ন কাজের নামে বছরের পর বছর লাখো মানুষকে ভোগান্তিতে ফেলছে সেবা সংস্থাগুলো। যুগের পর যুগ এই অপরিকল্পিত উন্নয়নের পেছনে সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতাকে দায়ী করে আসছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা। অথচ আজ পর্যন্ত সেবা সংস্থাগুলোর মধ্যে কোনো সমন্বয় দেখা যায়নি। বরং আগের তুলনায় বর্তমানে সমন্বয়হীনতা বেশি দেখা যাচ্ছে। যার কারণে নগরীতে বৃষ্টি হলেই যানজট ও জলজটের সৃষ্টি হচ্ছে।

সম্প্রতি টানা বৃষ্টিতে রাজধানীর মূল সড়ক থেকে অলিগলির অধিকাংশ রাস্তায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। পল্টন, মালিবাগ, ফকিরাপুল, আরামবাগ, মতিঝিল, তেজগাঁও, মিরপুর ও পুরান ঢাকার বিভিন্ন সড়কে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। কদমতলীর জিয়া সরণির প্রধান সড়কের খাল ভরে রাস্তা তলিয়ে যেতে দেখা যায়। এছাড়া উন্নয়নকাজ চলায় সায়েদাবাদের দয়াগঞ্জ, জুরাইন, মীরহাজীরবাগ, মানিকনগর, গোপীবাগ রেলওয়ে এলাকার মানুষ দুর্ভোগে পড়েন। রাস্তায় পানি জমে যাওয়ার কারণে মোটরসাইকেল, প্রাইভেট কার ও বাসসহ বেশ কিছু গাড়ি বন্ধ হয়ে যানজটের সৃষ্টি হয়। তাছাড়া ম্যানহোলের ঢাকনা না থাকায় অনেককেই বিভিন্ন জায়গায় বিপদে পড়তে দেখা গেছে। সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েছেন সাইনবোর্ড, মাতুয়াইল, শনিরআখড়া ও যাত্রাবাড়ী এলাকার বাসিন্দারা। চলমান বৃষ্টির মৌসুমে যাত্রাবাড়ীতে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কাজ চলছে। কিন্তু রাস্তার পাশে ড্রেন থাকায়, ড্রেনের পানি দিয়ে রাস্তা ডুবে গেছে। ফলে রাস্তার উন্নয়ন কাজ বন্ধ হয়ে পড়েছে।

বৃষ্টির মৌসুমে যাত্রাবাড়ীতে রাস্তার উন্নয়ন কাজ করার বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের অঞ্চল-৫ এর নির্বাহী প্রকৌশলী (পুর) মো. সাইফুল ইসলাম জয় আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, কোরবানি ঈদের আগেই যাত্রাবাড়ীতে ভাঙা রাস্তা সংস্কারের কথা ছিল। তাতে কোরবানির গরুর হাট বসানো এবং ঈদে মানুষের ভোগান্তি বাড়ত। এছাড়াও ওই সময়ে পুলিশের সহযোগিতা পাওয়া যায়নি। সেজন্য এখন রাস্তা সংস্কারের কাজ ধরা হয়েছে। রাস্তার ওপর থেকে ড্রেনের পানি নিষ্কাষণে পাম্প মেশিন ব্যবহার করা হবে। তিনি আরো বলেন, এবার যাত্রাবাড়ীতে রাস্তা মজবুত করে করা হচ্ছে। মেরামতকৃত রাস্তাটি দিয়ে ২৭ মেট্রিক টনের মালবাহী গাড়ি চলাচল করলেও আগামী ৫০ বছর পর্যন্ত রাস্তাটি নষ্ট হবে না। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের বাড্ডা থানার ৩৭ নম্বর ওয়ার্ডের জলাবদ্ধতা নিয়ে চরম বিপাকে স্থানীয় অধিবাসীরা। বিশেষ করে বাড্ডার নিম্নাঞ্চল বলে পরিচিত আনন্দ নগর, পোস্ট অফিস গলি, সাহাবউদ্দিন মোড়, বাজার গলি, বড় টেক জোড়া খাম্বা এবং ডিআইটি প্রজেক্টের ভেতরের দিকে সামান্য বৃষ্টি হলেই তৈরি হয় জলাবদ্ধতা। স্থবির হয়ে যায় দৈনন্দিন জীবন। বাড্ডার বাসিন্দা সিরাজুল ইসলাম খান বলেন, বর্ষাকাল এলেই আমাদের দুর্গতি শুরু হয়। সামান্য বৃষ্টি হলেই রাস্তায় হাঁটুপানি জমে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বর্ষাকালের ৩-৪ মাস জলবদ্ধতায় আমাদের দুর্গতি চরম আকার ধারণ করে।

জানা গেছে, রাজধানীজুড়ে সড়ক খোঁড়াখুঁড়ির উৎসব নাগরিকদের বিপর্যস্ত অবস্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সিটি কর্পোরেশন, ওয়াসা, তিতাস ও ডেসকোসহ সবাই মিলে প্রতিদিনই কোনো না কোনো সড়ক, অলিগলি খুঁড়ছে। আজ এ প্রতিষ্ঠান সড়ক কাটছে তো কাল আরেক প্রতিষ্ঠান। নগরবাসীকে উন্নত রাস্তাঘাট, পরিচ্ছন্ন নর্দমা বা সুষ্ঠুভাবে গ্যাস, বিদ্যুৎ আর পানির সেবা পৌঁছে দেওয়ার নামে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি হলেও তাতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে নাগরিক জীবন। প্রতিদিন রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির ফলে বৃষ্টিতে নগরজুড়ে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়ে নোংরা হয়ে উঠছে পরিবেশ। ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি কর্পোরেশনের আওতায় রয়েছে প্রায় ২২০০ কিলোমিটার সড়ক। সড়ক উন্নয়নের খপ্পরে নগরবাসী পড়েছে মহাবিপাকে। সড়ক খোঁড়াখুঁড়ির কারণে প্রতিটি সড়কেই যানজট প্রায় স্থায়ী রূপ নিচ্ছে। যান্ত্রিক যানবাহনে যে পথ সাধারণ অবস্থায় ১০ মিনিটে অতিক্রম করার কথা, সে পথ পাড়ি দিতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১০ গুণ সময়ও লাগছে। উন্নয়নকাজের সমন্বয়হীনতার কারণে জনভোগান্তি যেন স্থায়ী রূপ নিচ্ছে। নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, নগরবাসী অবশ্যই সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে মানসম্মত সেবা চায়। পানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ, টেলিফোন কিংবা ওয়াসার উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন কাজে সাময়িক ভোগান্তির শিকার হতেও তারা রাজি। কিন্তু তা যেভাবে স্থায়ী রূপ নিচ্ছে তা মেনে নেওয়া যায় না। এ অবস্থার অবসান ঘটাতে হবে। এক সময় রাজধানীর পানি নিষ্কাষণের জন্য ব্যবহৃত হতো বেশ কিছু প্রাকৃতিক খাল। এসব খালের বেশিরভাগই বেদখল এবং ভরাট হয়ে গেছে। সরকারি খাল ও নদী বেদখল হয়ে যায়। সরকারি সংস্থার কিছু অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে একশ্রেণির খালখেকো লুটেরা রাজত্ব দেখায়। ফলে বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা দেখা দেয় রাজধানীতে। অচলাবস্থা সৃষ্টি হয় নগরজীবনে। নাগরিকদের ভোগান্তি বাড়ে। জলাবদ্ধতা নিরসনে রাজধানীতে ড্রেন ও স্যুয়ারেজ মেরামত এবং উন্নয়ন কাজগুলো মার্চ মাসের আগেই শেষ করা উচিত। অথচ প্রতি বছর জুন, জুলাই ও আগস্টের ভরা বর্ষা মৌসুমে ঠিকাদাররা রাস্তা খুঁড়ে বসে থাকে। এসব কারণেও রাজধানীর অনেক স্থানে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। অর্থবছরে নয়-দশ মাস পার করে বর্ষার আগে কাজ শুরু করে সেবা সংস্থাগুলো। সূত্রমতে, একসময় রাজধানীতে ৪৭টি খাল ছিল। এগুলো বৃষ্টির পানি ধারণ ও নিষ্কাশনে ব্যবহার হতো। বর্তমানে দখল দূষণের চাপে ২৬টি খাল টিকে আছে। ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে রাজধানীর খাল উদ্ধার ও পানি নিষ্কাশনের দায়িত্ব দুই সিটি কর্পোরেশনের (ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর) কাছে ন্যস্ত হওয়ার পর জোরেসোরে খালগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নের কাজ শুরু করে সিটি কর্পোরেশন। তবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) থেকে বলা হয়েছে, ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে খালগুলো হস্তান্তরের পর তা দখলমুক্ত করার কাজ শুরু হয়েছে। অনেক খাল পরিষ্কার করা হয়েছে। কিন্তু কিছুদিন পরই এলাকাবাসী আবার খালগুলোতে ময়লা-আবর্জনা ফেলছে, স্থাপনা গড়ে তুলছে। এ চিত্র রাজধানীর ২৬টি খালেই আছে। সরকারি খাল ভরাটের ফলে বৃষ্টির পানি উপচে পড়ে বাসা বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, রাস্তাঘাট প্রতি বছর ডুবছে। রাজধানীতে জলাবদ্ধতার ভোগান্তি দীর্ঘদিনের এমন মন্তব্য করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ও ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক আদিল মুহাম্মদ খান আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, পানি কোন পথ দিয়ে নামবে, সেই কাজ আগে করা উচিত ছিল। তা না করে শুধু সংযোগ লাইনের কাজ করলে কি পরিবর্তন আসবে? লাইনের পানি সরার জায়গা তো আগে ঠিক করতে হবে। ঢাকাবাসীর ভোগান্তি কমাতে পরিকল্পিত এবং যথাযথ উন্নয়ন না করলে কোনো ক্ষেত্রেই সুফল পাওয়া যাবে না। কোন কাজটি আগে করা উচিত, আর কোনটি পরে সেটি যদি চিহ্নিত না করা হয় সেই ক্ষেত্রে অর্থ ব্যয় হলেও নগরবাসী ভোগান্তি থেকে মুক্তি পাবে না। তিনি আরো বলেন, নালা সংযোগ ব্যবস্থার মহাপরিকল্পনা তৈরি না করে বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করা হলে তা হবে শুধুই টাকার অপচয়। পুরান ঢাকার ক্ষেত্রে তা-ই হয়েছে। এই অপচয় বন্ধে দ্রুত মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন শেষ করে সে অনুযায়ী কাজ করা উচিত বলে মনে করেন এই নগর পরিকল্পনাবিদ।