মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বাসায় তিন দলের নেতাদের বৈঠক

এবারো নেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রসঙ্গ

প্রকাশ : ১৬ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  আরিফুল ইসলাম

ঢাকা সফরকালে যুক্তরাষ্ট্রের দুই কংগ্রেস সদস্য দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের বাসায় এ বৈঠকে যোগ দেন আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির নেতারা। এছাড়া সুশীল সমাজের প্রনিতিধিদের নিয়ে পৃথক বৈঠক করেন মার্কিন কংগ্রেসের সদস্য রিপাবলিকান রিচ ম্যাকরমিক ও ডেমোক্র্যাট এড কেইস। বৈঠকের বিষয়বস্তু ছিল আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন। বৈঠকে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন তারা।

এদিকে সরকারের পক্ষ থেকেও আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি রয়েছে। মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বাসায় বৈঠকের আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেনও মার্কিন প্রতিনিধিদলকে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দেন। মার্কিন কংগ্রেস সদস্যদের সঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকেও নির্বাচনকালীন তত্ত্ববধায়ক সরকার প্রসঙ্গ আসেনি। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও বারবার বলছেন, বিদেশিরা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে কথা বললেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলছে না। সরকার অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে বিদেশিদের কাছে অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে। বর্তমান সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এদিকে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা পরিবর্তনের দাবিতে পদযাত্রার মতো কর্মসূচি পালন করছে বিএনপি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে অংশ না নেয়ার ব্যাপারে এখন পর্যন্ত অনড় অবস্থানে রয়েছে দলটি। বিএনপির নেতারা বলছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন না হলে সে নির্বাচনে তারা অংশ নেবে না। তবে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের তরফ থেকে বার বার বলা হচ্ছে তারা সংবিধানের বাইরে একচুলও যাবে না। বিএনপির নেতাকর্মী ও সমর্থকদের ধারণা বিদেশি কোনো শক্তি বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র চাপ দিলে ক্ষমতাসীনরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মানতে বাধ্য হবে। আগামী নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হলে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে এবং ওই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তারা ক্ষমতায় আসতে পারবে। তবে বিএনপির এমন প্রতাশা যুক্তরাষ্ট্র পূরণ করতে আগ্রহী নয় বলেই তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রসঙ্গটি বাদ দিয়ে কেবল অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ওপর জোর দিচ্ছে। বাংলাদেশের সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল হয়ে গেছে আদালতের মাধ্যমে। এর আগেও যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের যেসব মিশন বাংলাদেশে এসেছে তারা কেউই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুটি আনেনি। এবারো দুই মার্কিন কংগ্রস সদস্য এ প্রসঙ্গটি তোলেনি। ফলে বিএনপি এবারো আশাহত হলো।

সূত্র জানায়, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের নভেম্বরে তফসিল দিয়ে ডিসেম্বরের শেষে ভোট করতে চায় নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ভোট উপলক্ষ্যে চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিচ্ছে সাংবিধানকি প্রতিষ্ঠানটি। ভোটকে সামনে রেখে একের পর এক বিদেশিরা দেশে আসছেন। নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করছেন, সবাই সুষ্ঠু ভোট চান। কিন্তু কেউ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রসঙ্গ নিয়ে আসছে না। এর ফলে বর্তমান সরকারের অধীনে আইন অনুযায়ী সময় মতো পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করলেও তা জনসমর্থন পায়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারে আবার ফিরে যেতে হলে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। বিএনপি জাতীয় সংসদে নেই। সংসদে আওয়ামী লীগে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেও আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারে ফিরে যাওয়ার মনমানসিকতা পোষণ করে না। জানা যায়, গত রোববার আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির নেতারা মার্কিন প্রতিনিধিদলের সদস্যদের সঙ্গে বৈঠকে অংশ নেন। আওয়ামী লীগের অর্থ ও পরিকল্পনা সম্পাদক ওয়াসিকা আয়শা খান, সংসদ সদস্য নাহিম রাজ্জাক ও তামান্না নুসরাত (বুবলী), বিএনপির প্রচার সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি এবং জাতীয় সংসদে বিরোধীদল জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য রানা মোহাম্মদ সোহেল, নাজমা আকতার ও শেরীফা কাদের এই বৈঠকে অংশ নেন। তাদের সঙ্গে বৈঠকের পর মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বাসায় সফররত দুই কংগ্রেস সদস্য সুশীল সমাজ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এর আগে সকালে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় দুই কংগ্রেস সদস্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে বৈঠক করেন। ওই বৈঠকেও বাংলাদেশে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করার ব্যাপারে উভয়পক্ষ একমত পোষণ করে। বৈঠকের পর তিন দলের নেতারা সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। তারা বলেন, মার্কিন প্রতিনিধিদল বাংলাদেশের আগামী সাধারণ নির্বাচন সম্পর্কে জানতে চাইলেও নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে কোনো কথা বলেনি। বৈঠকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়, সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনো বিধান রাখা সম্ভব নয়। বৈঠকে কংগ্রেসম্যান এড কেইস আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদলকে বলেন, শুধু তোমাদের দেশে নয়, সারা পৃথিবীর কাছে অবাধ, সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে হবে। জবাবে আওয়ামী লীগ নেতারা নির্বাচন পর্যবেক্ষক হিসেবে তাদের আসার জন্য আমন্ত্রণ জানান। একই সঙ্গে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতির কথা ব্যক্ত করেন। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব কী কারণে, সেই বিষয়টি তুলে ধরেন দুই কংগ্রেসম্যান। এর মধ্যে ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে বাংলাদেশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ, একই সঙ্গে বাংলাদেশের জনসংখ্যা। বাংলাদেশে যেন গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় থাকে, সেটা চায় যুক্তরাষ্ট্র। আইনের মাধ্যমে সরকার নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করা হয়েছে বলে মার্কিন প্রতিনিধিদলকে জানান আওয়ামী লীগের এক সদস্য। তিনি আরো বলেন, জাতীয় সংসদের সামনের অধিবেশনে আরেকটি আইন আসবে। সেখানে নির্বাচনের সময়ে বিশৃঙ্খলা করা বা বাধা দেওয়ার ক্ষেত্রে শাস্তির বিধান রাখা হবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে কোনো তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায় না। তারা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চায়। তারা দেশের আইন অনুযায়ী নির্বাচন চায়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে সহযোগী হতে চায়। আর তাই আমাদের দিকে তাদের বিশেষ নজর। সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠনসহ বিভিন্ন পদক্ষেপে তারা সন্তোষ প্রকাশ করেছে। তিনি আরো বলেন, আমেরিকা চাইছে বাংলাদেশে একটি আদর্শ নির্বাচন হোক। তবে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সব দলের সক্রিয় সহযোগিতা প্রয়োজন বলে জানান মন্ত্রী।

বৈঠক নিয়ে বিএনপি নেতা শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি বলেন, দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তারা জানতে চেয়েছিলেন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও নির্বাচনের বিষয়। আমরা বলেছি, বিএনপি দেশে একটা অবাধ, সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন চায়। অতীতে ক্ষমতাসীন সরকারের কোনো নির্বাচনই সুষ্ঠু হয়নি। সেজন্য আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের কথাটি তুলে ধরেছি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে যাবে না। এ কথাও তাদের কাছে কথা তুলে ধরা হয়েছে। সেজন্য আমরা আন্দোলনও করছি, সে কথাও তাদের বলেছি।

বৈঠকে অংশ নেওয়া জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য রানা মোহাম্মদ সোহেল বলেন, বৈঠকে নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আমরা বিদ্যমান পরিস্থিতি তুলে ধরে বলেছি সমস্যা সমাধানে আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। তা না হলে পরিস্থিতি সংঘাতের দিকে যাবে।

সংরক্ষিত মহিলা আসনে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য নাজমা আকতার বলেন, এ বৈঠকে বর্তমানে বাংলাদেশের পরিস্থিতি কী, দলগুলোর সবাই কী চায়- এমন বিষয় উঠে এসেছে। আমাদের দলের পক্ষ থেকেও বর্তমান পরিস্থিতিতে সামনে নির্বাচনের বিষয়ে অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে। সুষ্ঠু নির্বাচন যেন হয়, তা-ই জনগণের চাওয়া। সবাই চায় আগামী নির্বাচনটা সুষ্ঠু হোক, মানুষের আকাঙ্ক্ষা যেন পূরণ হয়।