ঢাকা ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৯ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ঢাকা উত্তর সিটিতে ‘তুঘলকি কাণ্ড’

ঢাকা উত্তর সিটিতে ‘তুঘলকি কাণ্ড’

দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে দেশজুড়ে সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। কারণ, সিটি করপোরেশনটিতে মশার ওষুধ সরবরাহে অনিয়ম-দুর্নীতি ও গ্রাহকের হোল্ডিং ট্যাক্সের টাকার হদিস মিলছে না। দিনের পর দিন যেন ‘তুঘলকি কাণ্ড’ ঘটছে ডিএনসিসিতে। এসব দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে বলে জানান সংস্থাটির সংশ্লিষ্টরা।

সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন কেন্দ্র করে সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। ওই সিন্ডিকেটের পেছনে সিটি করপোরেশনের কিছু অসাধু কর্মকর্তা জড়িত। যার ফলে কিছু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অনিয়মের সুযোগ পাচ্ছে। সিটি করপোরেশন কেন্দ্র করে সিন্ডিকেট গড়ে ওঠে বিষয়টি মেয়র আতিকুল ইসলাম নিজেই বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমের সামনে তুলে ধরেন। এমনকি মশার ওষুধ আমদানির সঙ্গে জড়িত সব ধরনের সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়ার কথা বলেছিলেন মেয়র। কিন্তু বাস্তবে সেটি আর সম্ভব হয়নি। বরং এবার মশার লার্ভা নিধনে ওষুধ আমদানিতে যে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দায়িত্ব পেয়েছে, ওই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ভয়াবহ অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। এখন ভাবমূর্তি টিকিয়ে রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে উত্তর সিটি করপোরেশনের।

মশার উপদ্রব্য থেকে নগরবাসীকে রেহাই দিতে ওষুধ ছিটানোর কৌশল শিখতে ডিএনসিসি মেয়রের নেতৃত্বে সম্প্রতি একটি দল বিদেশে প্রশিক্ষণে যান। যুক্তরাষ্ট্রের মিয়ামি শহরে গিয়ে মশা নিধন কার্যক্রম দেখে মেয়রের উপলব্ধি হয়েছে, ঢাকা শহরে মশা নিধনে যে প্রক্রিয়ায় কাজ করা হয়, তা ভুল পদ্ধতি। মশা নিধন পদ্ধতির সমালোচনার মধ্যেই ওষুধ সরবরাহে ভয়াবহ জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। এ নিয়ে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান মার্শাল অ্যাগ্রোভেটের ওপর পুরো দায় চাপালেও তাদেরকে সামনে আনেনি ডিএনসিসি। প্রতিষ্ঠানটি আড়ালে রেখেই কীটতত্ত্ববিদ ডেকে ‘ব্যাসিলাস থুরিনজেনসিস ইসরায়েলেনসিস (বিটিআই)’ ব্যাকটেরিয়া মশা মারতে কার্যকর বলে প্রমাণের চেষ্টা করছে ডিএনসিসি।

জানা গেছে, চলতি বছরের ৭ আগস্ট এক অনুষ্ঠানে সিঙ্গাপুর থেকে পাঁচ টন বিটিআই আনার কথা জানিয়েছিল ডিএনসিসি। একই সঙ্গে পরীক্ষামূলক প্রয়োগও শুরু হয়। তবে সিঙ্গাপুরের কোম্পানি বেস্ট কেমিক্যাল লিমিটেড জানিয়েছে- তাদের কোম্পানি থেকে ডিএনসিসিতে কোনো বিটিআই সরবরাহ করা হয়নি। একই সঙ্গে ডিএনসিসির কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিতে ৭ আগস্ট বেস্ট কেমিক্যালের যে প্রতিনিধিকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ওই ব্যক্তির সঙ্গেও বেস্ট কেমিক্যাল লিমিটেডের কোনো সম্পর্ক নেই। এ-সংক্রান্ত একটি বার্তা কোম্পানিটির ফেসবুক পেজেও দেওয়া হয়।

এমন জালিয়াতির বিষয় সামনে আসার পর নানা মহলে সমালোচনা শুরু হয়। এর মধ্যে ওষুধ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ঘোষণা দেন মেয়র আতিকুল ইসলাম। আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান মার্শাল অ্যাগ্রোভেট যেহেতু দাবি করেছে তারা সিঙ্গাপুরের বেস্ট ক্যামিকেলস থেকে এনেছে, সেজন্য তাদের কাছে প্রমাণসহ তথ্য চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বিটিআই সরবরাহে পুরো ক্রয় প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি, জালিয়াতি ও প্রতারণার মাধ্যমে করা হয়েছে। যারা জড়িত তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। কারণ এটি রাষ্ট্রীয় ক্রয়, কোনো ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির ক্রয়ও না। যথাযথ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ক্রয় কার্যক্রম করতে হয়। বিদেশি যে কোম্পানি থেকে কেনা হয়েছে, তারা যেহেতু অস্বীকার করছে এখানে অবশ্যই নিয়মের লঙ্ঘন হয়েছে। এটা প্রতারণা। এটা শুধু ব্যক্তি বিশেষের দায়িত্ব না, পুরো প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বিটিআই সিঙ্গাপুরের বেস্ট কেমিক্যাল থেকেই তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে আনা হয়েছে। তবে তাদের প্যাকেটের গায়ে ডিএনসিসির জন্য উৎপাদিত লেখা থাকার পরও বেস্ট কেমিক্যালস অস্বীকার করায় এ যুক্তিও মানতে নারাজ অন্য একটি পক্ষ। ধারণা করে সংস্থাটির বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা বলেছেন, এটি বিটিআই চীন থেকে আমদানি করা হয়ে থাকতে পারে।

মশার ওষুধ নিয়ে জালিয়াতির ঘটনায় ডিএনসিসির প্রধান ভাণ্ডার ও ক্রয় কর্মকর্তা রমেন্দ্র নাথ (উপসচিব) মার্শাল অ্যাগ্রোভেট কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডকে চিঠি দেয়। মার্শাল অ্যাগ্রোভেটের নির্বাহী পরিচালক মো. নাসির উদ্দিন আহমেদকে দেওয়া ওই চিঠিতে বলা হয়, সিটি করপোরেশনের ভাণ্ডার ও ক্রয় বিভাগ কর্তৃক মশক নিধনের বিটিআই সরবরাহের জন্য আহ্বান করা অনলাইন ইজিপি দরপত্রে সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে পণ্যটি সরবরাহের জন্য গত ২১ মে কার্যাদেশ প্রদান করা হয়। কার্যাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে আগস্টের প্রথমে সরবরাহ করা বিটিআই বেস্ট কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লি. সিঙ্গাপুরের উৎপাদিত এবং তাদের কাছ থেকে সংগৃহীত বলে উল্লেখ করেছে।

আরো বলা হয়, সরবরাহকৃত বিটিআই সিঙ্গাপুরের ওই কোম্পানির নয় বলে তাদের ফেসবুক পেজে একটি পোস্ট দেওয়া হয়েছে। এমতাবস্থায়, সরবরাহকৃত বিটিআই সিঙ্গাপুর বেস্ট কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজের উৎপাদিত এবং সরবরাহকৃত কি না, অবিলম্বে এ সংক্রান্ত সব প্রমাণ দাখিলসহ বিস্তারিত ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে।

মশার লার্ভা নিধনে আমদানি করা জৈব কীটনাশক বাসিলাস থুরিনজেনসিস ইসরায়েলেনসিস বা বিটিআই নিয়ে জালিয়াতির অভিযোগের পাশাপাশি হোল্ডিং ট্যাক্সের টাকা নিয়েও জালিয়াতির ঘটনা ঘটছে।

ভুয়া রশিদ দিয়ে গ্রাহকদের হোল্ডিং ট্যাক্সের টাকা সরিয়ে নেওয়ার অভিযোগ এসেছে সংশ্লিষ্ট এজেন্ট ব্যাংক ও ডিএনসিসি’র বিরুদ্ধে। কারণ, গত অর্থ বছরে গ্রাহক তার হোল্ডিং ট্যাক্সের টাকা জমা দিলেও সিটি করপোরেশনের তালিকায় তা বকেয়া দেখানো হয়েছে।

রাজধানীর মাটিকাটা এলাকার বাসিন্দা হোল্ডিং ট্যাক্সের টাকা একটি এজেন্ট ব্যাংকের মাধ্যমে পরিশোধ করলেও পরে দেখতে পান ওই টাকা এখনো বকেয়ার তালিকায় রয়েছে। পরে বিষয়টি স্পষ্ট হতে ডিএনসিসির আঞ্চলিক কার্যালয়ে যান ওই গ্রাহক। পরে জানতে পারেন, তার হাতে যে রশিদ রয়েছে, সেটি ভুয়া। একই অবস্থা মিরপুরের বাসিন্দাদের। গ্রাহকদের হোল্ডিং ট্যাক্সের টাকা নয়ছয় হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ডিএনসিসিতে বৈঠক করা হয়। ওই বৈঠকে বলা হয়, অনলাইনে হোল্ডিং ট্যাক্স প্রদানে ভুয়া রশিদের ব্যবহারের সঙ্গে যারা জড়িত রয়েছে তাদের শনাক্ত করে আইনানুক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া ট্রাস্ট ইনোভেশন লিমিটেডে (টিআইএল) কর্মরত প্রোগ্রামার, সহকারী প্রোগ্রামার ও সুপারভাইজারসহ যারা সফটওয়্যার থেকে গ্রাহকের ডাকা মুছে ফেলার সঙ্গে সম্পৃক্ত তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে, ওই বৈঠকে।

গ্রাহকের হোল্ডিং ট্যাক্সের টাকার জালিয়াতির বিষয়ে ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, হোল্ডিং ট্যাক্সের অনিয়মের সঙ্গে যারা যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশা দেওয়া হয়েছে। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক ব্যাপার, তারা সিন্ডিকেট তৈরি করার চেষ্টা করছে।

এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও আঞ্চলিক পরিকল্পনা বিভাগের শিক্ষক ও ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. আদিল মোহাম্মদ খান আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, গ্রাহকের হয়রানি বন্ধে উত্তর সিটি করপোরেশন হোল্ডিং ট্যাক্স অনলাইনে আদায় করছে। এটি নিঃসন্দেহ ভালো উদ্যোগ। কিন্তু সেখানেও দুর্নীতির আখড়া হয়েছে। অডিট টিম ঠিকভাবে কাজ না করায় এসব অনিয়ম বাড়ছে। কারণ, দুর্নীতিবাজরা মনে করে, অনিয়ম করলেও শাস্তি হয় না। আবার শাস্তি হলেও নামমাত্র। সেজন্যই ব্যাংক কর্মকর্তা-সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা ট্যাক্স জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন।

তিনি আরো বলেন, মশার ওষুধ কেনাকাটায় জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছে। সেখানে ওষুধের মান ভালো কিংবা খারাপের বিষয় নয়। জালিয়াতচক্রকে আগে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। অপরাধীকে শাস্তির আওতার বাইরে রাখা হলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো আগামীতেও জালিয়াতির আশ্রয় নেবে।

প্রসঙ্গত, মশার লার্ভা নিধনে বিটিআই ব্যাকটেরিয়ার মোড়কে লেখা এটি সিঙ্গাপুরের বেস্ট কেমিক্যাল লিমিটেডের তৈরি। চট্টগ্রাম বন্দর সংশ্লিষ্ট সূত্র বলেছে, গত ২৬ জুলাই চীনা কোম্পানি শানডং গানন অ্যাগ্রোকেমিক্যাল থেকে বিটিয়াই ব্যাকটেরিয়া আমদানি করে মার্শাল অ্যাগ্রোভেট কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। তবে প্রথম চালানটিতে পাঁচ টন পরিমাণ বিটিআই ব্যাকটেরিয়া ছিল। আমদানি করার চার দিন পর ৩০ জুলাই ৫ লাখ ৩৮ হাজার টাকা শুল্ক পরিশোধ করে চট্টগ্রাম থেকে পণ্যটি খালাস করে মার্শাল অ্যাগ্রোভেট কেমিক্যাল। ডিএনসিসির দরপত্রে দেখা যায়, বিটিআই আমদানির ক্ষেত্রে প্রস্তুতকারক দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, সিঙ্গাপুর, ভারত ও মালয়েশিয়ার নাম রয়েছে। কিন্তু এসব দেশ থেকে বিটিআই আমদানি করেনি প্রতিষ্ঠানটি। উল্টো চীন থেকে আমদানি করার বিষয়টি তারা চেপে যায়। এ পণ্যটি আসলেই সিঙ্গাপুর থেকে কেনা হয়েছে কি না, এ বিষয়ে খোঁজ না নিয়ে গত ৩ আগস্ট এই বিটিআইয়ের প্রচার করে ডিএনসিসি।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত