ঢাকা ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৯ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ডেঙ্গুতে চলতি বছর মৃত্যু ৪৬৬

ঢাকার দুই সিটিকে দুষছে নগরবাসী

ঢাকার দুই সিটিকে দুষছে নগরবাসী

রাজধানীতে বছরের পর বছর ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মানুষের মৃত্যু বাড়ছে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় প্রতিদিন হাসপাতালে বাবা তার সন্তানের মৃত্যু দেখছেন, আবার সন্তান তার বাবা-মায়ের মৃত্যু দেখছেন। অন্যদিকে স্বজনরা মৃত্যুর খবরে চোখের জল মুছছে। তরতাজা প্রাণের এমন মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনার পরেও টনক নড়ছে না কারো।

কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, এডিস মশা নিধনে ঢাকা দক্ষিণ-উত্তর সিটি কর্পোরেশন বিভিন্ন উদ্যোগ নিলেও, সেটি সুফল হয়নি, উল্টো নগরবাসীর চিন্তা বাড়ছে। এর পেছনে পরিকল্পনা ও সঠিক পদক্ষেপের অভাব রয়েছে। কারণ সিটি কর্পোরেশনে মশা নিধন কার্যক্রমে যারা প্রধান দায়িত্ব পালন করছেন তারা কেউ কীটতত্ত্ববিদ নয়। অথচ তাদের হাতেই মশা নিধনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আবার ফগিংয়ে ২০ শতাংশ মশা মরলেও ৮০ শতাংশ উড়ে যায়। ফগিং ভুল পদ্ধতি, সিটি কর্পোরেশন তা জেনেও ব্যবহার করছে। জনসচেতনার নামে পাড়া-মহল্লায় মাইকিং বাজিয়ে মিছিল করছে, এডিস মশা নিধনে এসব মিছিল কোনো কাজে আসছে না। সুতরাং সঠিক নিয়মে মশা নিধন কার্যক্রম না করায় ঢাকা থেকে সারা দেশে মশা ছড়িয়ে পড়ছে। এডিস মশার বিষয়ে গা-ছাড়া ভাব না দেখিয়ে এখনই জরুরি ব্যবস্থা নিতে হবে।

এডিস মশা দমনে ঢাকা দুই সিটি কর্পোরেশনের কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তুলছে নগরবাসী। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তে মানুষের মৃত্যু বাড়লে ওষুধ ছিটানোর কার্যক্রম বাড়িয়ে দেয় সিটি কর্পোরেশন। অভিযান চালানো হয় রাজধানীজুড়ে। এডিস মশার লার্ভা শনাক্ত করে খালি চোখে। মশার শ্রেণিবিন্যাস কিংবা লার্ভা পরীক্ষাগার নেই ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনে। উত্তরা কামারপাড়া নতুন বাজার এলাকার বাসিন্দা সজল মিয়া বলেন, নতুন বাজার থেকে কাউন্সিলরের অফিস কাছাকাছি কিন্তু তার পরেও এখানে মশক কর্মীদের স্প্রে বা ফগিং কিছ্ইু করতে দেখা যায়নি। মিরপুর পীরেরবাগ এলাকার মাইকের গলির বাসিন্দা জিহাদুর রহমান বলেন, দুই সপ্তাহ আগে এই গলিতে মশক দমন কর্মীদের স্প্রে করতে দেখা গেছে, এরপর আর কখনো খবর নেই। রাজধানীর যাত্রাবাড়ী মাতুয়াইল এলাকার একই অবস্থা। মাতুয়াইল ৬৫ নম্বর ওয়ার্ডের আয়তনের তুলনায় মশককর্মীর সংখ্যা কম। দয়াগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা আব্দুল আলীম বলেন, তাদের এলাকায় মশা দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু মশক কর্মীদের দেখা মিলছে না। ডেঙ্গু রোগী দিন দিন বাড়ছে এই এলাকায়।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. আফরোজা বলেন, মশাকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না, যে কারণে মশার কবল থেকেও নগরবাসীকে রেহাই দেওয়া যাচ্ছে না। আজকে মশা দিবস, এই দিবস উপলক্ষে আমাদের আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করা দরকার। এই দিবস উপলক্ষেও যদি আমরা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারি এবং সচেতনতা বাড়াতে পারি, তাহলেও ডেঙ্গু সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে কাজে আসত। সরকারের কাছে আমার আহ্বান থাকবে, অন্তত মশা দিবসকে কেন্দ্র করে এই বছর না হোক, আগামী বছরগুলোতে কিছু কার্যক্রম ও পরিকল্পনা হাতে নেওয়া উচিত।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের চিকিৎসক শরিফা বিনতে আজিজ আঁখি কিছুদিন আগেও চোখের সামনে জ্বলজ্বল করত, হঠাৎ ডেঙ্গু আক্রান্তে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। শুধু আঁখি নয়, প্রতিদিন কোনো না কোনো মায়ের সন্তান ডেঙ্গু জ্বরে মারা যাচ্ছে। এতে চলতি বছরে এ পর্যন্ত ডেঙ্গু জ্বরে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৬৬ জনে। সরকারি হিসাবে এ বছরে এখন পর্যন্ত ৯৭ হাজার ৮৬০ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ডেঙ্গু রোগীর চাপ বাড়ছে হাসপাতালগুলোতে। হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। অনেক ডেঙ্গু রোগী বাসায় থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন, তাদের হিসাব স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে নেই।

রাজধানীতে বৃষ্টি বাড়ায় যত্রতত্র পানি জমে থাকায় এডিস মশার প্রজনন বেড়ে যায়। ফলে জুলাই-আগস্টে ডেঙ্গু জ্বরে সর্বোচ্চ মানুষের আক্রান্ত ও মৃত্যু ঘটছে। অথচ দক্ষিণ-উত্তর সিটি করপোরেশন এডিস মশার উপদ্রব কমাতে এবং মশার বংশবৃদ্ধি ঠেকাতে চিরুনী অভিযানসহ নানা পদক্ষেপ নিলেও আদৌ কোনো সুফল পাচ্ছে না নগরবাসী। প্রতিদিন দুই সিটির মশক নিধন কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ এডিস মশার লার্ভা পাওয়া বাড়িগুলোকে ‘রেডমার্ক’ করে দিলেও ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা কমেনি।

ঢাকা দুই সিটি কর্পোরেশনের এডিস মশা নিয়ন্ত্রণের কার্যক্রম ফলপ্রসূ হয়নি এমন মন্তব্য করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক ডা. বেনজির আহমেদ বলেন, এডিস মশা নিধনে একটি-দুটি এলাকা পরিদর্শন করে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে না। এজন্য জনসম্পৃক্ততা দরকার। ভবন মালিকদের এবং ওয়ার্ডবাসীদের সমন্বয়ে কমিটি করে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কাজ করতে হবে। বে-নজির আহমেদ আরও বলেন, কোনো দেশে এডিস মশা একবার ঢুকলে তা একেবারে উধাও করা সম্ভব নয়, তবে আমাদের কাজের মাধ্যমে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে ডেঙ্গুর সংক্রমণ বেড়ে যাচ্ছে। সারা দেশের পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের নিয়মিত ডেঙ্গু বিষয়ক প্রতিবেদনে গতকাল বলা হয়, গত চব্বিশ ঘণ্টায় সারাদেশে ডেঙ্গু জ্বরে ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৮ জন এবং ঢাকার বাইরের ৫ জন। এ নিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৬৬ জনে।

এছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় এক হাজার ৯৮৩ জন ডেঙ্গুরোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১৯ আগস্ট পর্যন্ত সারা দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন মোট ৯৭ হাজার ৮৬০ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৪৭ হাজার ৬৭১ জন। আর ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হয়েছেন ৫০ হাজার ১৮৯ জন। এছাড়া এখন পর্যন্ত হাসপাতাল থেকে মোট ছাড়পত্র পেয়েছেন ৮৯ হাজার ৪৯৯ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৪৩ হাজার ৬২৯ জন এবং ঢাকার বাইরের ৪৫ হাজার ৮৭০ জন। এর আগে ২০২২ সালে ডেঙ্গুতে ২৮১ জন মারা যান। ওই বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে ডেঙ্গুতে ২৭ জনের মৃত্যু হয়। একই সঙ্গে আলোচ্য বছরে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ৬২ হাজার ৩৮২ জন। ২০২০ সালে করোনা মহামারিকালে ডেঙ্গু সংক্রমণ তেমন একটা দেখা না গেলেও ২০২১ সালে সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হন ২৮ হাজার ৪২৯ জন। একই বছর দেশব্যাপী ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ১০৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা আগেভাগেই বলেছিলেন- এ বছর সম্মিলিতভাবে পদক্ষেপ নেওয়া না হলে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। বিশেষজ্ঞদের এমন সতর্ক বার্তার পরও মশা নিধনে খুব বেশি পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি দক্ষিণ-উত্তর সিটি কর্পোরেশনের। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা (অ. দা.) ডা. ফজলে শামসুল কবির বলেন, লার্ভা এডিসের হোক আর কিউলেক্সের হোক, বাড়ির ভেতরে লার্ভা থাকা মানে বাড়ির ভেতরে পানি জমিয়ে রেখেছে। এটা একটা অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। বাড়ির ভেতর পানি পরিষ্কারের দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনের নয়। নাগরিককে নিজ দায়িত্বে নিজের বাড়িতে জমে থাকা পানি পরিষ্কার করতে হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত