বেওয়ারিশ কুকুর আতঙ্ক

প্রকাশ : ২৪ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

সাড়ে ৩ বছরের শিশু আল আমিন বাসার সামনে খালি জায়গায় খেলার সময় বেওয়ারিশ কুকুর তার ঘাড়ে ও কানে কামড় দেয়। চিৎকার শুনে তাকে উদ্ধার করে প্রথমে মুগদা হাসপাতালে নেওয়া হয়। অবস্থা গুরুত্ব হওয়ায় তাকে ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আল আমিনকে আর বাঁচানো সম্ভব হয়নি। ঘটনাটি রাজধানীর মান্ডার প্রথম গলিতে ঘটে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার তথ্য মতে, জলাতঙ্ক রোগের হার কমলেও প্রত্যেক বছরে কুকুরের কামড়ে প্রায় ২ লাখ মানুষ আহত হয়, যাদের বেশিরভাগই শিশু। স্বাস্থ্য বিভাগ গত একদশক ধরে জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল নিয়ে কাজ করছে, কিন্তু বেওয়ারিশ কুকুড়ের কারণে জলাতঙ্ক নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছে না। তবে রাজধানীজুড়ে বেওয়ারিশ কুকুরের সংখ্যা কত, এর সঠিক কোনো তথ্য নেই সংস্থাগুলোর কাছে।

গত বছর ঢাকা ও ঢাকার আশপাশের এলাকা থেকে কুকুর, বিড়াল, বানর ও বেজিসহ বিভিন্ন প্রাণীর কামড় বা আঁচড়ে আক্রান্ত হয়ে সংক্রামকব্যাধি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন ৫৫ হাজারের কাছাকাছি মানুষ। এর মধ্যে শুধু কুকুরের কামড়ে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন প্রায় ৩৮ হাজার মানুষ।

জানা গেছে, কুকুর নিধন বন্ধ থাকলেও বন্ধ্যত্বকরণ কর্মসূচি চোখে পড়ছে না। কারণ, সিটি করপোরেশনে কুকুর বন্ধ্যত্বকরণ কর্মসূচি চালানোর মতো পর্যাপ্ত লোকবল ও ব্যবস্থা নেই। সেজন্য কুকুরের কামড় থেকে মানুষকে রক্ষা করতে গিয়ে সিটি করপোরেশন রীতিমতো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। ফলে রাজধানীতে বেওয়ারিশ কুকুরের সংখ্যা বাড়ছে। কুকুরের কামড়ে মারা যাওয়া শিশু আল আমিনের বাবা মো. কবির হোসেন একজন সিএনজিচালক। তিনি বলেন, কুকুরের কামড়ে আমার সন্তানের মৃত্যু হয়েছে। সেজন্য এখন কুকুর দেখলেই ভয় হয়। বাসা থেকে সকাল-বিকালে বের হলেই গলিতে কুকুর দেখি। দিনের চেয়ে এসব কুকুর রাতে বেশি ভয়ঙ্কর হয়। তিনি আরো বলেন, সিএনজি চালাতে গিয়ে দেখি- মূল সড়কের চেয়ে অলিগলিতে কুকুরের রাজত্ব বেশি। কুকুর নিয়ে এই আতঙ্কের মূল কারণ হচ্ছে আমার সন্তানের মৃত্যুর ঘটনা।

যদিও দেশে জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত হয়ে মানুষের মৃত্যু সংখ্যা গত একদশকে অনেক কমেছে, তারপরও রাজধানীর মাতুয়াইল এলাকার বাসিন্দা শেফালি বেগম বলেন, সব পাড়া-মহল্লায় দলবেঁধে কুকুর ঘুরে বেড়ায়, দেখলেই ভয় লাগে। এলাকার কুকুরগুলো অধিকাংশ সময় ঘেউ ঘেউ করে ও অনেক সময় হিংস্র হয়ে যায়। রাস্তা-ঘাট থেকে কুকুর সরানো গেলে ভালো হতো। শেফালি বেগমের চেয়ে উত্তরা কামারপাড়া এলাকার বাসিন্দা রহিমা বেগমের কুকুর নিয়ে অভিজ্ঞতাটা একটু ভিন্ন রকমের। রহিমা বলেন, আমাদের বাড়ির গলিতে ছয় থেকে সাতটি কুকুর সব সময় ঘুরাঘুরি করে। কখনই আমাদের কামড় দেয়নি। তবে আমার চাচার ছেলে গ্রাম থেকে বাসায় আসতে রাত সাড়ে ১০টা বেজে যায়। মূল সড়কে সিএনজি থেকে নেমে যখনই গলির ভেতরে প্রবেশ করে তখনই কুকুরগুলো তার পায়ে কামড় দেয়। রাজধানীসহ গ্রামাঞ্চলের প্রত্যেকটি এলাকায় অপরিচিত মানুষের জন্য কুকুর এক আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধানমন্ডির ৬ নম্বর রোডে নিজের বাসায় যাওয়ার পথে কুকুরের কামড়ে আহত হওয়ার পর নিজের ক্ষোভের কথা বলেছেন জাহিদুল হক। তিনি বলেন, হঠাৎ করে দুটি কুকুর আমার ওপর ঝাঁপিড়ে পড়ে বাঁ-পায়ে কমড় দিল। আমি ভয় পেয়ে গেছিলাম। তখন হাসপাতালও বন্ধ। রাতে বাসায় গিয়ে পায়ের ক্ষত স্থানটি ভালো করে পরিষ্কার করি। পরের দিন ভোরে সংক্রামকব্যাধি হাসপাতালে গিয়ে দেখি আমার মতো কয়েকশ’ মানুষ টিকা নিতে এসেছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলেছে, প্রত্যেক বছর সাড়ে ৩ লাখের মতো রোগীকে বিনামূল্যে জলাতঙ্কের টিকা দেয়া হচ্ছে। ফলে জলাতঙ্কে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা অনেকাংশে কমেছে। যত্রতত্র ঘুরে বেড়ানো কুকুর নিয়ে নাগরিক বিড়ম্বনা বাড়লেও কোনোভাবেই এই সংকটের সমাধান করা যাচ্ছে না।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ডা. ফজলে শামসুল কবির আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, সিটি করপোরেশন নিয়মিত কুকুর বন্ধ্যত্বকরণ ও স্থানান্তর কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে। গত ২ বছর আগে কুকুর বন্ধ্যত্বকরণ কর্মসূচি বাস্তবায়নে মাত্র একজন কর্মকর্তা ছিলেন, বর্তমানে পাঁচজন রয়েছে। তবে মাঠপর্যায়ে জনবল কম রয়েছে। আগামীতে জনবল বাড়িয়ে কুকুর বন্ধ্যত্বকরণ কর্মসূচি জোরদার করা হবে বলে জানান সিটি করপোরেশনের এ কর্মকর্তা।

এ অবস্থায় অনেকের মধ্যে ক্ষোভও আছে যে শহর এলাকায় কুকুর কেন এভাবে যত্রতত্র ঘুরে বেড়াবে। স্থপতি ও নগরবিদ ইকবাল হাবিব বলেন, উন্নত দেশের শহরগুলোতে বেওয়ারিশ কুকুর রাস্তায় চোখে পড়ে না। কিন্তু আমাদের শহরগুলোয় অসুস্থ কুকুর রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়, অনেক মানুষ রাস্তায় ঘুমায় কিংবা বস্তিতে থাকে। সেজন্য কুকুরের কামড়ে মানুষের মাঝে সংক্রামকব্যাধি ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে। কুকুর নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশনকে ব্যবস্থাপনায় আনতে হবে।

সিটি করপোরেশনের আদিম নৃশংসতায় পিটিয়ে কুকুর নিধন করার রেওয়াজ থাকলেও ২০১২ সালে উচ্চ আদালত নির্বিচার কুকুর নিধনকে অমানবিক উল্লেখ করে তা বন্ধের নির্দেশ দেন। এরপর বিকল্পব্যবস্থা হিসেবে সরকারের পক্ষ থেকে কুকুরকে বন্ধ্যা (প্রজননক্ষমতা নষ্ট করে দেয়া) করে তাদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করার ঘোষণা দেয়া হয়। আদালতের এ নিষেধাজ্ঞার পর ২০১২ সালের ১ এপ্রিল ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ‘অভয়ারণ্য’ নামের একটি বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে কুকুরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও জলাতঙ্ক প্রতিরোধ টিকা দেয়ার জন্য চুক্তি/সমঝোতা করে। ২০১৪ সালে চুক্তির/সমঝোতার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) আর মেয়াদ নবায়ন করেনি। নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় কুকুর বন্ধ্যাকরণের কর্মসূচি নেয় সিটি করপোরেশন। কুকুর নিধনে নিষেধাজ্ঞা থাকায় কুকুরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সরকারি সংস্থাগুলো যথাযথ ব্যবস্থা না নেয়ায় রাজধানীতে বেওয়ারিশ কুকুরের উপদ্রব বেড়েছে।

বেওয়ারিশ কুকুরের কামড়ে জলাতঙ্ক নিয়ে সম্প্রতি সায়েন্টিফিক রিপোর্টস জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় দাবি করা হয়েছে, আবহাওয়ার উচ্চ তাপমাত্রা এবং অতি বেগুনি রশ্মির বেশি বিকিরণে কুকুরের কামড়ের আশঙ্কা বেড়ে যায়। গবেষকরা ২০০৯ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের আটটি শহরের কুকুরের কামড়ের তথ্য বিশ্লেষণ করেছেন। এ সময়ের মধ্যে শহরগুলোতে ৭০ হাজার কুকুরের কামড়ের তথ্য পাওয়া গেছে।

গবেষকরা তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করে দেখতে পান, তীব্র গরমের দিনে কুকুরের কামড়ের ঘটনা ৪ শতাংশ, অতি বেগুনি রশ্মির বিকিরণে ১১ শতাংশ এবং ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বাড়ায় ৩ শতাংশ পর্যন্ত কুকুরের কামড় বাড়ার প্রমাণ পেয়েছে। প্রধান গবেষক ক্লাস লিনম্যান বলেন, তাপমাত্রায় পরিবর্তন হওয়ায় প্রাণীর মধ্যে উদ্বেগ বাড়ায়। তাপমাত্রা প্রাণীদের প্রতি মানুষের আচরণকেও প্রভাবিত করতে পারে। এ বিষয়ে একমত পোষণ করে স্পেনের মাদ্রিদের কমপ্লুটেন্স ইউনিভার্সিটির (ইউসিএম) ভেটেরিনারি মেডিসিন অনুষদের অধ্যাপক ও পশুর আচরণ বিশেষজ্ঞ স্টেফানিয়া পিনেদা। তিনি বলেন, তাপমাত্রার কারণে যে বিতৃষ্ণা তৈরি হয়, তা আগ্রাসনে রূপ নিতে পারে। এছাড়া আক্রমণাত্মক মনোভাব নিয়ন্ত্রিত হয় সেরোটোনিন ও ডোপামিন দ্বারা। অতি বেগুনি রশ্মির বিকিরণ ডোপামিনের মাত্রা কমিয়ে দিলে উদ্বেগের লক্ষণ তৈরি করতে পারে, যা আগ্রাসনে রূপ নিতে পারে।

অন্যদিকে গবেষক লিনম্যান বলেন, অতি বেগুনি রশ্মি মস্তিষ্কের স্ট্রাইটামে ডোপামিনের মাত্রাকে প্রভাবিত করতে পারে। মস্তিষ্কের এই অংশটি অবধারণ ও তার প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে সম্পর্কিত। বিষয়টির তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তের মতো কাজে প্ররোচিত করতে পারে। অর্থাৎ, অতি বেগুনি রশ্মি কোনো কাজের প্রতিক্রিয়ায় আগ্রাসিভাব তৈরি করতে পারে। মাদ্রিদ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান অনুষদের পশুচিকিৎসক ও গবেষক মনিকা বোয়াদা বলেন, কুকুরের কামড়ের কারণে শারীরিক ক্ষতের পাশাপাশি সংক্রমণ ও জলাতঙ্ক হতে পারে।