ঢাকা ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৯ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

শেখ হাসিনাকে শি জিনপিং

বাংলাদেশে বাইরের হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করে চীন

বাংলাদেশে বাইরের হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করে চীন

বাংলাদেশের জাতীয় সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষায় সমর্থন করে চীন। এ ছাড়া বাংলাদেশে বহিরাগত হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করে তারা। বাংলাদেশ যাতে অভ্যন্তরীণ ঐক্য ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে পারে এবং উন্নয়ন ও নতুন শক্তি সঞ্চার করতে পারে, সে বিষয়ে সমর্থন করে চীন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে এমনটা জানান চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং।

দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে ১৫তম ব্রিকস সম্মেলন চলাকালে স্থানীয় সময় বুধবার সন্ধ্যায় শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে হোটেল হিলটন স্যান্ডটনে শি জিনপিং ও শেখ হাসিনার মধ্যে দ্বিপক্ষীয় এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

ঢাকা ও বেইজিংয়ের মধ্যে উচ্চমানের বেল্ট অ্যান্ড রোড সহযোগিতা এবং অর্থনৈতিক পরিপূরকতাকে পূর্ণাঙ্গ করার আহ্বান জানিয়েছেন শি জিনপিং। এ সময় অবকাঠামো, তথ্যপ্রযুক্তি, নতুন শক্তি ও কৃষিসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়াতে উভয় পক্ষকে আহ্বান জানান জিনপিং। শি জিনপিং বলেন, বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে ঐতিহ্যগত বন্ধুত্ব রয়েছে। দুই পক্ষ ২০১৬ সালে সম্পর্ককে কৌশলগত সহযোগিতামূলক অংশীদারত্বে উন্নীত করেছে। বিষয়টি দুই দেশের সহযোগিতাকে আরো গভীর করার দিকটিকে নির্দেশ করে। বর্তমানে চীন-বাংলাদেশ উভয়েই নিজস্ব উন্নয়ন ও নতুন শক্তি সঞ্চারের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে আছে। ঠিক এ সময় চীনের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে উন্নয়ন কৌশল সমন্বয় জোরদার, বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাস্তব সহযোগিতাকে আরও গভীর করা, দ্বিপক্ষীয় কৌশলগত সহযোগিতামূলক অংশীদারত্বকে নতুন স্তরে নিয়ে যেতে আগ্রহী, যাতে দুই দেশের জনগণ উপকৃত হয়।

শি জিনপিং আরো বলেন, বাংলাদেশের জাতীয় সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষায় সমর্থন করে চীন। এ ছাড়া বাংলাদেশে বহিরাগত হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করে দেশটি। বাংলাদেশ যাতে অভ্যন্তরীণ ঐক্য ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে পারে এবং উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবন অর্জন করতে পারে, সে বিষয়ে সমর্থন করে তার দেশ। কৌশলগত যোগাযোগের বিষয়ে জিনপিং বলেন, নিজ নিজ স্বার্থ জড়িত ইস্যুতে একে অন্যকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করার জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ চালিয়ে যেতে ইচ্ছুক বেইজিং। দুপক্ষের উচিত বিভিন্ন বিভাগ এবং বিভিন্ন স্তরের মধ্যে কৌশলগত যোগাযোগ ও ঘনিষ্ঠ আদান-প্রদান জোরদার করা। এ ছাড়া দুই দেশের দক্ষ কর্মী বিনিময়ের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক বন্ধনেরও আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

ব্রিকসের নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকে বাংলাদেশের যোগদানের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়ে শি বলেন, চীন বাংলাদেশের সঙ্গে বহুপক্ষীয় বিষয়ে সমন্বয় ও সহযোগিতা জোরদার করতে এবং আন্তর্জাতিক সমতা ও ন্যায়বিচারের পাশাপাশি উন্নয়নশীল দেশগুলোর স্বার্থ রক্ষা করতে ইচ্ছুক।

বৈঠকে শেখ হাসিনা বলেন, ২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশে সফর দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক হয়ে উঠেছিল। এ সময় কোভিড-১৯ মহামারির বিরুদ্ধে লড়াই ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়তা দিয়ে চীন যে বাংলাদেশের উন্নয়ন এবং মানুষের জীবনযাত্রার উন্নতিতে সাহায্য করেছে, তারও প্রশংসা করেন প্রধানমন্ত্রী।

শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ-চীনের সুসম্পর্ক পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং একে অন্যের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। তিনি বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের দশমবার্ষিকীতে শি জিনপিংকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড কো-অপারেশন’ বাংলাদেশের জন্য উন্নয়নের একটি নতুন দ্বার উন্মোচন করেছে।

বাংলাদেশ দৃঢ়ভাবে এক চীন-নীতি মেনে চলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা বৃদ্ধিতে চীনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা প্রশংসার দাবিদার। বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করতে এবং ব্রিকসের মতো বহুপক্ষীয় ব্যবস্থায় সহযোগিতা জোরদার করতে প্রস্তুত বলে আশ্বস্ত করেন তিনি। ব্রিকস উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য নতুন উন্নয়নের সুযোগ নিয়ে আসবে বলে উল্লেখ করেন শেখ হাসিনা।

বাংলাদেশে রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধান করতে চীন সব সময় বাংলাদেশের পাশে থাকবে বলে জানান প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। পরে পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন।

রোহিঙ্গা সংকট বিষয়ে চীনা প্রেসিডেন্ট বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানে বাংলাদেশকে সহায়তা করবে চীন। আমরা এই অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা চাই না। পররাষ্ট্র মন্ত্রী মোমেন বলেন, শি জিনপিং চীন, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের ত্রিপক্ষীয় সম্পৃক্ততার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করতে চান। একে আব্দুল মোমেন জানান, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তার সরকার রোহিঙ্গাদের তাদের মাতৃভূমিতে প্রত্যাবাসন করতে চায় কারণ, তারা এই অঞ্চলের শান্তির জন্য হুমকি হয়ে উঠছে। কারণ, তাদের মধ্যে অনেকেই অবৈধ মাদক ও অস্ত্র ব্যবসায় জড়িয়ে গেছে।

বাংলাদেশের জ্বালানি, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও অবকাঠামো উন্নয়নে সহায়তা করতে তার দেশের আগ্রহের কথা জানান চীনা প্রেসিডেন্ট। শি জিনপিং বাংলাদেশকে উন্নত-সমৃদ্ধ সোনার বাংলায় পরিণত করতে সহযোগিতার ও আশ্বাস দেন। চীনের প্রেসিডেন্ট বলেন, একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ ‘সোনার বাংলা’ গড়ার স্বপ্নকে সম্ভাব্য দ্রুততম সময়ে বাস্তবায়িত করতে চীন আপনাকে সাহায্য করবে। প্রধানমন্ত্রী চীনা অর্থায়নে পরিচালিত কিছু প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়নে শি জিনপিংয়ের সহায়তা চেয়েছেন যা এখন তহবিল সংকটের জন্য আটকে রয়েছে। চীনা প্রেসিডেন্ট বিষয়টি খতিয়ে দেখার আশ্বাস দেন।

বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর ওপর জোর দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ বর্তমানে প্রতি বছর প্রায় ২ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের চীনা পণ্য আমদানি করেছে, যেখানে চীন মাত্র ৭০ কোটি মার্কিন ডলারের বাংলাদেশি পণ্য আমদানি করেছে। চীনের প্রেসিডেন্ট আশ্বস্ত করেন চীন-বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্যিক ঘাটতি হ্রাস করার উদ্যোগ নেবেন। শি জিনপিং জানান, চীনের বাজারে ৯৮ শতাংশ বাংলাদেশি পণ্যে শুল্ক ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়েছে।

শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশে কিছু চীনা বিনিয়োগ এলে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে বাণিজ্য ব্যবধান কমবে। তিনি ২ দেশের মধ্যে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি (পিটিএ) স্বাক্ষরের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন। জবাবে চীনা প্রেসিডেন্ট বলেন, আমরা দেশগুলোর মধ্যে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য দ্রুত ব্যবস্থা নেব।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ চীনে তাজা ফল যেমন আম, কাঁঠাল, পেয়ারা, তাজা শাক-সবজি এবং গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগির খাদ্য রপ্তানি করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। মোমেন বলেন, শি জিনপিং এসব বিষয় নিয়ে অবশ্যই বিবেচনা করার আশ্বাস দিয়েছেন।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী আগামী অক্টোবরে পদ্মা রেল সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান প্রত্যক্ষ করতে চীনের প্রেসিডেন্টকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।

জবাবে চীনা প্রেসিডেন্ট বলেন, আমি অবশ্যই আপনার দেশে আসব। তবে দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সফরের সময় নির্ধারণ করা হবে। মোমেন জানান, শি জিনপিং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকেও চীন সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।

জবাবে শেখ হাসিনা বলেছেন, তিনি চীন সফর করবেন, তবে সময় লাগতে পারে কারণ, জাতীয় নির্বাচন দরজায় কড়া নাড়ছে। তিনি নির্বাচনি প্রচারে ব্যস্ত থাকবেন। এদিকে শেখ হাসিনা চীনের প্রেসিডেন্টকে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের চীনে পড়াশোনার সুযোগ বাড়ানোর আহ্বান জানান এবং শি জিনপিং বিষয়টি দেখবেন বলে আশ্বাস দেন।

বৈঠকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান ফজলুর রহমান, প্রধানমন্ত্রীর কন্যা ও ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের বিষয়ভিত্তিক অ্যাম্বাসেডর এবং অটিজম ও নিউরোডেভেলপমেন্টাল ডিসঅর্ডারবিষয়ক জাতীয় উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারপারসন সায়মা ওয়াজেদ, প্রধানমন্ত্রীর মূখ্য সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মাসুদ বিন মোমেন উপস্থিত ছিলেন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত