ঢাকা ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৯ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বিএনপিতে মামলা-সাজা আতঙ্ক

বিএনপিতে মামলা-সাজা আতঙ্ক

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর মাত্র কয়েক মাস বাকি আছে। আসন্ন এই জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে আবারও মামলা ও সাজা আতঙ্কে পড়েছে বিএনপি। নতুন-পুরাতন মিলিয়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা আছে ১ লাখ ৩৮ হাজার ৭১৯টি। এসব মামলার আসামি ৪১ লাখ, ৭১ হাজার ৩৫৯ জন। যদিও অজ্ঞাতনামা আসামি আরো কয়েকগুণ বেশি। এরই মধ্যে ৫ শতাধিক নেতার মামলা শেষ পর্যায়ে পৌঁছেছে এবং তিন শতাধিক মামলা রায়ের অপেক্ষায় রয়েছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই দলের গুরুত্বপূর্ণ অনেক নেতাকে মিথ্যা মামলায় সাজা দেওয়া হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে বিএনপি। দলটির নীতিনির্ধারকদের মতে, সরকারের পরিকল্পনার মধ্যে আছে বিরোধী দলের শীর্ষ নেতাদের মিথ্যা মামলায় সাজা দিয়ে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা ও আটকে রাখা, যাতে তারা কেউ নির্বাচনে অংশ নিতে না পারেন। অর্থাৎ বিএনপিকে নেতৃত্বশূন্য করে নিজেদের ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করাটাই সরকারের একমাত্র উদ্দেশ্য। কিন্তু এবার আর সরকারের এ ইচ্ছা কখনোই পূরণ হবে না। জনগণ জেগে উঠেছে বলে মনে করছে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব। দলটির একাধিক বিশ্বস্ত সূত্র থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। বিএনপির সিনিয়র নেতৃবৃন্দ বলেন, বিএনপিকে নেতৃত্বশূন্য করার ব্যাপারে সরকারের এই মহাপরিকল্পনা আগে থেকেই রয়েছে। একটা মিথ্যা ও বানোয়াট মামলায় আদালতের মাধ্যমে ফরমায়েশি রায় ও সাজা দিয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে বন্দি করে রেখেছে। তাকে বিদেশ চিকিৎসার জন্য যেতে দিচ্ছে না। সম্প্রতি ঘোষিত আয়ের বাইরে সম্পদের মালিক হওয়ার মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে দুই ধারায় ৯ বছরের কারাদণ্ড ও তার স্ত্রী ড. জোবাইদা রহমানকে ৩ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত। এদিকে পুরোনো, স্থগিত ও অচল মামলাগুলো সচল করে দ্রুত রায় ও সাজা দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এছাড়া প্রতিনিয়ত নতুন মামলাও দেয়া হচ্ছে। বিএনপি নেতা ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ও আমানউল্লাহ আমানের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতের মাধ্যমে সম্প্রতি যে সাজা বহাল রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। সেটি সরকারের এই পরিকল্পনা ও ষড়যন্ত্রেরই অংশ। মামলা ও সাজা আতঙ্কের বিষয় হলে এবার কোনো লাভ হবে না। কারণ জনগণ রাস্তায় নেমে গেছে। সার্বিকভাবে ব্যর্থ এই সরকারের পতন অনিবার্য। জানা গেছে, সরকারের মামলার জালে বন্দি হয়ে পড়েছে বিএনপির অধিকাংশ নেতাকর্মী। দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া থেকে শুরু করে তৃণমূলের সক্রিয় এমন কোনো নেতা নেই, যার নামে একাধিক মামলা নেই। মামলা থেকে কেউ রেহাই পাননি।

বিএনপির তৃণমূলের কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা হলে তারা বলেন, আমাদের অধিকাংশের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা আছে। আমাদের প্রায় দিনই আদালতে হাজিরা দিতে হয়। গ্রেপ্তার, আতঙ্কে আমরা অনেক ঘরেও থাকতে পারি না। অনেক সময় পালিয়েও থাকতে হয়। এভাবে বিএনপির আন্দোলন দমাতে চায় সরকার। আমরা মামলা ও সাজার আতঙ্কে আছি ঠিকই তবে, এবার আর কাজ হবে না। জীবন বাজি রেখে হলেও এই সরকারের পতন নিশ্চিত করা হবে- ইনশাআল্লাহ।

বিএনপির কেন্দ্রীয় দফতর ও গুলশান কার্যালয় সূত্র থেকে জানা গেছে, ২০০৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ১ লাখ ৩৮ হাজার ৭১৯টি মামলা হয়েছে। এতে আসামি প্রায় ৪১ লাখ, ৭১ হাজার ৩৫৯ জন। বেশিরভাগ মামলার চার্জশিট জমা দেওয়া হয়েছে। এর সঙ্গে সচল হচ্ছে ওয়ান-ইলেভেন ও পরবর্তী সময়ে সিনিয়র নেতাদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত দুর্নীতির পুরোনো মামলা। শুরু হয়েছে বিচারকাজও।

দলীয় সূত্রমতে, ২০০৯ সাল থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত মোট মামলা দায়ের করা হয়েছে ১ লাখ ৩৮ হাজার ০৭১টি। এসব মামলার আসামি ৪১ লাখ ৪৫, হাজার ৬৭৯ জন। ২০০৯ সাল থেকে জুন ২০২৩ পর্যন্ত হত্যা করা হয় ১ হাজার ৫৩৯ জনকে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নির্যাতনে হত্যা করা হয় ৭৯৯ জনকে। গুম হয়েছেন ৭৮১ জন। গত ২৯ জুলাই ঢাকা অবস্থান কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ১২৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ওইদিন প্রায় ৫০০ জন আহত হয়। এছাড়া গত ১৯ মে থেকে কর্মসূচি কেন্দ্র করে ৩২০টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এসব মামলায় আসামি করা হয় আসামি প্রায় ১০ হাজার ৪৫০ জনকে। গ্রেপ্তার করা হয় ১ হাজার ৫১৪ জনকে। এছাড়া গত ২৮ ও ২৯ জুলাই হতে অদ্যাবধি বিএনপির কেন্দ্র ঘোষিত কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সারাদেশের প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ৩২৪টি মামলায় ১৩ হাজার ১১৫ জনকে আসামি করা হয়। গ্রেপ্তার করা হয় ১ হাজার ৫২১ জনকে। আহত হয় ১২০০ জন।

এদিকে হাইকোর্টের জামিনের আদেশ অমান্য করে নিম্ন-আদালতের মাধ্যমে কারান্তরিন রাখা হচ্ছে বিএনপি নেতাকর্মীদের। এসব মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ করে দ্রুত রায় দেওয়া হতে পারে বলে আশঙ্কা দলটির নেতা ও আইনজীবীদের।

সম্প্রতি বিচারিক আদালতে দেওয়া সাবেক দুই মন্ত্রীর ১৩ ও ৯ বছরের সাজা উচ্চ আদালত বহাল রাখায় নেতাকর্মীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে কিছুটা ভীতি ও আশঙ্কা। এরও আগে একই প্রক্রিয়ায় বিএনপির কেন্দ্রীয় প্রকাশনাবিষয়ক সম্পাদক ও সাবেক এমপি হাবিবুল ইসলাম হাবিবকে সাজা দেওয়া হয়েছে।

জানা যায়, রাতেও সাক্ষ্য নেওয়ার নজির স্থাপন করছেন আদালত। অথচ ওয়ান-ইলেভেনের সময় একই ধরনের মামলায় আওয়ামী লীগ নেতাদের খালাস দেওয়া হয়েছে। ওয়ান-ইলেভেনে দায়ের করা মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে কারাবরণ করেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় আদালত তাকে ৫ বছরের কারাদণ্ড দেন। ওই বছর ৩০ অক্টোবর হাইকোর্ট এই সাজা বাড়িয়ে ১০ বছর করেন। আর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় সাজা হয়েছে ৭ বছর। ২ বছরের বেশি কারাভোগের পর সরকারের নির্বাহী আদেশে মুক্তি পান। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও দণ্ডপ্রাপ্ত।

বিএনপি নেতাদের ধারণা, জাতীয় নির্বাচনের আগে অনেক মামলার রায় দেওয়া হতে পারে। তাতে সাজা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। মামলার মেরিট নিয়ে নানা প্রশ্ন থাকলেও আদালত একটা রায় ঘোষণা করে ফেলার পরে তা অমান্য করার সুযোগ থাকে না। তবে দলটির নীতিনির্ধারকদের দাবি, নির্বাচন সামনে রেখে সরকার পুরোনো খেলা শুরু করেছে। মামলা ও সাজার ভয় দেখিয়ে আন্দোলন দমাতে চাইছে। কিন্তু সেটি আর সম্ভব নয়। কারণ এবারের আন্দোলনে সাধারণ মানুষ যুক্ত হয়ে পড়েছে।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রাখতে আওয়ামী লীগ সরকার মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। প্রশাসন ও আদালতকে ব্যবহার করে সরকার ক্ষমতায় টিকে আছে। ভবিষ্যতে তা আরও দীর্ঘায়িত করার নীলনকশা তৈরি করছে। এর অংশ হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে এসব মামলা। দেড় হাজারের মতো মামলা বাছাই করে আগামী নির্বাচনের আগেই বিএনপি নেতাদের সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠাতে চায়। সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে নির্বাচনে প্রতিপক্ষ ছাড়া খালি মাঠে গোল দেওয়া সহজ হবে। তিনি আরো বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিচার বিভাগকে ব্যবহারের মাধ্যমে স্থগিত মামলাগুলো সচল করে দ্রুত শেষ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। একতরফা নির্বাচন করে পুনরায় ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে সরকার।

সারা দেশে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে কিছু পুলিশ সদস্য মামলা, গ্রেপ্তার ও হয়রানি অব্যাহত রেখেছেন বলে অভিযোগ করে মির্জা ফখরুল বলেন, প্রতিদিন পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। যেভাবেই হোক সরকার বিরোধীদলকে মাঠ থেকে সরিয়ে আবার ক্ষমতায় থাকতে চায়। এটাই তাদের একমাত্র লক্ষ্য। মির্জা ফখরুল বলেন, সরকারের নির্দেশে পুলিশ এসব করছে। আমরা বারবার বলেছি, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চলছে। বিচার বিভাগ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও অন্যান্য বাহিনী একইভাবে কাজ করছে। আমাদের কাছে তথ্য আছে, প্রয়োজনে আমরা দেখাব। বিচারপতিদের বলা হচ্ছে, দ্রুত সাজার রায় দিতে। তারা পুরো মাঠ খালি করে দিতে চায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা যায়, সরকারের মামলা-হামলার এসব কর্মকাণ্ডে উদ্বিগ্ন নয় বিএনপি। দলটির হাইকমান্ডের মনোযোগ এখন আন্দোলনের দিকে। কারণ বিএনপিতে নেতার কোনো অভাব নেই। কেন্দ্রের প্রথম সারি থেকে শুরু করে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ পর্যন্ত চার স্তরের নেতাদের দিয়ে এবার আন্দোলন ও নির্বাচনের ছক তৈরি করেছে দলটি। দলীয় হাইকমান্ডও এ ব্যাপারে যথেষ্ট আস্থাশীল রয়েছেন বলে জানা গেছে।

বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা বলেন, ওয়ান-ইলেভেন ও আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিএনপি নেতাদের নামে করা দুর্নীতির অনেক মামলা বাতিলে উচ্চ আদালতে আবেদন করেন তারা। উচ্চ আদালত অনেক মামলাই বিচারিক কার্যক্রমের ওপর স্থগিতাদেশ দেন। দীর্ঘদিন এসব মামলার বিচারকাজ বন্ধ ছিল। সেই মামলাগুলো পুনরায় সচল হচ্ছে। বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নাল আবদিন ফারুক, সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, সাবেক উপমন্ত্রী আসাদুল হাবিব দুলু, সাবেক এমপি হাফিজ ইব্রাহিমের বিরুদ্ধে করা দুর্নীতি মামলার বিচার চলবে বলে আদেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। তার মামলাটি ৬ মাসের মধ্যে নিষ্পত্তির নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

এছাড়া স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের দুর্নীতি মামলা আগেই সচল হয়েছে। বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন এ প্রসঙ্গে বলেন, বিরোধী দলকে দমনে সরকার আদালতকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। কিন্তু এসবে আর এবার কোনো কাজ হবে বলে মনে হয় না। কারণ জনগণ তাদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার হয়েছে। তিনি বলেন, সরকার আদালতে প্রভাব বিস্তার করে সিনিয়র নেতাদের সাজা দিয়ে নির্বাচনের অযোগ্য করতে চাইছে। একই সঙ্গে বিএনপির মাঠপর্যায় এবং সহযোগী সংগঠনের সক্রিয় নেতাকর্মীদের শাস্তি দিয়ে আন্দোলন স্তিমিত করার কৌশল নিয়েছে। মূলত বিএনপিকে চাপে রাখতে সরকার এসব করছে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই এখন এ মামলাগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে।

বিএনপির সহ-আইনবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট সৈয়দ জয়নাল আবেদীন মেজবাহ বলেছেন, বিরোধী দলকে দমনে সরকারের বড় অস্ত্র হচ্ছে মামলা। নিম্ন আদালতকে ব্যবহার করে সরকারবিরোধী নেতাকর্মীদের দ্রুত সাজার ভয় দেখাচ্ছে। তিনি বলেন, পাঁচ শতাধিক মামলায় চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। এসব মামলায় সিনিয়র থেকে জুনিয়র নেতারা আসামি। মামলাগুলো দ্রুত শেষ করতে ঘন ঘন তারিখ দেওয়া হচ্ছে। সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণও নেওয়া হচ্ছে দ্রুত। তিনি আরো বলেন, দ্রুত রায় দিয়ে নেতাদের সাজা দেওয়ার টার্গেট রয়েছে সরকারের। কিন্তু চেষ্টা করেও হয়তো সে লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে না। আশা করি, মানবিক দিকবিবেচনা করে বিচারকরা শেষ মুহূর্তে ভুলপথে পা দেবেন না। জোর করে সাজানো মামলায় রায় দিলে ইতিহাস সাক্ষী হয়ে থাকবে। এটা খারাপ উদাহরণ হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত