দেশি ও বিদেশি ফলে আগুন

প্রকাশ : ২৬ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

সারা দেশেই ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। সে তুলনায় রাজধানীতে এর প্রাবল্য ব্যাপক। এ রোগে আক্রান্ত রোগীদের বেশি বেশি ‘ভিটামিন-সি’ যুক্ত ফল ও এর রস খেতে পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা। কিন্তু ফলের বাজারে আগুন লেগেছে। গতকাল শুক্রবার রাজধানীর দেশি-বিদেশি ফলের দাম জানতে রাজধানীর কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেল, বিদেশি ফলের দাম চলে গেছে নাগালের বাইরে; দেশি ফল কিনতেও কষ্ট হচ্ছে ভোক্তাদের। রাজধানীর কারওয়ান বাজারে কথা হয় নানা ক্রেতা-বিক্রেতার সঙ্গে। দুই পক্ষই ফলের দাম নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছে। আবার দাম বেশির কারণ নিয়ে সাফাই গেয়েছেন কয়েকজন। গতকাল কারওয়ান বাজারে আকার ও মানভেদে প্রতি কেজি মাল্টা বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৩২০ টাকায়। আনার ৩০০ থেকে ৪২০; সবুজ আপেল ৪২০; গালা আপেল ২৫০ থেকে ৩২০; ফুজি আপেল ৩০০; কমলা ২৮০ থেকে ৩০০; নাশপাতি ৩০০ থেকে ৩৩০; লাল আঙুর ৪০০ থেকে ৪৫০; ড্রাগন ফল ৩০০ থেকে ৩৫০; রম্বুটান ১০০০ ও কিউই ফল বিক্রি হচ্ছে ১০০০ টাকা কেজি দরে। দেশি ফলের মধ্যে আকার ও মানভেদে প্রতি কেজি কালো তরমুজ ৭০ টাকা, সবুজ তরমুজ ৫০ থেকে ৬০; পেঁপে ১০০ থেকে ১২০; আম্রপালি ২০০ থেকে ২৮০; বারি-৪ আম ২৮০; গৌড়মতি আম ২০০; ঝিনুক আম ১২০; সুরমা ফজলি ১৩০; আমড়া ৭০ থেকে ৮০; আমলকী ১০০; পেয়ারা ৮০; দেশি মাল্টা ৮০; লটকন ১৫০; আতা ৩০০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া প্রতি পিস আনারস ৩০ থেকে ৬০ টাকা, জাম্বুরা ৬০ থেকে ১৫০; বেল ৫০; তাল ৪০ থেকে ৫০; কাঁঠাল ৩০০ থেকে ৭০০; প্রতি ডজন সাগর কলা ১০০; বাংলা কলা ৯০; সবরি কলা ১২০; চিনি চম্পা কলা ৭৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

বিক্রেতারা জানান, গত এক মাসের মধ্যে বিদেশি ফলের দাম ২০ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। ফল আমদানিতে সরকার বাড়তি শুল্ক আরোপ করায় বাজারে সরবরাহ কমেছে। এতে দামও বেড়ে গেছে। সিজন না হওয়ার কারণেও দাম কিছুটা বেশি।

দেশে ডলার সংকট দেখা দেওয়ায় গত বছরের ২৩ মে ফল আমদানি নিরুৎসাহিত করতে ২০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক আরোপ করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। পরে ফল আমদানিতে ঋণসুবিধাও বন্ধ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। সরকার ফল আমদানিতে যে ক্ষেত্রগুলোয় শুল্ক আরোপ করে সেগুলো মূলত নিয়ন্ত্রণ; কাস্টমস ডিউটি (সিডি); ভ্যাট; অগ্রিম আয়কর ও অ্যাডভান্স ট্রেড ভ্যাটের ওপর। বাজারে এর প্রভাব পড়ায় বিদেশি ফল আমদানি কমে যায়।

কারওয়ান বাজারের মদিনা ফ্রুটস গ্যালারির বিক্রেতা মো. মহসিন বলেন, ফল আমদানিতে এখন খরচ অনেক বেশি। তাই ফলের দামও বেশি। এখন বিদেশি ফলের আমদানি ও সরবরাহ কম। জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত আপেলের মতো বিদেশি ফল তেমন আসে না। এ সময় আগের মজুদ করা ফল আসে। ফেব্রুয়ারি পর থেকে আবার আপেল আসা শুরু হলে দাম কমবে।

আল্লাহর দান ফল বিতানের বিক্রেতা হারুনুর রশিদ বলেন, এখন বিদেশি ফলের সিজন শেষ; সরবরাহও কম। যারা আগে ফল মজুদ করেছে, তারা তাদের ইচ্ছেমতো দাম রাখছে। গত মাসে আমাদানিকারকদের কাছ থেকে ১৮ কেজির এক ক্যারট সবুজ আপেল কিনেছি ৪ হাজার ৫০০ টাকায়। গত বৃহস্পতিবার সেই একই ক্যারট কিনতে হয়েছে ৭ হাজার ৫০০ টাকায়। তাহলে আমরা কম দামে কীভাবে বিক্রি করবো। দাম বাড়ার প্রকৃত কারণ আমদানিকারকরা বলতে পারবে।

নবীন হোসেন নামে আরেক বিক্রেতা বলেন, এখন মানুষের বিভিন্ন অসুখ হচ্ছে। যার কারণে মাল্টার চাহিদা বেশি। অথচ এই ফলের দামই সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। সাড়ে ১৪ কেজির এক পেটি মাল্টা এক সপ্তাহ আগেও ৩ হাজার ২০০ টাকায় কিনেছি। আজ কিনতে হয়েছে ৪ হাজার ৫০০ টাকায়। আমরা সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করে দাম কম রাখার চেষ্টা করি। কষ্ট হয়ে যায়; কিন্তু গরিব মানুষের কথাও তো চিন্তা করতে হয়।

শুধু ফল নয়, দাম বেড়েছে খেজুর ও বাদামেরও। বর্তমানে প্রতি কেজি ইরানি মরিয়ম খেজুর ৯০০ টাকা, কালমী মরিয়ম ১০০০; সৌদি মাবরুম ১২০০; মেডজুল ১৫০০; আজোয়া ১০০০; দাবাস ৫০০; বড়ই খেজুর ৪৫০; জিহাদী খেজুর ২৫০ ও খুরমা খেজুর ৪৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া ভাজা বাদাম ২৮০; মিক্স বাদাম ৬৫০; আখরোট বাদাম ১০০০ থেকে ১২০০; কাঠ বাদাম ৯০০; ভাজা কাজু বাদাম ১৫০০; কাজু বাদাম ১৪০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বিক্রমপুর ফল বিতানের বিক্রেতা মোহাম্মদ বলেন, গত এক মাসে খেজুর ও বাদামের দাম ২০-৩০ টাকা বেড়েছে। বাজেটে নতুন করে খেজুরের ওপর ট্যাক্স বসানোয় দাম বাড়ছে। ডেঙ্গুসহ বিভিন্ন রোগে রোগীদের বাড়তি পুষ্টির জন্য ফল খাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু আকাশছোঁয়া দামের কারণে তারা সেটি পারছেন না। সাধারণ ক্রেতাদের মতে, বিদেশি ফল তাদের সামর্থ্যরে বাইরে চলে গেছে। দেশি ফল কিনতেও খুব একটা স্বস্তি পাচ্ছেন না।

ওবায়দুল ইসলাম নামে বেসরকারি এক চাকরিজীবী বলেন, অন্যান্য পণ্যের মতো ফলও আমাদের ক্রয়সীমার বাইরে চলে যাচ্ছে। পরিবারের পুষ্টির কথা চিন্তা করে মাঝে মাঝে অল্প পরিমাণে কিনতে হচ্ছে। অনেকদিন পর হাফ কেজি আঙুর কিনেছি। শুধু বিদেশি বা দেশি ফল নয়, বাজারে সব জিনিসের দামই বেশি। দামের কোনোটিতেই হাত দেওয়া যায় না। অথচ আমাদের বেতন আগের মতোই আছে।

দিন আনেন, দিন খান ফারুক। ছোট ছেলে অসুস্থ; তাকে ডাক্তার দেখিয়েছেন। চিকিৎসক বলেছেন ছেলেকে বেশি বেশি ভিটামিন-সিযুক্ত ফল খাওয়াতে। কারওয়ান বাজারে তিনি ফল কিনতে এসে যে দাম শুনেছেন, চার-পাঁচদিন কাজ করেও সেটির জোগান দিতে পারবেন না। তাই বাধ্য হয়ে কম দামে বাসি ফল কিনেছেন। ৪০ টাকায় জাম্বুরা কিনেছেন, তার অর্ধেকে প্রায় পচন ধরেছে। গায়ে দাগওয়ালা নরম মাল্টা নিয়েছেন হাফ কেজি ১২০ টাকায়। দেশি মাল্টা অবশ্য নিয়েছেন এক কেজি।

রাকিব হোসেন নামে আরেক ক্রেতা বলেন, বাচ্চাদের পুষ্টির জন্য ফল অনেক দরকারি একটি পণ্য। এ বাজারে যেন আগুন জ্বলছে। যে ফলেই হাত দিই- কয়েকবার চিন্তা করতে হয় কিনবো কি কিনবো কিনা। এক কেজি আপেলের দাম চাইছে ৩৫০ টাকা। বিক্রেতারা বলছেন, দাম কম হবে না। নিলে নেন, না নিলে হাত দেবেন না। এত দাম দিয়ে ফল খাওয়ার সামর্থ্য কয়জনের আছে? দেশি ফলের দাম তুলনামূলক কম হলেও সেটাও অস্বাভাবিক।