ঢাকা ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৯ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মিয়ানমারে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন

অধরাই থাকছে সমাধানের স্বপ্ন

জোরাল নয় পারস্পরিক যোগাযোগ, নেই কূটনৈতিক চাপও
অধরাই থাকছে সমাধানের স্বপ্ন

বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার স্বপ্ন যেন অধরাই থেকে যাচ্ছে। বাংলাদেশে আসার ৬ বছর পরও একজন রোহিঙ্গাকেও তাদের দেশে পাঠানো সম্ভব হয়নি। নিকট ভবিষ্যতে তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো যাবে কিনা, তা নিয়েও জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। তবে অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকার এমন পারস্পরিক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি, যাতে করে এই সম্পর্ক কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ মিয়ানমারের ওপর রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে চাপ সৃষ্টি করতে পারে। এদিকে ভূরাজনৈতিক অবস্থানের কারণে মিয়ানমারের প্রতি প্রভাবশালী রাষ্ট্র চীন যথেষ্ট সহানুভূতিশীল। এ ছাড়া রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার ব্যাপারে আমাদের আশপাশের দেশগুলোও মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারছে না। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে থাকা অবস্থায় যেভাবে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিল বাংলাদেশে আসার পরও তারা একইপথে হাঁটছে। সে কারণে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গারাদের দেশে ফিরিয়ে নিয়ে বাড়তি ঝামেলা পোহাতে চায় না। মূলত এসব কারণেই আটকে আছে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরে যাওয়া। মানবিক কারণে বলপ্রয়োগে বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিক রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দেওয়ার ছয় বছর পূর্ণ গত হলো ২৫ আগস্ট। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিয়েও কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে নানামুখী সংকটে পড়েছে বাংলাদেশ। দিনে দিনে তারা নানা অপরাধে জড়িত হয়ে পড়েছে। পরিবেশের ক্ষতি তো করছেই। এছাড়া মানুষ, মাদক ও অস্ত্র পাচার, ডাকাতি, অপহরণ ও খুনোখুনির মতো অপরাধ করছে নিত্যদিন। তাছাড়া রোহিঙ্গাদের অনিয়ন্ত্রিত জন্মহার অন্যতম উদ্বেগের কারণ। প্রতিদিনই বাড়ছে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা। অন্যদিকে বৈদেশিক সাহায্যও কমে আসছে। সংঘাত ও নাশকতা এড়াতে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনারের (ইউএনএইচসিআর) কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর থেকে ৭ লাখ ৪১ হাজার ৮৪১ জন রোহিঙ্গা নাগরিক বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। বর্তমানে বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা জনসংখ্যা ৯ লাখ ৬২ হাজার ৪১৬ জন। কক্সবাজারের ৩৩টি ক্যাম্পে ৯ লাখ ৩১ হাজার ৯৬০ জন রোহিঙ্গা নাগরিক অবস্থান করছেন। ভাসানচরে অবস্থান করছেন ৩০ হাজার ৪৫৬ জন রোহিঙ্গা নাগরিক। আশ্রয়প্রার্থীদের মধ্যে বছরে নতুন জন্ম নেওয়া শিশুর হার ২৪ হাজার ৯৩০ জন। প্রতি বছরে গর্ভবতী নারীর সংখ্যা ২৪ হাজার ৫৩২ জন। মোট আশ্রয়প্রার্থী রোহিঙ্গা জনসংখ্যার ৫২ শতাংশ হচ্ছে শিশু। যাদের বয়স ১৮ বছরের নিচে। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন কবে হবে জানে না কেউ। তবে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ সরকার বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। এজন্য কয়েকটি ট্রানজিট ক্যাম্প বা সেন্টার স্থাপনের কাজও চালিয়ে যাচ্ছে। বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুমে একটি, টেকনাফের কেরণতলীতে প্রত্যাবাসন ঘাটের জেটি পুনর্নির্মাণসহ উপজেলার জাদিমুরাতে প্রত্যাবাসন সেন্টার ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার তমব্রুতে প্রত্যাবাসন সেন্টার নির্মাণের প্রক্রিয়া চলছে। এসব ক্যাম্প স্থাপনের জন্য এরই মধ্যে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। সরকারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মিজানুর রহমান জানিয়েছেন, রোহিঙ্গাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ সরকার কাজ করে যাচ্ছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, কক্সবাজারের উখিয়া ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি থানার ঘুমধুম সীমান্তবর্তী কোনাপাড়া এলাকার নো ম্যানস ল্যান্ডে রোহিঙ্গাদের যে অস্থায়ী বসবাস ছিল সেখানকার অনেক রোহিঙ্গা পরিবারই অন্যত্র চলে গেছে। রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা প্রতিপক্ষের বসবাসের ঘরে আগুন দিয়ে ঘুমধুম চলে যায়। কোনাপাড়া ক্যাম্পের নো ম্যানস ল্যান্ডে কোনো রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী যাতে অপতৎপরতা চালাতে না পারে সেদিকেও নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। একইসঙ্গে এপিবিএন-এর ১৭ ব্যাটালিয়ন গঠন ও রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর নিরাপত্তায় দায়িত্বরত ১৪ ও ১৬ ব্যাটালিয়নকে দ্রুত সংস্কারের কথা বলা হয়েছে। ১৭ এপিবিএন কাজ করবে ভাসানচরে। এ ব্যাটালিয়নের জন্য ৮৫০টি পদ সৃষ্টির জন্যেও পুলিশ সদর দপ্তর থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে। নতুন করে যাতে আর মিয়ানমার নাগরিক বা রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে না পারে- সেজন্য কক্সবাজার, বান্দরবান ও মিয়ানমার সীমান্তের বিজিবির আউট পোস্ট ও বিওপিগুলোতে জনবল বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনেও সরকার নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। তাদের প্রত্যাবাসনই সব সংকটের সমাধান হতে পারে। তিন দফায় রেশন কমিয়ে দেওয়ায় হতাশায় নানা রকম অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়াচ্ছেন। রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসার ছয় বছর পরও কূটনৈতিক জটিলতায় আটকে আছে প্রত্যাবাসন। যদিও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে ২০১৭ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করেছিল মিয়ানমার সরকার। কিন্তু সেই প্রত্যাবাসন আজো শুরু হয়নি। এতে দীর্ঘ হচ্ছে রোহিঙ্গা সংকট। এরই মধ্যে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দিন দিন বাড়ছে অস্থিরতা। সেইসঙ্গে বাড়ছে হত্যাকাণ্ড ও অন্যান্য অপরাধ। সবমিলিয়ে দীর্ঘ অনিশ্চয়তায় আতঙ্কে আছেন তারা। পাশাপাশি তিন দফায় রেশন কমিয়ে দেওয়ায় হতাশায় নানা রকম অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়াচ্ছেন তারা। রোহিঙ্গা নেতারা বলছেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মিয়ানমারের ওপর চাপ দিতে ব্যর্থ হওয়ায় রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। রোহিঙ্গারা তাদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ধীরে ধীরে চট্টগ্রাম শহর ছাড়িয়ে দেশের বিভিন্ন শহর এলকায় ঢুকে পড়ছে। তাদেরকে ক্যাম্পের মধ্যে আটকে রাখা যাচ্ছেনা। প্রতিপক্ষকে খুন করা ও মুক্তিপণের জন্য মানুষকে অপহরণ করার মতো অপরাধের সঙ্গে তারা মিশে গেছে। তারা অর্থের বিনিময়ে বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করার মধ্য দিয়ে পাসপোর্ট সংগ্রহ করার নেশায় মেতে উঠেছে। এসব পাসপোর্ট ব্যবহার করে তারা বাংলাদেশি হিসেবে বিদেশে কাজ নিয়ে পরবর্তীতে রোহিঙ্গা হিসেবে ধরা পড়ায় বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। রোহিঙ্গারা বিদেশে পাড়ি জমাতে গিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ নৌপথে যাত্রা করে সাগরে নৌকাডুবির ঘটনায় মারা যাচ্ছে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে তাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে নিয়ে তাদের পুনর্বাসন করা না গেলে তারা শুধু বাংলাদেশ নেয়, বিভিন্ন দেশের জন্য হুমকি দেয়া দেবে। একান্ত মানবিক কারণে তাদের কক্সবাজারে আশ্রয় দেয়া হলেও তারা বাংলাদেশ সরকারের ভাবমূর্তিতে আঘাত করেছে। সেইসঙ্গে তাদের অত্যাচারে বাংলাদেশের কক্সবাজারের স্থানীয় বাসিন্দারাও অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। আর সে কারণে মিয়ানমার যাতে তার দেশের নাগরিকদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নিতে সম্মত হয়, সে জন্য তাদের ওপর চাপ বৃদ্ধি করার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত