আতঙ্কিত তিস্তা পাড়ের মানুষ

বাড়ছে পানি বাড়ছে দুর্ভোগ

* ঢলে বিপৎসীমার ওপরে বইছে পানি * তিস্তার পানিতে তলিয়ে গেছে ফসল

প্রকাশ : ২৯ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

ভারতের গজলডোবা ব্যারেজের সব গেট খুলে দেওয়ায় উত্তরাঞ্চলে বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তিস্তাসহ অন্যান্য নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বইছে। ডুবতে শুরু করেছে রংপুর, লালমনিরহাট, নীলফামারী ও কুড়িগ্রামের তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল। এতে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়েছে আতঙ্ক। শত শত হেক্টর জমির আমন ধান নষ্ট হয়েছে।

রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, ভারতের ভারি ও অতি ভারি বৃষ্টির কারণে উজানের পানির ঢলে তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, দুধকুমারসহ রংপুর বিভাগের সব নদ-নদীর পানি বেড়েছে। এতে ১২টি উপজেলায় তিস্তা নদীর পাড় ঘেঁষে গড়ে ওঠা ৫৬৮টি গ্রামে পানি ডুকেছে। গতকাল তিস্তার পানি ডালিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ৪০ সেন্টিমিটার ওপর দিয় প্রবাহিত হয়। কাউনিয়া পয়েন্টে ওই সময় তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমার ২৫ সেন্টিমিটার নিচ নিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এছাড়া ব্রহ্মপুত্র নদী নুনখাওয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ৩৭ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে, চিলমারী পয়েন্টে ৪৯ সেন্টিমিটার নিচে, ধরলা নদী কুড়িগ্রাম পয়েন্টে বিপৎসীমারে এক সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে, তালুক শিমুলবাড়ী পয়েন্টে বিপৎসীমার ২২ সেন্টিমিটার ওপরে, দুধকুমার নদী পাটেশ্বরী পয়েন্টে বিপদসীমার ৪৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে এবং ঘাঘট নদী গাইবান্ধা পয়েন্টে বিপৎসীমার ১ দশমিক ৪ মিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।

কাউনিয়া ও গঙ্গাচড়া উপজেলার নদীপারের বাসিন্দারা বলেন, তিস্তার পানি গত রোববার বাড়লেও গতকাল পানি কিছুটা কমেছে। তবে আবারও পানি বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। লক্ষ্মীটারি ইউনিয়নের কেল্লাপাড় ও ইছলি এলাকায় বাড়িঘরে পানি উঠলেও তা নামতে শুরু করেছে। লক্ষ্মীটারি ইউনিয়নের ইছলি এলাকার কৃষক যতীশ চন্দ্র বলেন, গত এ সপ্তাহে বাড়িতে দুইবার পানি উঠেছে। নদীর পানি এই বাড়ে, এই কমে। এতে করে কষ্টটা বেশি হচ্ছে।

লক্ষ্মীটারি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবদুল্লাহেল হাদী বলেন, এবার কয়েক দফা উজান থেকে পাহাড়ি ঢল নেমে আসায় নদীর তীরবর্তী মানুষের কষ্ট হয়েছে। নদীর পানি সকালে কমলেও আবার রাতে বাড়ে। তার ওপর আকাশে মেঘ। থেমে থেমে বৃষ্টিও হচ্ছে। বলাও যায় না যে পানি কখন বাড়বে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড রংপুর কার্যালয়ের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আহসান হাবিব বলেন, লালমনিরহাটের ডালিয়া পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার নিচে নেমে গেলেও রংপুরের কাউনিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপরে রয়েছে। বিভিন্ন নদ-নদীর পানি বাড়া-কমার মধ্যে রয়েছে।

তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধিতে রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার নোহালী ইউনিয়নের চর বাগডোহরা, মিনার বাজার, কোলকোন্দ ইউনিয়নের বিনবিনার চর, মটুকপুর, চিলাখাল, লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের ইচলী, শংকরদহ, বাগেরহাট, জয়রামওঝা, গজঘণ্টা ইউনিয়নের রাজবল্লভ, চর ছালাপাক, মর্ণেয়া ইউনিয়নের নরসিংহ, চর মর্ণেয়া, কাউনিয়া উপজেলার বালাপাড়া ও টেপামধুপুর ইউনিয়নের হরিচরণ শর্মা, আজমখাঁ, হয়বত খাঁ, বিশ্বনাথের চর, চরগনাই, ঢুষমারা, চর রাজিব, গোপিঙ্গা, গদাই, পাঞ্জরভাঙ্গা, তালুক শাহবাজপুর, পীরগাছা উপজেলার ছাওলা ইউনিয়নের গাবুড়া, শিবদেব, রামসিং, জুয়ান, হাগুরিয়া হাশিম এলাকায় মানুষের পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।

পানি বৃদ্ধির ফলে তিস্তার তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল চর ও দ্বীপচরে গতকাল বন্যা সৃষ্টি হয়। কোথাও গলা সমান, কোথাও কোমড়, কোথাও বা হাঁটু পানি হয়েছে। বন্যার কারণে কৃষকের পাট, মরিচ, বাদামের ক্ষেত পানিতে তলিয়ে গেছে। রাস্তাঘাট ডুবে যাওয়ায় স্থানীয়রা কলাগাছের ভেলা ও ডিঙ্গি নৌকায় যাতায়াত করছেন। রংপুরের কাউনিয়া ও গঙ্গাচড়া উপজেলার ৪০টি চরাঞ্চলের গ্রামে পানি প্রবেশ করায় প্রায় ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। বাড়িঘর ৩ থেকে ৪ ফুট পানিতে তলিয়ে গেছে। সেই সঙ্গে ধানসহ শষ্য ক্ষেতগুলো তলিয়ে আছে পানিতে। পানিবন্দি মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে উঁচু স্থানে ও পাউবো বাঁধে আশ্রয় নিয়েছেন। এলাকাগুলো হচ্ছে- গঙ্গাচড়া উপজেলার আলমবিদিতর ও নোহালী ইউনিয়নের ১৫টি গ্রাম। কাউনিয়া উপজেলার ধুসমারার চর, আজম খাঁ চর, হাইবত খাঁ গোনাই, পল্লীমারী, চর একতা, চর মিলনবাজার, গোপীকাল্লা, ডালার চর ও চর গোদাই। রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, তিস্তার পানি আরো বৃদ্ধি পেতে পারে। সে কারণে দুর্গম চরাঞ্চলে বসবাসকারী মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে।

কাউনিয়ার চর হায়বৎখাঁর কৃষক নুরু মিয়া বলেন, আমরা এখন বন্যার পানির মাঝে গরু-ছাগল নিয়ে আটকা পড়ে আছি। শুনতেছি পানি নাকি আরো বাড়বে। পানি আরো বাড়লে আর বাড়িতে থাকা যাবে না।

হঠাৎ এই বন্যার বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. একেএম সাইফুল ইসলাম বলেন, জুন থেকে সেপ্টেম্বর বর্ষা মৌসুম। এই সময় বাংলাদেশে স্বাভাবিক বন্যা হয়। তিস্তায় দ্রুত পানি চলে আসে, আবার দ্রুত কমে যায়।

উত্তরাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির বিষয়ে জানতে চাইলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সর্দার উদয় রায়হান বলেন, তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আগামী ২৪ ঘণ্টা স্থিতিশীল থাকতে পারে। সেখানে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হতে পারে। তবে ৪৮ ঘণ্টার পর পানি কমতে পারে বলে আমরা ধারণা করছি। যমুনা নদীর পানিও বিপৎসীমার কাছাকাছি। এখানেও পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগামী দুই দিন পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। তবে গুরুতর বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে না।

পানি বৃদ্ধির বিষয়ে রায়হান বলেন, মৌসুমি বায়ুর কারণে বৃষ্টি বেড়েছে। উজানে কয়েক দিন মৌসুমি বায়ু সক্রিয় ছিল। সেখানে ভারি বৃষ্টি হয়েছে। সেই পানির ঢল নদীতে এসেছে। পশ্চিমবঙ্গর দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি বা সিকিমে ভারি বৃষ্টি হয়েছে। তিস্তার উজানে গজলডোবা ব্যারেজ আছে। তবে ভারত কখন সেটা খোলে, আর কখন বন্ধ করে সেটা আমাদের জানায় না। ফলে অফিসিয়ালি আমরা এটা জানতে পারি না। শুধুমাত্র তাদের কাছ থেকে নদ-নদীর পানি বাড়া বা কমার তথ্য পেয়ে থাকি। মূলত ভারি বৃষ্টির কারণেই নদ-নদীর পানি বাড়ছে। এটাই এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে থাকা তথ্য।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ভারতের গজলডোবা ব্যারেজের সব গেট খুলে দেওয়ায় দ্রুত পানি বাড়ছে। এদিকে যমুনাসহ ওই অঞ্চলের সব নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। সিরাজগঞ্জে নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল বন্যার পানিতে ডুবে গেছে। বন্যা ও ভাঙন আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে নদীপারের অসহায় মানুষ।

আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোসাদ্দেক হোসেন বলেন, ইউনিয়নের ১০টি গ্রামে নদীর পানি ঢুকে পড়েছে। প্রায় ২ হাজার মানুষ আজ সকাল থেকে পানিবন্দি।

রাজারহাটের ঘড়িয়ালডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মিনহাজুল ইসলাম জানিয়েছেন, তাদের এলাকায় বাঁধ ভেঙে বন্যার পানি ঢুকে ২০০’র বেশি ঘরবাড়ি ডুবে গেছে। সেখানকার বাসিন্দারা স্থানীয় স্কুলে আশ্রয় নিয়েছেন।

লালমনিরহাটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ উল্ল্যাহ বলেন, পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কিছু নিচু এলাকায় বন্যা দেখা দিয়েছে। নদী পাড়ের মানুষের সার্বক্ষণিক খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। দুর্যোগ মোকাবিলায় সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে।

সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধিও অব্যাহত রয়েছে। সম্প্রতি পানি কমার ফলে যমুনা অভ্যন্তরে চরাঞ্চল পানি নেমে যেতে শুরু করেছিল। ফলে বন্যা প্লাবিত মানুষের মাঝে কিছুটা স্বস্তি ফিরে এসেছিল। গত বৃহস্পতিবার গভীর রাত থেকে ভারি বর্ষণের কারণে নতুন করে পানি বৃদ্ধি শুরু হওয়াতে যমুনা পাড়ের মানুষগুলোকে নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে। সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী রঞ্জিত কুমার সরকার বলেন, উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও ভারি বর্ষণ হলেও যমুনা নদীর পানি কমতে শুরু করেছিল। কিন্তু চলমান ভারি বর্ষণে যমুনার পানি বৃদ্ধি ও চরাঞ্চলের নিম্নভূমিগুলো নতুন করে প্লাবিত হচ্ছে। সঙ্গে ভাঙন আতঙ্কে রয়েছে নদীর পাড়ের এবং চরাঞ্চলের বহু মানুষ।