সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী

নির্বাচন নিয়ে সরকারের ওপর কোনো চাপ নেই

প্রকাশ : ৩০ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  বিশেষ প্রতিনিধি

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক মানে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। যতগুলো উপনির্বাচন ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলো জনগণ কি অংশগ্রহণ করেনি? জনগণ তো অংশগ্রহণ করেছে। সেটাই তো অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। জনগণ ভোট দেবে, সেই ভোটে যারা জয়ী হবে তারাই সরকারে আসবে। আসন্ন জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সরকারের ওপর কোনো চাপ নেই। বিরোধীরা বলছে সরকার চাপে রয়েছে। তাদের ধারণা ভুল। সংবিধান অনুয়ায়ী আগামী নির্বাচন হবে। গতকাল বিকাল ৪টায় গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলন তিনি এসব কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের বিষয়ে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।

শেখ হাসিনা বলেন, বিএনপি হয়তো নির্বাচনে আসবে, নমিনেশন বাণিজ্য করবে। কিছু টাকা পুরানা পল্টন, কিছু টাকা গুলশান অফিস পাবে। আর মোটা অঙ্কের টাকা যাবে লন্ডনে। এই তো তাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ। তারপর তারা ইলেকশনের বুথে নিজেরাই মারামারি করে বলবে, এই তো আমরা নির্বাচন করতে পারলাম না, উইথড্রো করলাম।

তিনি বলেন, নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হওয়া মানে কি ভোটচোর- ভোটডাকাতদের, দুর্নীতিবাজ-মানিলন্ডারিং-খুনি, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলাকারী, জাতির পিতার হত্যাকারী, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের অংশগ্রহণ? এটা কি জনগণ চায়? তারা অংশগ্রহণ করলেই নির্বাচন বৈধ হবে আর অন্য কেউ করলে হবে না, এটা তো হতে পারে না। বরং তাদের প্রতি মানুষের ঘৃণা রয়েছে। এটা মাথায় রাখতে হবে। নইলে ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি তো মাত্র ৩০টা আসন পেয়েছিল। তারপর থেকে তারা তো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে না, তারা শুধু বাণিজ্য করে, নমিনেশন বেচে।

মানুষের ভোটের অধিকার একমাত্র আওয়ামী লীগই নিশ্চিত করেছে উল্লেখ করে সরকার প্রধান বলেন, যখন সামরিক একনায়করা নির্বাচন করত, খালেদা জিয়া যখন ভোট চুরি করে ক্ষমতা দখল করল তখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সুষ্ঠু ভোটের সুর কোথায় ছিল। জিয়াউর রহমান, এরশাদ যখন ভোট চুরি করল, করল এবং ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে খালেদা জিয়া ভোট চুরি করল তখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নীতিকথা কোথায় ছিল। ২০০১-এর নির্বাচনে অত্যাচার-নির্যাতন করে জোর করে আমাদের হারানো হলো। নির্বাচনকে সুষ্ঠু করার জন্য আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা রক্ত দিয়েছে, সংগ্রাম করেছে। এদেশে নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক করার জন্য আওয়ামী লীগ সরকার আইন করে নির্বাচন কমিশন গঠন করেছে। স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স, নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীনতা দেওয়া ও আলাদা বাজেট দেওয়া হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, এতো উন্নয়নের পর জনগণকে এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা কী চায়। মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছি, খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছি, কোনো খাদ্য ঘাটতি নেই। যা কিছু করেছি, সব তো জনগণের কাজে লাগছে। সবই তো জনগণ ভোগ করছে। মেট্রোরেল করতে গিয়ে আমাদের নানা কথা শুনতে হয়েছে। সব জায়গায় কথা শুনতে হচ্ছে। আর উন্নয়ন করে সবার প্রশংসা পাব, এটা আশা করিও না। আশা করাও ঠিক হবে না। যাদের এক সময় জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছিল তারা তো এখন সমালোচনা করবেই। শেখ হাসিনা আরো বলেন, জনগণের জন্য কাজ করছি, জনগণের জন্য আছি, ১৪ বছরের মধ্যে দেশকে কোথায় নিয়ে এসেছি, সেটাও দেখতে হবে। টানা ক্ষমতায় থাকার কারণে দেশের দ্রুত একটি পরিবর্তন আনা সহজ হয়েছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। আওয়ামী লীগ সুদূরপ্রসারী প্ল্যান করে রাখে। যখনই ক্ষমতায় আসি সেগুলো নিয়ে কাজ করি। ডিজিটাল রূপকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। দেশে গরিব মানুষ একটাও থাকবে না। দক্ষিণ আফ্রিকা সফর নিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, এই সফর অত্যন্ত ফলপ্রসূ ছিল। বিশেষ করে, নিষেধাজ্ঞা ও পাল্টা নিষেধাজ্ঞার সময়ে আমাদের বাণিজ্যিক নানা পথ প্রশস্ত হয়েছে। সফরের মূল আলোচনার বাইরে ইন্দোনেশিয়া, বেলারুশসহ বিভিন্ন দেশের সরকারপ্রধানের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। যখন সারাবিশ্ব স্যাংশন, কাউন্টার স্যাংশনের নামে নানা ঝামেলায়, সেখানে একটা নতুন দুয়ার খুলে গেছে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছু সম্প্রসারণ করার জন্য সেটাই আমি মনে করি। বিপদজনক অস্ত্র প্রতিযোগিতায় সম্পদ অপচয় না করে বিশ্বব্যাপী জনসাধারণের জন্য পণ্য ও পরিষেবা প্রদানের জন্য আহ্বান সম্মেলনে জানানো হয়েছে বলে জানান শেখ হাসিনা। বিশ্ব অর্থনীতির এক-চতুর্থাংশের নিয়ন্ত্রণকারী পাঁচ দেশের জোট ব্রিকসের সম্মেলনে যোগ দিতে দক্ষিণ আফ্রিকা সফর করেন শেখ হাসিনা। দক্ষিণের দেশসমূহের উপর আরোপিত সিদ্ধান্ত, বিভাজনের নীতিকে না বলার এখনই সময়। সর্বজনীন নিয়ম ও মূল্যবোধকে অস্ত্রে পরিণত করার প্রচেষ্টাকে অবশ্যই প্রত্যাখ্যান করতে হবে। আমাদের নিষেধাজ্ঞা ও পাল্টা নিষেধাজ্ঞার চক্র বন্ধ করতে হবে।

সব ধরনের হুমকি, উসকানি ও যুদ্ধের বিরুদ্ধে কথা বলার উপর গুরুত্ব দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, দক্ষিণের দেশসমূহের উপর আরোপিত কৃত্রিম সিদ্ধান্তের কারণে আর ক্ষতিগ্রস্ত হতে রাজি নই। সর্বজনীন নিয়মের নামে আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া অসম নীতিকে প্রত্যাখ্যান করার জন্য আমি দক্ষিণের দেশসমূহকে আহ্বান জানিয়েছি।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আত্মসম্মান না থাকায় নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিবৃতি ভিক্ষা করছেন। তার বিরুদ্ধে টেলিকম শ্রমিকরা মামলা করেছে। বিচার বিভাগ স্বাধীন, এখানে আমার করার কিছু নেই। যারা বিবৃতি দিয়েছেন, তাদের বলব আপনারা এসে দেখুন, কীভাবে বিচার হচ্ছে, যাচাই করে দেখুন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিবৃতিদাতাদের উদ্দেশে আরো বলেন, বিবৃতি না দিয়ে তাদের ক্লায়েন্টের জন্য অভিজ্ঞ লোক পাঠাক। এটা আসলে কী? কাগজপত্র ঘেঁটে দেখুক তারা। আমরা তো মামলা করিনি। এনবিআর থেকে আয়কর ফাঁকির মামলা করেছে। ক্ষতিগ্রস্ত লেবাররা মামলা করেছেন। দুর্নীতি খুঁজে বেড়াচ্ছেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান করতে বলেছেন। কিন্তু দুর্নীতিবাজ পছন্দের লোক হলে আবার এগুলো নিয়ে কথা আসছে কেন? আইন তো তার নিজস্ব গতিতে চলবে।

নোবেলজয়ী বলে কি ব্যবস্থা নেওয়া হবে না? এমন প্রশ্ন রেখে শেখ হাসিনা বলেন, পৃথিবীতে এমন বহু নোবেলজয়ী আছেন, পরবর্তী তাদের কাজের জন্য কারাগারে যেতে হয়েছে। বিবৃতির ফলে আদালত প্রভাবিত হবে কি না, স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পারবে না কেন? আদালত স্বাধীনভাবে চলবে। ভয় পেলে চলবে না। শ্রমিকদের পাওনা তাদের দিতে হবে।

ব্রিকসের সদস্যপদ না পাওয়া প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, প্রথমবারেই ব্রিকসের সদস্যপদ পাওয়ার চেষ্টাও আমরা করিনি। আমরা যখন জানলাম যে নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক হচ্ছে, ওটার ওপরেই আমাদের আগ্রহটা বেশি ছিল। সদস্যপদ চাইলে পাব না, সে অবস্থাটা নেই। কিন্তু প্রত্যেক কাজেরই একটা নিয়ম থাকে, সেই নিয়ম মেনেই চলি। আমার সঙ্গে যখন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্টের সাক্ষাৎ হলো, তিনি আমাকে যখন আমন্ত্রণ জানালেন, সে সময় আমাকে জানালেন যে তারা কিছু সদস্য বাড়াবেন। তখন তিনি আমার মতামত জানতে চেয়েছিলেন। আমি বলেছিলাম যে, এটা খুবই ভালো হবে। কারণ ব্রিকস যখন প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন থেকে এই পাঁচটা দেশের সরকারপ্রধানের সঙ্গে কিন্তু সবসময় আমার ভালো যোগাযোগ ছিল এবং এখনো আছে।

তিনি বলেন, আমরা যখন শুনলাম যে নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক হচ্ছে, ওটার উপরেই আমাদের আগ্রহটা বেশি ছিল। সেখানে আমরা যুক্ত হতে চেয়েছিলাম। যখন এটা তৈরি হয় তখন থেকেই আমাদের আগ্রহ ছিল যে এটার সঙ্গে আমরা যুক্ত হবো। আর ব্রিকসের সদস্য হওয়ার যে বিষয় সেটা ব্রিকসের প্রেসিডেন্ট তখনই আমাকে বলেছিলেন যে, তারা ভৌগোলিক অবস্থান বিবেচনা করে ধাপে ধাপে সদস্য নেবেন। পর্যায়ক্রমে তারা সদস্য সংখ্যা বাড়াবেন। নিলে আমরা খুব খুশি, কিন্তু আমরা ঠিক ওইভাবে ব্রিকসে এখনই সদস্যপদ পাব, প্রথমবারেই যে সদস্যপদ পাব সেই ধরনের কোনো চিন্তা আমাদের মাথায় ছিলও না। আর সেরকম কোনো চেষ্টাও আমরা করিনি বা কাউকে আমরা বলিনি।

তিনি বলেন, ব্রিকসে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীসহ প্রত্যেক দেশের রাষ্ট্রপ্রধান-সরকারপ্রধানের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। আমরা কিন্তু কাউকে বলতে যাইনি যে, আমাদের এখনই সদস্য করেন।

সরকারের উন্নয়নের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ঢাকা থেকে এখন বরিশাল মাত্র ৩ ঘণ্টায় যাওয়া যায়। পায়রা বন্দর পর্যন্ত যেতে বড়জোর ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা লাগে। আগে যেখানে লঞ্চে ২৪ ঘণ্টাই লাগত। ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ তো এটাই। ওই অঞ্চলটা একেবারে অবহেলিত ছিল। এখন বরিশাল-পটুয়াখালী-বরগুনাসহ ওই পুরো এলাকা পরিবর্তন হয়ে গেছে। সেখানকার প্রত্যেকটা গ্রামই এখন শহরের মতো। গ্রাম এখন আর গ্রাম নেই। গ্রামের প্রত্যেকটা মানুষ এখন সব নাগরিক সুবিধা পাচ্ছে।

দেশে সিন্ডিকেট করে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সিন্ডিকেট ভাঙা যাবে না এটা কোনো কথা নয়। কে কত বড় শক্তিশালী আমি দেখব। সিন্ডিকেট ভাঙা যাবে না এমন কিছু বাণিজ্যমন্ত্রী বললে তাকে আমি ধরব। উৎপাদন বাড়িয়ে এবং বিকল্প ব্যবস্থা করে সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়ার কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।