ঢাকা ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৯ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ড. ইউনুসের সঙ্গে আইনি লড়াই

রাষ্ট্রকে চাপে রাখার কৌশল কূটনৈতিক শিষ্টাচার নয়

রাষ্ট্রকে চাপে রাখার কৌশল কূটনৈতিক শিষ্টাচার নয়

ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবসা দেশে নতুন নয়, দরিদ্র মানুষের কাছে সুদের বিনিময়ে টাকা লগ্নি বা ঋণ দেয়ার চিরাচরিত প্রথা। এরপরও ক্ষুদ্র ঋণের প্রবক্তা হিসেবে বিশ্বব্যাপী মহানায়ক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন নোবেলজয়ী ড. মুহম্মদ ইউনূস। এই ক্ষুদ্র ঋণ বহু মানুষকে স্বনির্ভর করেছে বলে দাবি করা হয়। তবে ক্ষুদ্র ঋণের দায় মেটাতে কিডনি বিক্রির মতো চরম পথ বেচে নিয়েছে মানুষ। গ্রামাঞ্চলে বহু সুখের সংসার ভেঙেছে। আর সেই অভিযুক্ত ব্যক্তি ড. ইউনূসের পক্ষ নিয়ে শতাধিক নোবেলজয়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে খোলা চিঠি লিখেছেন। জাতীয় দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের বছরে এমন চিঠি বাংলাদেশকে চাপে রাখার কৌশল হিসেবে দেখছেন কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেছেন, কোনো দেশের বিচারাধীন বিষয় নিয়ে অন্য দেশের হস্তক্ষেপ কূটনৈতিক শিষ্টাচার বর্হিভূত।

জানা গেছে, শ্রমিকদের পাওনা টাকা পরিশোধ না করায় ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে আরো ১৮টি মামলা হয়েছে। চলমান বিচারিক কার্যক্রম তাৎক্ষণিকভাবে স্থগিতের আহ্বান জানিয়ে শতাধিক নোবেল বিজয়ীসহ ১৭০ জনের বেশি বিশ্বনেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে একটি খোলা চিঠি লিখেছেন।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ড. ইউনূস বুদ্ধি খাটিয়ে ক্ষুদ্র ঋণের নামে সুদের ব্যবসা প্রাতিষ্ঠানিক শুরু করেছিলেন। সামাজিক ব্যবসার পেছনে লাভের অংশকেই বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়। ক্ষুদ্র ঋণের এই চক্রে একবার যিনি পড়েছেন, সেই চক্র থেকে খুব সহজেই আর বের হতে পারেননি। ফলে ঋণের টাকা পরিশোধ করতে গিয়ে বহু দরিদ্র মানুষ শেষ সম্বলটুকুও হারিয়েছেন। ড. ইউনূস নিজের লাভের পেছনে ছুটলেও কর্মীদের ন্যায় পাওনা দেয়ার ক্ষেত্রে কার্পণ্য করেছেন।

সংশ্লিষ্টরা বলেন, ২০২০-২১ অর্থবছরে ড. ইউনূসের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট থেকে প্রায় সব টাকা তুলে ‘ইউনূস ট্রাস্ট’ গঠন করেন। ট্রাস্টের টাকা আয়করমুক্ত। আয়কর মুক্তভাবে ‘মুনাফা’ প্রাপ্তির ‘লোভ’ থেকেই তিনি এমন কাণ্ড ঘটিয়েছেন। কিন্তু আইন অনুযায়ী এই ধরনের ফান্ডের জন্য ১৫ শতাংশ কর দিতে হয়, এটি তিনি দেননি। এই ট্যাক্স ফাঁকির কারণেই তার বিরুদ্ধে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) মামলা করে। এই মামলায় তিন হেরে যান। এখন মামলাটি আপিল বিভাগে বিচারাধীন।

মামলা সূত্রে জানা যায়, ১৯৯০ সালের দানকর আইন অনুযায়ী ২০১১-১২ করবর্ষে মোট ৬১ কোটি ৫৭ লাখ ৬৯ হাজার টাকা দানের বিপরীতে প্রায় ১২ কোটি ২৮ লাখ ৭৪ হাজার টাকা কর দাবি করে নোটিশ পাঠায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। ২০১২-১৩ করবর্ষে ৮ কোটি ১৫ লাখ টাকা দানের বিপরীতে ১ কোটি ৬০ লাখ ২১ হাজার টাকা দানকর দাবি করা হয়। আর ২০১৩-১৪ করবর্ষে ৭ কোটি ৬৫ হাজার টাকা দানের বিপরীতে ১ কোটি ৫০ লাখ ২১ হাজার টাকা কর দাবি করে নোটিশ দেয় এনবিআর। এসব দানের বিপরীতে যথাক্রমে প্রায় ১২ কোটি ২৮ লাখ ৭৪ হাজার ৮০০, ১ কোটি ৬০ লাখ ২১ হাজার এবং ১ কোটি ৫০ লাখ ২১ হাজার টাকাসহ মোট ১৫ কোটি ৩৯ লাখ ১৬ হাজার ৮০০ টাকা আয়কর দাবি করে এনবিআর। একই সঙ্গে ৬৯ লাখ ২৬ হাজার ২৫৬ টাকা জরিমানাও ধার্য করা হয়। জরিমানাসহ ইউনূসের কাছে এনবিআরের মোট পাওনা দাঁড়ায় ১৬ কোটি ৮ লাখ ৪৩ হাজার ৫৬ টাকা, যেখানে ড. ইউনূস আয়কর বাবদ পরিশোধ করেন ৩ কোটি ৬১ লাখ ৭০ হাজার ৪৪৮ টাকা। পরিশোধের অর্থ বাদ দিলে জরিমানাসহ ড. ইউনূসের কাছে এনবিআরের বর্তমান পাওনা ১২ কোটি ৪৬ লাখ ৭২ হাজার ৬০৮ টাকা।

এছাড়া গত বছরের জানুয়ারিতে শান্তিতে নোবেলজয়ী ও গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ব্যাংক হিসাব তলব করা হয়। বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) পক্ষ থেকে ইউনূসের ব্যাংক হিসাবের তথ্য চাওয়া হয়।

গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে আরও ১৮টি মামলা হয়েছে। ২০০৬ সালের আগে নিয়োগ পাওয়া ১৮ জন কর্মচারী ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতে গত সোমবার পৃথক মামলা করেন। আগামী ১৬ অক্টোবরের মধ্যে সমনের জবাব দিতে বলা হয়েছে বলে জানান নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আইনজীবী আবদুল্লাহ-আল-মামুন। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ২০০৬ সালের আগে যারা কর্মে নিয়োজিত ছিলেন, তাদের মধ্যে ১৮ জন শ্রম আদালতে মামলা করেছেন। আদালত সমন দিয়েছেন। বিষয়টি আইনগতভাবে মোকাবিলা করা হবে।

এর আগে ২২ আগস্ট শ্রম আইন লঙ্ঘনের আরেক মামলায় ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ চারজনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের পরিদর্শক তরিকুল ইসলাম সেদিন সাক্ষ্য দেন। মামলায় অপর তিন বিবাদী হলেন গ্রামীণ টেলিকমের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আশরাফুল হাসান, পরিচালক নুর জাহান বেগম ও শাহজাহান। শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০২১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ড. ইউনূসসহ চারজনের বিরুদ্ধে এই মামলা করে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর। ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতে এ মামলা করেছিলেন অধিদপ্তরের শ্রম পরিদর্শক আরিফুজ্জামান।

মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায়, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ড. ইউনূসের গ্রামীণ টেলিকম পরিদর্শনে যান। সেখানে গিয়ে তারা শ্রম আইনের লঙ্ঘনের বিষয়ে জানতে পারেন। এর মধ্যে ১০১ জন শ্রমিক-কর্মচারীকে স্থায়ী করার কথা থাকলেও তাদের স্থায়ী করা হয়নি। শ্রমিকদের অংশগ্রহণের তহবিল ও কল্যাণ তহবিল গঠন করা হয়নি। এছাড়া প্রতিষ্ঠানের লভ্যাংশের ৫ শতাংশ শ্রমিকদের দেয়ার কথা থাকলেও তা দেয়া হয়নি। এদিকে গত ৩০ মে ড. ইউনূসকে প্রধান আসামি করে আরো ১২ জনের নামে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। মামলায় গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক-কর্মচারী কল্যাণ তহবিলের ২৫ কোটি ২২ লাখ ৬ হাজার ৭৮০ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়। দুদকের উপ-পরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধান বাদী হয়ে ঢাকা সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে মামলাটি করেন।

গত সোমবার স্বাক্ষরকারীদের একজন, রেজাল্টস অ্যান্ড সিভিক কারেজের প্রতিষ্ঠাতা স্যাম ডেলি-হ্যারিস এক বিজ্ঞপ্তিতে ওই খোলা চিঠিটি প্রকাশ করেন। চিঠিতে স্বাক্ষর করা বিশ্বনেতাদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন, পূর্ব তিমুরের প্রেসিডেন্ট হোসে রামোস হোর্তা, আয়ারল্যান্ডের সাবেক প্রেসিডেন্ট মেরি রবিনসন, জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন, মেক্সিকোর সাবেক প্রেসিডেন্ট ভিসেন্ট ফক্স, সাবেক মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর, রোটারি ইন্টারন্যাশনালের প্রধান নির্বাহী জন হিয়োকো, উইকিপিডিয়ার প্রতিষ্ঠাতা জিমি ওয়েলসের মতো আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব রয়েছেন।

চিঠির শুরুতে ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা’ সম্বোধন করে লেখা হয়েছে, আমরা নোবেল পুরস্কার বিজয়ী, নির্বাচিত কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী ও সুশীল সমাজের নেতার পাশাপাশি বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে লিখছি। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর থেকে আপনাদের জাতি যেভাবে প্রশংসনীয় অগ্রগতি অর্জন করেছে আমরা তার প্রশংসা করি।

এতে বলা হয়, বর্তমান প্রেক্ষাপটে মানবাধিকারের প্রতি যে হুমকি আমাদের উদ্বিগ্ন করে তা হলো- শান্তিতে নোবেলজয়ী প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের মামলা। আমরা উদ্বিগ্ন, সম্প্রতি তাকে টার্গেট করা হয়েছে। এটা ক্রমাগত বিচারিক হয়রানি বলেই আমাদের বিশ্বাস। এর আগে ৪০ জন বিশ্বনেতা তার নিরাপত্তা এবং স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে আপনার কাছে যে আবেদন করেছিলেন, এই চিঠিটি তার ওপর ভিত্তি করে গড়ে তোলারই চেষ্টা। আমরা বিনীতভাবে অনুরোধ করছি, আপনি অবিলম্বে অধ্যাপক ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে বর্তমান বিচারিক কার্যক্রম স্থগিত করুন।

চিঠির শেষাংশে বলা হয়- আমরা আশা করি, আপনি এই আইনি সমস্যাগুলোর সমাধান একটি সমীচীন, নিরপেক্ষ এবং ন্যায়সঙ্গত পদ্ধতিতে নিশ্চিত করবেন। এর পাশাপাশি আগামী দিনে একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচন এবং সব ধরনের মানবাধিকারের প্রতি সম্মান (প্রদর্শন) নিশ্চিত করবেন। সামনের দিনগুলোতে কীভাবে এই বিষয়গুলোর সমাধান করা হয়, তা ঘনিষ্ঠভাবে নজরে রাখার জন্য আমরা বিশ্বের লাখ লাখ উদ্বিগ্ন নাগরিকদের শিবিরে যোগ দেব।

নোবেল বিজয়ীদের খোলা চিঠির বিষয়ে দুদকের আইনজীবী মুহাম্মদ খুরশীদ আলম খান বলেছেন, ‘ড. ইউনূসের পক্ষে বিবৃতি দেশের বিচারব্যবস্থায় অযাচিত হস্তক্ষেপ। বিশ্বনেতারা বাংলাদেশের আইন, বিচার বিভাগকে না জেনে, পর্যালোচনা না করে অযাচিতভাবে বিচার বিভাগে হস্তক্ষেপ করছেন। বিশ্বনেতারা আদালতে ড. ইউনূসের মামলা নিয়ে এত মাতামাতি করছেন কেন আমি বুঝতে পারি না।’

এ বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক চেয়ারম্যান ও সেন্টার ফর সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ (ঢাকা) পরিচালক অধ্যাপক অরুণ কুমার গোস্বামী বলেছেন, কাগজে-কলমে গ্রামীণ ব্যাংকের মালিক সরকার এবং ঋণ গ্রহীতা জনগণ। কিন্তু ‘অসাধারণ’ মেধায় রাষ্ট্র ও জনগণের অর্থ ড. ইউনূস পুরে ফেলেন তার পকেটে। গ্রামীণ ব্যাংকের টাকায় ড. মুহাম্মদ ইউনূস গড়ে তুলেছেন তার নিয়ন্ত্রণাধীন ২৮টি প্রতিষ্ঠান এবং গ্রামীণ ব্যাংক তথা সরকারের টাকা আত্মসাৎ করে তিনি এখন হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত