স্ক্যানার মেশিন নেই চট্টগ্রামের ১৮টি প্রাইভেট আইসিডিতে

রপ্তানির আড়ালে অবৈধ পণ্য পাচারের আশঙ্কা

প্রকাশ : ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  তামীম রহমান, চট্টগ্রাম

চট্টগ্রাম বন্দর ও আশপাশের এলাকায় অবস্থিত ১৮ প্রাইভেট আইসিডিতে স্ক্যানার মেশিন নেই। এসব আইসিডি থেকেই চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজীকরণ হয় বিদেশি রপ্তানির তৈরি পোশাক। একটি নীতিমালা আছে, যেখানে বলা হয়েছে ডিপোতে স্ক্যানার মেশিন বসানোর বাধ্যতামূলক। কিন্তু কোনো আইসিডি মালিকই তা মানছে। এতে রপ্তানির আড়ালে কোনো ধরনের অবৈধ পণ্য পাচার হচ্ছে কি না, তা জানার সুযোগ নেই। তবে আইসিডি মালিকরা বলেছেন, বন্দরে জাহাজীকরণের আগে পণ্য স্ক্যান করা হচ্ছে। আইসিডিতে স্ক্যান করা না হলেও এই মুহূর্তে বড় কোনো সমস্যা হচ্ছে না।

কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, আইসিডিগুলোতে স্ক্যানার থাকা খুবই জরুরি। স্ক্যানারের মাধ্যমে রপ্তানি কনটেইনারে অবৈধ পণ্য শনাক্ত করা যায়। স্কস্যানার না থাকায় অসাধু সিএন্ডএফ এজেন্টদের সহযোগিতায় ভুয়া কাগজপত্র তৈরির মাধ্যমে পাচারের সুযোগ থাকছেই। তবে ডিপো মালিকদের দাবি ভিন্ন। তারা বলছেন, স্ক্যানার মেশিন বসানো প্রয়োজন। কিন্তু বিদ্যমান ব্যবস্থায় এ ধরনের স্ক্যানার মেশিন স্থাপন করলে উল্টো সমস্যা বাড়তে পারে। এজন্য অনেকে ঝামেলা এড়াতে স্ক্যানার স্থাপন করতে অনীহা প্রকাশ করছে।

কাস্টমস গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, বন্দরে স্ক্যানার মেশিনের সংকট আছে। এজন্য বন্দরে সব ধরনের পণ্য স্ক্যানার করতে বেগ পেতে হয়। এই অবস্থায় ডিপোগুলোতে স্ক্যানার মেশিন বসানো হলে সুবিধা বাড়বে। পণ্য ও পণ্যের পরিমাণ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া সম্ভব হবে। নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার থাকলে অর্থ পাচারের প্রবণতাও কমে যেতো। তবে বার বার তাগিদ দেয়ার পরও ডিপো মালিকরা বিষয়টির ওপর তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না। তবে ডিপো মালিকদের দাবি, স্ক্যানার মেশিন বসাতে ১৫ কোটি টাকা খরচ হয়। ডিপো মালিকদের নিজ উদ্যোগে বা নিজেদের অর্থায়নে স্ক্যানার কেনা কঠিন। আর স্ক্যানার বসাতে কাস্টমসেরও কোনো উদ্যোগ নেই। আবার স্ক্যানার মেশিন বসালে কাজের গতি অনেকটাই কমে যাবে। একই সাথে ডিপোর সামনে সড়কগুলোতে যানজট তৈরি হবে। এ কারণে ডিপোগুলোতে স্ক্যানার মেশিন বসানো এই মুহূর্তে সম্ভব নয়।

জানা গেছে, রপ্তানিকারকরা কারখানা থেকে কাভার্ডভ্যানে পণ্য এনে ডিপোর ছাউনিতে রাখেন। সেখানে কাস্টমসের শুল্কায়ন প্রক্রিয়া শেষে রপ্তানিকারকের প্রতিনিধিরা বিদেশি ক্রেতাদের প্রতিনিধি ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দেন। ফ্রেইট ফরোয়ার্ডাররা রপ্তানি পণ্য কনটেইনারে বোঝাই করে বন্দর দিয়ে জাহাজে তুলেন। এভাবে আইসিডি থেকে পণ্য জাহাজীকরণ সম্পন্ন হয়। ২০১৭ সালে তৎকালীন বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম খালেদ ইকবাল বেসরকারি ডিপোগুলোর সক্ষমতা বাড়াতে ইয়ার্ড সম্প্রসারণ ও স্ক্যানার মেশিন বসানোর তাগিদ দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই তাগিদ আমলে নেননি ডিপো মালিকরা। সম্প্রতি পোশাক রপ্তানির আড়ালে আড়াই বছরে পাচার হওয়া অর্থের বিষয়ে তথ্য দিয়েছে কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। সে প্রতিবেদনে ঢাকা-চট্টগ্রামের ১৯টি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ১৪৭ কোটি ৬৭ লাখ টাকা সংযুক্ত আরব আমিরাতে পাচার হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। এর মধ্যে চট্টগ্রামের দুটি প্রতিষ্ঠান নাজাফ ট্রেডিং ও তাবাস্সু ইন্টারনেশনাল দেশটিতে পোশাক রপ্তানির আড়ালে ৭ কোটি ৭০ লাখ ১০ হাজার ২৫৬ টাকা পাচার করেছে বলে অভিযাগ উঠেছে।

বর্তমানে চট্টগ্রামে সচল ডিপোগুলো হচ্ছে মধ্যম হালিশহরে হাজী মোহাম্মদ ইউনুসের মালিকানাধীন ইহসাক ব্রাদার্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ও ওমর ফারুক চৌধুরী সবুজের মালিকানাধীন চিটাগাং কনটেইনার ট্রান্সপোর্টেশন লিমিটেড। কাঠগড় এলাকায় রয়েছে ইয়াসীর রিজভীর মালিকানাধীন সামিট এলায়েন্স পোর্ট লিমিটেড, ইমরান ফাহিম নুরের মালিকানাধীন ভারটেক্স অফডক লজিস্টিক সার্ভিস লিমিটেড ও মো. শাহ আলমের মালিকানাধীন ইস্টার্ন লজিস্টিক লিমিটেড। সিইপিজেড এলাকায় রয়েছে এএসএম নাঈমের মালিকানাধীন কেএফটি লজিস্টিক লিমিটেড ও নুরুল কাইয়্যূম খানের মালিকানাধীন কিউএনএস কনটেইনার সার্ভিস লিমিটেড, ফৌজদারহাট এলাকায় এসএম শফির মালিকানাধীন শফি মোটরস, ভাটিয়ারি এলাকায় আনিছ আহমেদের মালিকানাধীন পোর্ট লিংক লজিস্টিক সেন্টার লিমিটেড, সীতাকুন্ডের সোনাইছড়ি এলাকায় খলিলুর রহমানের মালিকানাধীন কেডিএস লজিস্টিক লিমিটেড, লালদিয়া চর এলাকায় মো. মহসীন সরকারের মালিকানাধীন ইনকনট্রেড লিমিটেড, সিটি গেট এলাকায় নাজির চৌধুরী নিশানের মালিকানাধীন গোল্ডেন কনটেইনার লিমিটেড রয়েছে। সীতাকুন্ডের মো. মোস্তাফিজুর রহমানের মালিকানাধীন বিএম কনটেইনার ডিপো, কালুরঘাট এলাকায় মো. মুসার মালিকানাধীন হাজী সাবের আহমেদ টাইমার কোম্পানি লিমিটড ও কুমিরা এলাকায় রয়েছে শাহনেওয়াজ মো. আলী চৌধুরীর মালিকানাধীন নেমসান কনটেইনার লিমিটেড দীর্ঘদিন ধরে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছে। এসব ডিপোর কোনটিতেই স্ক্যানার মেশিন নেই।

কাস্টমস শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, অর্থ পাচার ঠেকাতে কাস্টমসেরও একটা দায় রয়েছে। আইন অনুযায়ী পণ্য কনটেইনারে ঢাকার পর তা জাহাজে ওঠার আগে যাচাই করার ক্ষমতা একমাত্র কাস্টমসের রয়েছে। কিন্তু রপ্তানি পণ্য যথাসময়ে জাহাজে তুলতে ও কাজের চাপ থাকলে অনেক সময় তারা কনটেইনারে থাকা পণ্য যাচাই করে দেখে না। ফলে অর্থ পাচারের সুযাগটা তৈরি হচ্ছে।

কাস্টমস শুল্ক গোয়েন্দ ও তদন্ত অধিদপ্তরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা জানান, অর্থ পাচারের জন্য ডিপোতে স্ক্যানার না থাকাকেই বড় কারণ হতে পারে। পণ্য রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণের অধিকাংশ কাজ ডিপোতে হয়। তাই সেখানে স্ক্যানার মেশিন বসানো অতি জরুরি। অথচ ডিপো মালিকরা সেদিকে কোন লক্ষ্য দিচ্ছেন না। পাশাপাশি বন্দরে স্ক্যানার সংকট রয়েছে। তাই অসাধু ব্যবসায়ীরা নানাদিক বিবেচনা করে চট্টগ্রাম বন্দরকে অর্থ পাচারের নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার করছেন। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট মিলে অর্থ পাচারে লিপ্ত হয়েছে। অতি সম্প্রতি আমরা তার প্রমাণ পেয়েছি। গত আড়াই বছরে ৪২৪টি চালানে পোশাক পণ্য রপ্তানির আড়ালে ১৪৭ কোটি টাকা দুবাইতে পাচার হয়েছে। আমরা কোনো কোনো সিঅ্যান্ডঅ্যাফ এজেন্ট জড়িত রয়েছে তা দেখছি। পাশাপাশি বিষয়টি তদন্ত করে মানিলন্ডারিং আইনে আলাদা আলাদা মামলা করা হবে। তবে এ ধরনের কাজ বার বার হতে দেয়া যাবে না।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো এসোসিয়েশনের (বিকডা) এক কর্মকর্তা জানান, আইসিডিতে স্ক্যানার না থাকলেও বন্দরে আছে। বন্দরে স্ক্যান করলে আইসিডিগুলোতে না করলে কোনো সমস্যা হয়না। ডিপোতে স্ক্যানার বসিয়ে কাজ চালু করা কঠিন। স্ক্যানার বসাতে গিয়ে অনেক ডিপো বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ, ডিপোগুলোর কাজের গতি কমে যাবে। স্ক্যান করে করে গাড়ি ঢুকাতে বা বের করতে গেলে রাস্তায় হাজার হাজার গাড়ি আটকা পড়বে। পাশাপাশি রপ্তানি পণ্য যথাসময়ে শিপমেন্ট করা সম্ভব হবে না। পোশাক কারখানা মালিকরাও ক্রেতা হারাবে। তাই এই মুহূর্তে স্ক্যানার বসানোর দরকার নেই।