ঢাকা ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৯ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বাঁচা-মরার লড়াইয়ে বিএনপি

বাঁচা-মরার লড়াইয়ে বিএনপি

প্রতিষ্ঠার পর সবচেয়ে বেশি সময় ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি এবার সরকার পতনের একদফা আন্দোলনের ঘোষণা দিয়ে পদযাত্রা, মহাসমাবেশ, গণমিছিল ও কালোপতাকা মিছিলসহ নানা কর্মসূচি পালন করে আসছে। এরই মধ্যে ৪৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করল দলটি। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে গতকাল শুক্রবার রাজধানী র‌্যালি করেছে দলটি। র‌্যালিতে লাখ লাখ নেতাকর্মীর ঢল নামে। রাজপথের এসব কর্মসূচিতে বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা জীবনবাজি রেখে ও মামলা-হামলা উপেক্ষা করে আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায়ে আন্দোলনের পাশাপাশি নানা কৌশলও অবলম্বন করছে রাজপথে আন্দোলন করা এই বিরোধী দলটি। এবারের আন্দোলনে সফল না হলে অস্তিত্ব সংকটে পড়ার শঙ্কা রয়েছে। যে কারণে এ আন্দোলন বিএনপির জন্য ‘বাঁচা মরার লড়াই’। বিএনপির নেতৃবৃন্দ বলেন, বিএনপি প্রতিষ্ঠার পর সব চেয়ে বেশি সময় সব চেয়ে বেশি সময় ধরে আমরা ক্ষমতার বাইরে আছি। বিএনপি চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া শর্তসাপেক্ষে জামিনে বাসায় থাকার অনুমতি পেলেও সক্রিয় রাজনীতিতে নেই তিনি। বর্তমানে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। লন্ডন থেকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ভার্চুয়াল মিটিংয়ের মাধ্যমে সিনিয়র নেতাদের পরামর্শ নিয়ে দল পরিচালনা করছেন। প্রায় ৪০ লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়েছে এই সরকার। ৭০০ মানুষকে গুম করেছে। ১ হাজারেরও অধিক মানুষকে হত্যা করেছে। অধিকাংশ শীর্ষ নেতাই মামলায় জর্জরিত, কারাগারেও আছেন অনেকে। সব মিলিয়ে বিএনপি এক কঠিন সময় অতিক্রম করছে। এরই মধ্যে আমরা সরকারের পদত্যাগ, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছি। এবারের আন্দোলন আমাদের বাঁচা-মরার লড়াই। যেকোনো উপায়ে এই সরকারের পদত্যাগ নিশ্চিত করে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, সুশীল সমাজ, দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল সবাই দেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চায়। এই বিষয়টিই সরকারকে শোনাতে এবং তাদের রাজি করাতে হবে বিএনপিকে। রাজপথ দখলের পাশাপাশি ভারত-যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রভাবশালী দেশ ও সংস্থার মাধ্যমে কূটনৈতিকভাবে আরো চাপ সৃষ্টি করতে হবে। এবার দল নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে না পারলে অস্তিত্ব সংকটে পড়তে পারে বিএনপি।

সূত্রমতে, এবারের আন্দোলনকে ‘বাঁচা মরার লড়াই’ হিসেবে দেখছে বিএনপি। দলটির নেতাদের ভাষায়, ‘হয় এসপার, না হয় ওসপার’ এমন মনোভাব নিয়েই এগুচ্ছে দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব। তারা বলছেন, হয় বাঁচব, না হয় মরব। এই হচ্ছে সবার সিদ্ধান্ত। বিএনপির নেতৃত্বে সবাই এ বিষয়ে একমত। নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনেই আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এর বাইরে সরকার আগের মতো জোরপূর্বক তাদের অধীনে নির্বাচন করতে চাইলে কোনোভাবেই সেই নির্বাচনে করতে দেয়া হবে না।

দলটির হাইকমান্ড বলছে, আমরা সরকারকে অনেক সময় দিয়েছি, আর নয়। এবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে সরকারকে বাধ্য করা হবে। এ আন্দোলন আমাদের ‘ডু-অর ডাই’ আন্দোলন। এজন্য দলের নেতাকর্মীরা প্রস্তুত। তফসিল ঘোষণার আগেই গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে এই সরকারের পতন নিশ্চিত করা হবে। সেই টার্গেটেই আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। তারা বলেন, সরকারের পাতানো খেলায় পা না দেয়াই এখন আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ। গণঅভ্যুত্থান কখনো সময় নির্ধারণ করে হয় না। তাই সর্বাত্মক প্রস্তুতি থাকলে বেশি সময় লাগবে না।

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর বিবৃতিতে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, বিএনপি গণতান্ত্রিক চেতনায় গণমানুষের দল। বর্তমান দুঃসময়ে জনগণকে সংগঠিত করার কোনো বিকল্প নেই। দেশ আজ দুঃশাসনকবলিত। গুম-খুনের আতঙ্ক মানুষের নিত্যসঙ্গী। আইন, বিচার, প্রশাসন সবকিছুই সরকারি কবজার মধ্যে। বিরোধী দল দমন করার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বেআইনি কাজ করতে বাধ্য করা হচ্ছে। খুন, নারী-শিশু নির্যাতন, অপহরণ, গুপ্তহত্যা ইত্যাদি অনাচারের মাত্রা উত্তরোত্তর ক্রমবর্ধমান হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কারণ সরকার যেখানে জনগণের প্রতিপক্ষ সেখানে মানুষের জানমালের কোনো নিরাপত্তা থাকতে পারে না। সুতরাং জনগণের নিরাপত্তা বিধানের জন্যই বহুদলীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে হবে, অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করতে হবে। দেশের বর্তমান ক্রান্তিকাল অতিক্রমের জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন-সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। তিনি আরো বলেন, বিএনপিতে কোনো সংকট নেই। বিএনপি আন্দোলন সংগ্রামের মধ্যে আছে। যা চূড়ান্ত পরিণতির দিকে যাচ্ছে। আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের পদত্যাগ, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠাই বিএনপির এখন মূল চ্যালেঞ্জ।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বলেন, এ সরকার গণতন্ত্র লুণ্ঠন করেছে। তা ফিরিয়ে আনার জন্য আমরা একদফা আন্দোলন করছি। তিনি আরো বলেন, আজকে এই প্রতিষ্ঠার দিন আমাদের জন্য আনন্দের হলেও আমাদের মূল লক্ষ্য রাজপথ। মানুষের অধিকার ফিরিয়ে দিয়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করে বিএনপি রাজপথ ছাড়বে। তারেক রহমানের নেতৃত্বে এই আন্দোলনে জনগণ জয়ী হবেই।

সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রশ্নে বিদেশিদের কাছে না হলেও দেশের ১৮ কোটি মানুষের কাছে সরকারকে মাথানত করতেই হবে বলে মন্তব্য করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন, দেশের ১৮ কোটি মানুষের কাছে এই সরকারের সমর্থন নেই। বিদেশিদের কাছে মাথানত করল কী করল না, এটা বিএনপির মাথাব্যথা নয়। গণতান্ত্রিক বিশ্ব গণতন্ত্রের পক্ষে কথা বলছে, মানবাধিকারের পক্ষে কথা বলছে, ন্যায়বিচারের পক্ষে কথা বলছে, এটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে তাদের দায়িত্ববোধ থেকে বলছে। অর্থাৎ তারা বাংলাদেশের জনগণের ভোটাধিকার নিয়ে কথা বলছে। সুতরাং যদি মাথানত করতে হয় সরকারকে ১৮ কোটি মানুষের কাছেই মাথানত করতে হবে। তিনি আরো বলেন, বিএনপির প্রতিশ্রুতি একটি সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, মানুষের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং সংবিধানে মানুষের সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠাই বিএনপির প্রতিশ্রুতি। সেই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আমরা রাজপথে লড়ছি দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার জন্য।

বিএনপির প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি বলেছেন, আন্দোলনের মাধ্যমেই সরকারের পতন নিশ্চিত করতে হবে। নিরপেক্ষ সরকার গঠনের মাধ্যমেই দেশে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা হবে। শেখ হাসিনার অধীনে এ দেশে কোনো নির্বাচন হবে না। শুধু বিএনপি নয়, সব রাজনৈতিক দল একই সিদ্ধান্তে অবস্থান নিয়েছে। এ্যানি বলেন, আমাদের দফা এক, দাবি এক, শেখ হাসিনার পদত্যাগ। এ একদফা কোনো বাধা মানবে না। কেউ যদি বাধা দিতে আসে তা উপেক্ষা করে এক দফা আন্দোলনকে সফল করতে হবে। কারণ এ একদফা দুর্নীতির বিরুদ্ধে, দুঃশাসনের বিরুদ্ধে, ভোট চোরদের বিরুদ্ধে, ভোট ডাকাতদের বিরুদ্ধে। একদফার ভিত্তিতে কঠিন আন্দোলন গড়ে তোলায় আমাদের লক্ষ্য। যতদিন পর্যন্ত এ সরকার পদত্যাগ না করবে, ততদিন পর্যন্ত এক দফার ভিত্তিতে আমাদের আন্দোলন চলবে।

বিএনপির শিশুবিষয়ক সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ সিদ্দিকী বলেন, আমরা গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার রক্ষায় দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছি। এবার সরকার পতনের একদফা আন্দোলন চলছে। সরকার পতন না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলবে। এবারের আন্দোলনে সফল না হওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। সব নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা। অনেকে ঘরে থাকতে পর্যন্ত পারে না। কাজেই এবারের আন্দোলন আমাদের বাঁচা মরার আন্দোলন।

ছাত্রদলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রাশেদ ইকবাল খান বলেন, সরকার দেশের অর্থনীতি, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ সব খাতকে ধ্বংস করে ফেলেছে। মানুষের বাকস্বাধীনতাও কেড়ে নিয়েছে। ভোটাধিকার নেই। এভাবে দেশ চলতে পারে না। সরকার পতনের একদফা আন্দোলন আমরা চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা বাঁচা মরার লড়াইয়ে আছি। যেকোনো মূল্যে এই সরকারের পতন নিশ্চিত করতে হবে।

প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে ভোটবর্জন করে বিএনপি। ২০১৮ সালে জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিলেও ভোটে কারচুপির অভিযোগ তোলে দলটি। এবার দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সরকারের পদত্যাগ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে একটি অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচনের একদফা দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে দলটি।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত