ঢাকা ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৯ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

যমুনায় মিলছে সাকার, হুমকিতে দেশীয় মাছ

যমুনায় মিলছে সাকার, হুমকিতে দেশীয় মাছ

সিরাজুল ইসলাম দুই যুগের বেশি সময় যমুনা নদীর মাছ বাজারে বিক্রি করেন। প্রতিদিনের মতোই গতকালও মাছ ধরতে যমুনায় যান। তবে এ দিন তার ভাগ্য খারাপ থাকায়, নদীতে জাল ফেলতেই বিরল প্রজাতির সাকার মাছ (চ্যাগবাঘা) জালে ধরা পড়ে। পরে অন্যান্য মাছের মতোই সাকার মাছটিও বাজারে বিক্রির জন্য আনেন। তবে হেলিকপ্টারের মতো মাছটি দেখতে বাজারের উৎসুক জনতা সিরাজুলের দোকানে ভিড় জমায়। তাদের অনেকেই সাকার মাছের ছবি তুলছেন আবার হাত দিয়ে ধরে দেখছেন। তবে যমুনা নদীর মতোই ক্ষতির সাকার মাছ এখন দেশের বিভিন্ন নদী-নালা-খাল-বিলে ছড়িয়ে পড়েছে। যা নিয়ে নতুন আতঙ্কের মধ্যে পড়েছেন মানুষ।

সরেজমিন বুড়িগঙ্গা সংলগ্ন সদরঘাট, ওয়াইজঘাট, বাবুবাজার, বাদামতলীর ঘাট, শ্যামবাজার, তেলঘাট, তুরাগ, নারায়ণগঞ্জ ও সাভার বিরুলিয়া নদীসহ বিভিন্ন জায়গা ঘুরে দেখা গেছে, নদীতে কচুরিপানার নিচের কালো কালো পানিতে সাকার মাছের ব্যাপক উপস্থিতি। স্থানীয়রা এটাকে চ্যাগবাঘা মাছ বলে চিনে থাকেন। চিরচেনা এই বুড়িগঙ্গায় পানি বাড়লে জালে শিং, টেংরা, মাগুর, পুঁটিসহ দেশীয় প্রজাতির নানা মাছ ধরা দিত; কিন্তু এখন সেখানে শুধু সাকারের রাজত্ব। সাকারের ভয়ে জেলেরা জাল নিয়ে নীতে নামছে না।

জানা গেছে, ‘সাকার মাউথ ক্যাটফিস’ যার বৈজ্ঞানিক নাম ‘হাইপোসটোমাস প্লিকোসপোমাস’। দেশে সাকার মাছটির উৎপত্তিস্থল হিসেবে ধরা হয় বুড়িগঙ্গা নদীকে। আর বুড়িগঙ্গা থেকেই সারা দেশে নদী-নালায় ছড়িয়ে পড়েছে সাকার। এটি খাবার হিসেবে দেশীয় জাতের ছোট মাছ খেয়ে ফেলছে। ফলে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ এবং যমুনাসহ দেশের বিভিন্ন ­নদীতে সাকার মাছের উপস্থিতি থাকলেও দেশীয় জাতের পুঁটি, মলা, ঢেলা, চেলা, টেংরা, টাকি, কাকিলা, বোটা, ভাংনা, টাটকিনি, গুতুম, বৌ-মাছ, চাপিলা, বাইম, খলিশা, কৈ, বেলে, চান্দা এবং চিংড়ি মাছের সংকট দেখা দিয়েছে। বৃষ্টির মৌসুমে নদী-নালায় সাকার মাছের বংশো বিস্তার ঘটেছে। দেশীয় মাছের সঙ্গে সাকার যেন প্রতিযোগিতায় নেমেছে। সাকার মাছ এখন জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। সাকার অন্যান্য মাছের লার্ভা ও ডিম খেয়ে ফেলে। ফলে এই প্রতিযোগিতায় দেশীয় প্রজাতির মাছ টিকে থাকতে পারছে না।

বুড়িগঙ্গা, তুরাগ নদীর পর এবার গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি নদীতে ঝাঁকে ঝাঁকে সাকার মাছ জেলের জালে ধরা পড়েছে। বিরল প্রজাতির মাছটি দেখতে ঠিক হেলিকপ্টারের মতো। মাছ জালে ধরার পর ফুলছড়ি এলাকার বাসিন্দাদের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। ঢাকা তুরাগ নদীর পাড়ের বাসিন্দা টিপু মুন্সি বিশ বছর ধরে জাল দিয়ে মাছ ধরছেন। এদানীং তার জালে সাকার মাছ মিললেও দেশি মাছ খুব একটা মিলছে না। এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন টিপু মুন্সি। তিনি বলছেন, ‘পাঁচ বছর আগেও তুরাগে পুঁটি, চিংড়ি, চাপিলা ও বাইম পাওয়া যেত। এখন জালে ঝাকে ঝাকে সাকার মাছ আটকা পড়ছে। এই মাছের মুখ খুব শক্ত। দেশীয় মাছ খেয়ে ফেলে। সাকার মাছ ধ্বংসের উদ্যোগ নেওয়া দরকার, তা-না হলে দেশীয় মাছের অস্তিত্ব থাকবে না।’

মৎস্য অধিদপ্তর সাকার মাছ আমদানি, প্রজনন, চাষ এবং বিক্রি নিষিদ্ধ করেও নদীতে দিনে দিনে সাকার মাছ বাড়ছে। আশির দশকে অ্যাকোয়ারিয়ামের শেওলা ও ময়লা পরিষ্কার করতে এই মাছ বিদেশ থেকে আনা হয়। এই মাছ দক্ষিণ আমেরিকায় ব্যাপকভাবে দেখা যায়। তবে কয়েক বছর ধরে তা ভারত, চীন, মিয়ানমার ও বাংলাদেশের জলাশয়ে দেখা যাচ্ছে।

সাকার মাছের পিঠের ওপরে বড় ও ধারালো পাখনা আছে। দুই পাশেও রয়েছে একই রকমের দুটি পাখনা। এর দাঁতও বেশ ধারালো। সাধারণত জলাশয়ের আগাছা, জলজ পোকামাকড় ও ছোট মাছ এদের প্রধান খাবার। যেসব পানিতে দূষণের কারণে অক্সিজেনের পরিমাণ প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে আসে, সেখানে অন্য মাছ বাঁচতে পারে না, তবে এই মাছ পারে। পানি ছাড়াও মাছটি ২৪ ঘণ্টা দিব্যি বেঁচে থাকতে পারে।

মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, যারা অ্যাকোয়ারিয়ামের ব্যবসা করেন, তারাই বিদেশ থেকে দেশে সাকার মাছ আনেন। অ্যাকোয়ারিয়ামের কাচের সঙ্গে লেগে থাকা ময়লা সাকার মাছ খেয়ে ফেলে। এতে কাচ পরিষ্কার থাকে। এ কারণেই তাঁরা এ মাছ আনেন। এখন সাকার মাছ ধীরে ধীরে দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে। ঢাকার বুড়িগঙ্গা থেকে অধিকাংশ জেলা শহরে এটি ছড়িয়ে পড়েছে। সাকার মাছের দ্রুত ছড়িয়ে পড়া, নিয়ন্ত্রণ ও বিকল্প ব্যবহার নিয়ে গবেষণা করছে মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট। গবেষণায় দেখা গেছে, সাকার মাছে ভারী ধাতব পদার্থ রয়েছে। ভারী পদার্থ না থাকলে সাকার মাছ দিয়ে মাছ ও হাঁস-মুরগির খাদ্য তৈরি করা যাবে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, পুকুর প্রস্তুতের সময় তা শুকিয়ে সব সাকার ধরে মেরে ফেলতে হবে। বন্যা বেশি হওয়ায় পুকুরের চারপাশে জাল দিয়ে রাখতে হবে যেন সাকার পুকুরে প্রবেশ করতে ও বের হতে না পারে। তবে পুকুর থেকে সরালেও নদ-নদী ও খাল-বিল থেকে এ মাছ সরানো কঠিন হবে। সে ক্ষেত্রে সরকার ঘোষণা দিতে পারে, সাকার ধরে দিলে ১০ টাকা করে দেওয়া হবে। তাহলে হয়তো এটা করা সম্ভব।

রাজধানীর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বায়োলজি ও জেনেটিকস বিভাগের চেয়ারম্যান কাজী আহসান হাবীব বলেন, যেসব ফিশ ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ রয়েছে, সেখানে মাছের খাবারের প্রোটিনের উৎস হিসেবে সাকার মাছ ব্যবহার করা যেতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে- সাকার মাছ ৩০ শতাংশ পর্যন্ত খাবার যোগ্য।

সাকার মাছ কীভাবে দেশে প্রবেশ করেছে, তা নির্দিষ্টভাবে বলতে পারে না মৎস্য অধিদপ্তরও। তবে মৎস্য অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (মৎস্যচাষ) অলক কুমার সাহা আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, সাকার মাছের উৎপত্তিস্থল বুড়িগঙ্গা নদী। এসব মাছ নিধনে কিংবা নিয়ন্ত্রণে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় কোনো উদ্যোগ নেয়নি। তবে সাকার মাছ নিধনে সারা দেশে জেলেদের সচেতন করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত