ঢাকা ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৯ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

এক্সপ্রেসওয়ের যুগে বাংলাদেশ

এক্সপ্রেসওয়ের যুগে বাংলাদেশ

রাজধানীর অভ্যন্তরে যোগাযোগব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়নে দেশে প্রথমবারের মতো এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে চালু হয়েছে। এখন এয়ারপোর্ট থেকে ফার্মগেট ২ ঘণ্টার পথ কয়েক মিনিটের মধ্যেই পাড়ি দেয়া যাবে। ফলে মানুষের কর্মঘণ্টা বাঁচবে এবং মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ইতিবাচক প্রভাব রাখবে। এছাড়া আগামী অক্টোবরে মেট্রোরেল যাবে মতিঝিলে।

নগর পরিকল্পনাবিদরা বলেছেন, পুরান ঢাকা আগেভাগেই অপরিকল্পিতভাবে নির্মাণ হয়েছে। সেজন্য সড়ক প্রশস্ত সম্ভব নয়। তবে নতুন ঢাকা হিসেবে গড়ে ওঠা পূর্বাচল, উত্তরা, মোহাম্মদপুর, আগারগাঁও ও ফার্মগেটের আশপাশের এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছে। মেট্রোরেলের পর এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে চালু হয়েছে। সড়কে যাতাযাতে মানুষের সময় বাঁচবে ও দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, রাজধানীতে অসহনীয় যানজটে মানুষের ভোগান্তি ও কর্মঘণ্টাই নষ্ট হয়েছে। জিডিপি এবং মাথাপিছু আয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শুধু ঢাকার যানজটের কারণেই বছরে ক্ষতির পরিমাণ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২ দশমিক ৯ শতাংশে। ২০১৫-১৬ সালের নতুন ভিত্তি বছরের হিসাবে অর্থমূল্যে এই ক্ষতির পরিমাণ ১ লাখ ১ হাজার ৩৬ কোটি টাকা। এক্সপ্রেসওয়েটি চালুর পর চিরচেনা ঢাকার চেহারা বদলে গেছে, মানুষের সময়ও বাঁচছে। আগামীতে জিডিপিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

দেশের অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখবে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। অর্থনীতিবিদরা জানিয়েছেন, ঢাকার যানজটে প্রতি মাসে ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। এর ফলে কর্মজীবীদের উৎপাদনশীলতা কমে যায়, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে জিডিপিতে। এবার এক্সেপ্রেসওয়ে রাজধানীর যানজট নিরসন করে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়াবে।

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে চালু হওয়ায় খুশি ঢাকাবাসী। উত্তরা আব্দুল্লাপুর এলাকার বাসিন্দা জয়নাল মিয়া বলেন, এয়ারপোর্ট এলাকায় আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অবস্থান, এখানে দেশের সব জেলার বাস যাতায়াত করে। কারণ বিমানবন্দরে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যাত্রীরা আসা-যাওয়া করেন। ২৪ ঘণ্টা রাস্তায় গাড়ির চাপ থাকে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে চালু হওয়ায় যাত্রীরা যানজট থেকে মুক্তি পাবে। আরেকজন সুজন সরকার বলেন, উত্তরা থেকে ঢাকার যে কোনো গন্তব্যে যেতে চাইলেই আসা-যাওয়ায় যানজটে দিন শেষ হয়ে যায়। বিশেষত, মহাখালী ও বনানী এলাকায় তীব্র যানজট থাকে। এলিভেটেড এক্সপ্রেস চালু হওয়ায় এ দুটি এলাকায় যানজট থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি মিলবে।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, যাত্রীদের পাশাপাশি বাস চালকদের মাঝেও উচ্ছ্বাসের কমতি নেই। বাসচালকরা বলেন, যেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় লাগত বিমানবন্দরে পৌঁছাতে, সেখানে ১৫ থেকে ১৬ মিনিটে গন্তব্যে পৌঁছানোর সুযোগ তৈরি হয়েছে। এটি কম কিসে? ১৫ মিনিটে বিমানবন্দরে যাওয়া এখন স্বপ্নের মতো। সেতু বিভাগ জানায়, উড়াল সড়কের রুট হচ্ছে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দক্ষিণে কাওলা, কুড়িল, বনানী, মহাখালী, তেজগাঁও, মগবাজার, কমলাপুর, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী হয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী পর্যন্ত। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী অক্টোবর মাসে মেট্রোরেল আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত চলবে। আজ সকাল ৬টা থেকে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হবে। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. মাসুদ রানা শিকদারের স্বাক্ষর করা গণবিজ্ঞপ্তিতে বিষয়টি জানানো হয়। গণবিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়- উত্তর থেকে দক্ষিণ অভিমুখী যানবাহনের ক্ষেত্রে ওঠার স্থান হবে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দক্ষিণে কাওলা; প্রগতি সরণি এবং বিমানবন্দর সড়কের আর্মি গলফ ক্লাব এবং নামার স্থান হবে বনানী কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউ; মহাখালী বাস টার্মিনালের সামনে; ফার্মগেট প্রান্তে ইন্দিরা রোডের পার্শ্বে। দক্ষিণ হতে উত্তর অভিমুখী যানবাহনের ক্ষেত্রে ওঠার স্থান হবে বিজয় সরণি ওভারপাসের উত্তর এবং দক্ষিণ লেন; বনানী রেল স্টেশনের সামনে এবং নামার স্থান হবে মহাখালী বাস টার্মিনালের সামনে; বনানী কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউয়ের সামনে বিমানবন্দর সড়ক; কুড়িল বিশ্বরোড এবং বিমানবন্দর তৃতীয় টার্মিনালের সামনে। আরো বলা হয়, আজ সকাল ৬টায় ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর প্রান্ত হতে ফার্মগেট প্রান্ত পর্যন্ত অংশের উভয়দিক যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হলেও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে ২ এবং ৩ চাকার যানবাহন এবং পথচারী চলাচল সম্পূর্ণ নিষেধ। এর ওপর যেকোনো ধরনের যানবাহন দাঁড়ানো ও যানবাহন থেকে নেমে দাঁড়িয়ে ছবি তোলা সম্পূর্ণ নিষেধ। নতুন এ উড়ালপথের মূল সড়কে সর্বোচ্চ গতিসীমা ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার এবং ওঠানামার র‌্যাম্পের জন্য সর্বোচ্চ গতিসীমা ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটার। নির্ধারিত টোল পরিশোধ করে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে ওঠা-নামা করা যাবে।

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের টোল : চার শ্রেণিতে ভাগ করে টোল ঠিক করা হয়েছে। এতে সর্বনিম্ন টোল ৮০ ও সর্বোচ্চ ৪০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। চার শ্রেণির যানবাহনের মধ্যে কার- ট্যাক্সি, জিপ, স্পোর্টস ইউটিলিটি ভেহিক্যাল, মাইক্রোবাস (১৬ সিটের কম) এবং হালকা ট্রাকের (তিন টনের কম) টোল ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ৮০ টাকা। ১৬০ টাকা টোল ফি নির্ধারণ করা হয়েছে সব ধরনের বাসের (১৬ সিট বা এর বেশি) ক্ষেত্রে। মাঝারি ধরনের ট্রাকের (ছয় চাকা পর্যন্ত) টোল ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ৩২০ টাকা। বড় ট্রাকের (ছয় চাকার বেশি) ক্ষেত্রে ৪০০ টাকা টোল ফি নির্ধারণ করা হয়েছে।

এক্সপ্রেসওয়েতে যা নিষেধ : থ্রি হুইলার, সাইকেল এবং পথচারীদের এক্সপ্রেসওয়েতে চলাচল করতে দেয়া হবে না। মোটরবাইক এখনই চলতে পারবে না। সূত্র জানায়, দেশের প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে বিমানবন্দর থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী পর্যন্ত ৪৬ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার প্রকল্প নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে মূল উড়াল সড়কের দৈর্ঘ্য ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের মেগা প্রকল্পগুলোর মধ্যে অন্যতম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। ঢাকার যানজট নিরসনে এটিই সবচেয়ে বড় প্রকল্প। এক্সপ্রেসওয়েটি ঢাকার উত্তর-দক্ষিণে বিকল্প সড়ক হিসেবে কাজ করা যাবে। এছাড়া হেমায়েতপুর-কদমতলী-নিমতলী-সিরাজদিখান-মদনগঞ্জ-ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক-মদনপুরে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করবে। অন্যদিকে চট্টগ্রাম, সিলেটসহ পূর্বাঞ্চল ও পদ্মা সেতু হয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যানবাহন ঢাকায় প্রবেশ না করে সরাসরি উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে প্রবেশ করবে। আবার উত্তরাঞ্চল থেকে আসা যানবাহনগুলোও ঢাকাকে পাশ কাটিয়ে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সরাসরি যাতায়াত করতে পারবে। ফলে ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী এলাকার যানজট কমবে। ৪৬ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার এক্সপ্রেসওয়ের ১১ দশমিক ৫ কিলোমিটার অর্থাৎ প্রথম অংশ বিমানবন্দর থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত অংশের যানবাহন চলাচল গতকাল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করেছেন।

সরকারের সংশোধিত কৌশলগত পরিবহণ পরিকল্পনার (আরএসটিপি) তথ্যানুযায়ী, এক্সপ্রেসওয়েটিতে ১১টি টোল প্লাজা থাকবে, যার পাঁচটিই এক্সপ্রেসওয়ের ওপরে। এর ওপর দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ৮০ হাজার যানবাহন চলাচল করতে পারবে। যোগাযোগ ব্যয় ও ঢাকা শহরের যানজট অনেকাংশে কমে যাবে। কমবে ভ্রমণের সময় ও খরচও। যোগাযোগব্যবস্থার সহজীকরণ ও আধুনিকায়নের পাশাপাশি এ প্রকল্প দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য প্রভাব রাখবে। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের দেয়া তথ্য মতে, ২০১১ সালের ১৯ জানুয়ারি সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ওই বছরের জুপন এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজের উদ্বোধন করা হয়। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের (পিপিপি) আওতায় প্রকল্পটি ২০১৬ সালে শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু এক্সপ্রেসওয়ে নকশা বদল, ভূমি অধিগ্রহণে জটিলতা, অর্থের সংস্থানসহ নানা জটিলতায় নির্মাণকাজ শেষ করার সময়সীমা পাঁচ বার পিছিয়েছে। তবে প্রকল্পের কাজ ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। প্রকল্পটিতে থাইল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ইতাল-থাই ডেভেলপমেন্ট পাবলিক কোম্পানির ৫১ শতাংশ, চীনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান শেনডং ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক অ্যান্ড টেকনিক্যা কো-অপারেশন গ্রুপের ৩৪ শতাংশ এবং সিনোহাইড্রো করপোরেশনের ১৫ শতাংশ মালিকানা রয়েছে। নির্মাণ-পরবর্তী সাড়ে ২১ বছর উড়াল সড়কের টোল আদায় করে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বিনিয়োগের টাকা তুলে নেবে। উল্লেখ্য, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ১৩ বছরে প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ৮ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা। প্রকৃত ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ৮৫৮ কোটি টাকা। নির্মাণ ব্যয় বৃদ্ধির প্রধান কারণ মূলত নকশা পরিবর্তন। প্রথম নকশায় হাতিরঝিলের ওপর দিয়েই এটি পরিকল্পনা করা হয়েছিল। পরে হাতিরঝিলের পাশ দিয়ে নকশা করা হয়। এতে খরচ বেড়ে যায়। এছাড়া পান্থকুঞ্জসহ কয়েকটি স্থানে র‌্যাম্প ও পিলার নিয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এবং রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) আপত্তির কারণে এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ থমকে যায়। কাজ থমকে থাকলেও মেইনটেনেন্স খরচ অব্যাহত থাকে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত