সারাদেশে পেট্রল পাম্প বন্ধ : চরম ভোগান্তি

চাপের মুখে নমনীয় জ্বালানি বিভাগ

প্রকাশ : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে পরিবহণ খরচ ও উৎপাদন ব্যয়ের বাড়তি চাপ পড়েছে মানুষ। এরই মধ্যে তিন দফা দাবিতে সারাদেশে পেট্রল পাম্পে ধর্মঘট দিয়েছে বাংলাদেশ পেট্রল পাম্প ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের একাংশ। চাপের মধ্যে তিন দাবির একটি মেনে নিয়েছে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। এরপরও ধর্মঘট প্রত্যাহার করেনি সংগঠনটি। তিনটি দাবি মেনে নেয়ার চাপ সৃষ্টি করেছে। যে কারণে গতকাল রোববার রাজধানীসহ সারাদেশে বিভিন্ন স্থানে অনির্দিষ্টকালের জন্য পেট্রল পাম্প বন্ধ রাখা হয়। ফলে চরম ভোগান্তিতে পড়ে সাধারণ মানুষ।

সরেজমিন রাজধানীর শনিরআখড়া, মৎস্যভবন, মতিঝিল, গাবতলী ও উত্তরা এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, জ্বালানি তেলের অভাবে পেট্রল পাম্পগুলো বন্ধ রয়েছে। ফলে যানবাহনে জ্বালানি তেলের সংকট তৈরি হয়েছে। তেল না পেয়ে ভোগান্তিতে পড়ে সাধারণ মানুষ। নারায়ণগঞ্জে ফতুল্লার পদ্মা ও যমুনা এবং সিদ্ধিরগঞ্জের গোদনাইল ও এসও বার্মা স্ট্যান্ড ডিপোতে এ কর্মসূচি পালন করা হয়।

জানা যায়, জ্বালানি তেল বিক্রির কমিশন সাড়ে ৭ শতাংশ নির্ধারণ করা, পেট্রল পাম্প ব্যবসায়ীদের কমিশন এজেন্ট হিসেবে প্রজ্ঞাপন জারি, ট্যাংক লরি ভাড়ার ওপর ভ্যাট বাদ দেয়ার দাবিতে ডিপো থেকে জ্বালানি তেল উত্তোলন ও পরিবহণ বন্ধ রেখেছে পেট্রল পাম্প মালিকদের একাংশ। এতে মজুত ফুরিয়ে যাওয়ায় পাম্পে জ্বালানি তেলের সংকট দেখা দিয়েছে। গতকাল সকালে গাড়িতে তেল নিতে এসে না পেয়ে ভোগান্তিতে পড়েন অনেকে। দুয়েকটা পাম্পে ডিজেল থাকলেও অকটেন একেবারেই নেই। ডিপোতে গেলেও লরিগুলো তেল উত্তোলন করেনি। বাংলাদেশ পেট্রল পাম্প ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের একাংশের তিন দাবির মধ্যে একটা মেনে নিয়েছে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। তেল বিপণনে বিপিসি অনুমোদিত জ্বালানি তেল ব্যবসায়ী এবং ডিলারদের কমিশন এজেন্ট হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু কমিশন না বাড়ানো পর্যন্ত পাম্প থেকে তেল তোলা বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছেন পাম্প মালিকদের একাংশ। জ্বালানি বিভাগের আশ্বাসে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কর্মসূচি বন্ধ রেখেছেন মালিকদের অন্য অংশ। সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন-বিপিসির সঙ্গে বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। তবে মোহাম্মদ নাজমুল হকের নেতৃত্বে থাকা অন্য অংশ ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছে। মালিকরা বলেছেন, ডিজেলের দুই ভাগ, পেট্রোলের তিন ভাগ এবং অকটেনের চার ভাগ কমিশন বাড়িয়ে সাড়ে সাত ভাগ করতে হবে। একই সঙ্গে তাদের শিল্প থেকে বাদ দিয়ে কমিশন এজেন্ট ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করতে হবে। এছাড়া পুরোনো ট্যাংক লরি অবসরের সময় ২৫ বছর থেকে বাড়াতে হবে। হরতাল আহ্বানকারী অংশ এক বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, আমাদের দীর্ঘদিনের দাবিগুলো বাস্তবায়ন না করে শুধু সময় ক্ষেপণ করা হচ্ছে। দাবিগুলো অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত ও সৎভাবে বেঁচে থাকার দাবি।

ধর্মঘট প্রত্যাহার জানিয়ে অন্য অংশ এক বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, বাংলাদেশ পেট্রল পাম্প ডিলার্স ডিস্ট্রিবিউটরস এজেন্টস অ্যান্ড পেট্রল পাম্প ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ নাজমুল হকের নেতৃত্বে সংগঠনের বেশ কয়েকজন নেতা ও সিলেট বিভাগসহ বাংলাদেশ ট্যাংক লরি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন ও বাংলাদেশ ট্যাংক লরি শ্রমিক ফেডারেশনের নেতাদের উপস্থিতিতে গত ২৯ আগস্ট বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের সভাপতিত্বে পেট্রল পাম্প মালিকদের সব দাবিদাওয়া বাস্তবায়নে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় আগামী ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে পেট্রল পাম্প মালিকদের সব ধরনের দাবিদাওয়া পূরণের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে আশ্বস্ত করা হয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হয়েছে। মালিক সমিতির একাংশের মহাসচিব মো. মিজানুর রহমান রতন বলেন, তারা ধর্মঘটে যাবেন। এই ধরনের আশ্বাস ২০২০ সাল থেকে তাদের দেয়া হচ্ছে। তিনি দাবি করেন, তারাই বৃহত্তর অংশ। ঢাকা, খুলনা, রাজশাহী, রংপুর ও চট্টগ্রাম বিভাগের একাংশের মালিক-শ্রমিকরা তাদের সঙ্গে রয়েছেন। সব মিলিয়ে তাদের সদস্য সাড়ে ৪ হাজারের মতো। অন্য অংশ ধর্মঘট থেকে সরে গেছেন, এ বিষয়ে তার প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি বলেন, তারা ধর্মঘট ভেঙে দেখাক পারলে। এদিকে মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, পেট্রল পাম্প ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের ‘কমিশন এজেন্ট ঘোষণা করা’ মেনে নিয়ে গেজেট প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এতে ধর্মঘট প্রত্যাহার হবে কিনা, জানতে চাইলে মিজানুর রহমান রতন বলেন, শুধু একটি দাবি মেনে নিয়েছে। মোট দাবি তিনটি। প্রধান দাবি উপেক্ষিত। সবার সঙ্গে কথা বলতে হবে। রাতের মধ্যে যোগাযোগ করা কঠিন, কাল ধর্মঘট থাকবে। হয়তো পরশু থেকে প্রত্যাহার হতে পারে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) হিসাবে, জ্বালানির মধ্যে শিল্প খাতে ডিজেলের ব্যবহার প্রায় ৭ শতাংশ। আবার যোগাযোগ খাতে জ্বালানির ব্যবহার ৬৩ শতাংশ, যার মধ্যে বেশির ভাগই ডিজেল। পেট্রল পাম্প বন্ধ থাকায় বেকায়দায় পড়েছে ভারি যানবাহন। শিল্প খাতে সাধারণত গাড়ি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে বছরভিত্তিক চুক্তি করে কোম্পানিগুলো। বিভিন্ন চুক্তি অনুযায়ী দেখা গেছে, পেট্রল পাম্প বন্ধ থাকায় চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ঢাকা পর্যন্ত ১৩ টন পণ্যবাহী গাড়ির ভাড়া ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত হয়েছে। ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের ডিপো পর্যন্ত রপ্তানি পণ্যবাহী গাড়ির ভাড়া ছিল ১৪ থেকে ১৫ হাজার টাকা। জ্বালানি সংকটে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ে ভারী শিল্পে। বিশেষ করে সিমেন্ট, রড, ঢেউটিন, সিরামিকসের মতো শিল্পের কাঁচামাল বন্দর থেকে কারখানায় নেয়া এবং কারখানা থেকে প্রস্তুত পণ্য সারা দেশে পরিবহণের জন্য দুই দফা বাড়তি খরচ গুনতে হয়। এসব খাতে পণ্য উৎপাদনে ডিজেলের ব্যবহার হয়, সেখানেও কিছুটা সংকট তৈরি হয়েছে। নোয়াখালী পেট্রল পাম্প মালিক সমিতির সভাপতি আবদুল হক বলেন, জ্বালানি তেল সংগ্রহে পেট্রল পাম্প মালিকদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত ধর্মঘট চলবে। ধর্মঘটের মধ্যেও যেসব পাম্প খোলা রাখা হয়েছিল সেগুলোতে অভিযান চালিয়ে বন্ধ করে দিয়েছি। কোনো পাম্পে জ্বালানি তেল বিক্রির খবর পাওয়া গেলে মালিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।