জানুয়ারিতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদের ভোট

রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নির্বাচনি আমেজ

প্রকাশ : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  আরিফুল ইসলাম

আগামী বছরের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই নির্বাচন উপলক্ষ্যে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও বাম রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নির্বাচনি আমেজ জমে উঠেছে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে দলগুলো সভা-সেমিনার ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের দিকে নজর দিচ্ছে।

জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সম্প্রতি রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচনি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমান বলেন, জানুয়ারি মাস সামনে রেখে নির্বাচনের সব প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। আশা করছি, নির্দিষ্ট সময়ে নির্বাচন করা সম্ভব হবে। এ সময় প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল ও অন্য তিন কমিশনার উপস্থিত ছিলেন।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষ্যে বিভিন্ন পর্যায়ের প্রায় ১০ লাখ জনবলকে প্রশিক্ষণ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। প্রশিক্ষককে প্রশিক্ষণ শুরু করার মধ্যদিয়ে মূলত নির্বাচন কমিশনের নির্বাচনি প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। এসব প্রশিক্ষক মাঠপর্যায়ে প্রিজাইডিং, সহকারী প্রিজাইডিং ও পোলিং অফিসারদের প্রশিক্ষণ দেবেন। জাতীয় সংসদ নির্বাচন কখন হবে, নির্বাচনের তফসিল কখন ঘোষণা হবে- এসব প্রশ্ন নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে যে ধোঁয়াশা ছিল ইসি আনিছুর রহমানের বক্তব্যের মধ্যদিয়ে তা স্পষ্ট হয়েছে। তার এই বক্তব্যের পর নির্বাচনি আমেজ বিরাজ করছে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে। সংসদীয় আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য আগ্রহী প্রার্থীরা এলাকাবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে ইতোমধ্যে পোস্টারিং করছেন। অনেকে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে গিয়ে দোয়া কামনা করছেন। গণসংযোগ বৃদ্ধি করছেন। জাতীয় নির্বাচন জোটগতভাবে অনুষ্ঠানের বিষয়টি অনেকটাই নিশ্চিত। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যে ১৪ দল রয়েছে তাদের নিয়েই আওয়ামী লীগ আগামী জাতীয় নির্বাচনে জোট গঠন করবে, এটা অনেকটাই নিশ্চিত। তবে বিএনপির সঙ্গে কোনো কোনো দল যাবে সে সম্পর্কে এখনো স্পষ্টভাবে কোনো ধারণা পাওয়া না গেলেও মনে করা হচ্ছে রাজপথের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির নেতৃত্বে যেসব দল আন্দোলন করছে তাদের নিয়েই বিএনপি জোট গঠন করতে পারে। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ছাড়া বিএনপি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যাবে না বলে যে শর্ত দিয়েছে, তা শেষ পর্যন্ত তা টিকবে না বলেই রাজনৈতিক সচেতন মহল মনে করছে। তারা বলেছে, বিএনপি গত দুটি নির্বাচনে কার্যত অংশ না নেয়ায় তারা সংসদীয় গণতন্ত্র থেকে ছিটকে পড়েছে। রাজনৈতিকভাবে তারা দুর্বল হয়ে পড়েছে। নির্বাচনের অংশ গ্রহণ করার মধ্যদিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার যে রীতিনীতি বাংলাদেশে বিরাজমান তা থেকে বিএনপি অনেক দূরে। তাই আগামী জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নিলে তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অনেকটা অনিশ্চিত হয়ে যাবে। সে কারণে আগামী জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি শেষ পর্যন্ত অংশ নেবে এবং তারা এরই মধ্যে ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতিও নিচ্ছে। আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণে ইচ্ছুক বিএনপির প্রার্থীদের তালিকাও তৈরি করা হয়েছে বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে। তবে এই তালিকা চূড়ান্ত করা হবে লন্ডনে বসে সেটাও অনেকটা নিশ্চিত। এতে রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির প্রধান রাজনৈতিক কার্যালয় প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করার সুযোগ এবারও হয়তো পাবে না। গত দুটি নির্বাচনে বিএনপির একাধিক প্রার্থীর মধ্য থেকে যেভাবে প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করা হয়েছে এবারও হয়তো তার ব্যতিক্রম হবে না। ফলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের প্রার্থী তালিকা প্রণয়নে তেমন একটা ভূমিকা থাকবে না।

এদিকে আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে মাঠ পর্যায়ের প্রস্তুতি শুরু করেছে আওয়ামী লীগ। দল ও সহযোগী সংগঠনকে তৃণমূল পর্যন্ত সুসংগঠিত করার পাশাপাশি নির্বাচনকেন্দ্রিক কাজগুলো এগিয়ে নিচ্ছে দলটি। নির্বাচনি ইশতেহার তৈরির কাজও চলছে বলে জানা গেছে।

নির্বাচন সামনে রেখে অপপ্রচারের জবাব দিতে ও উন্নয়ন প্রচারে মাঠে নামার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আওয়ামী লীগ। এছাড়া দলীয় প্রার্থী বাছাই আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু না হলেও বিভিন্ন জরিপ এবং তথ্য সংগ্রহের মাধমে ভেতরে ভেতরে এ কাজ এগিয়ে রাখছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ভোটের আগে জোটের মেরুকরণের প্রতিও নজর রাখছেন দলটির হাইকমান্ড। আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে ও দলীয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য লে. কর্লেন (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান বলেছেন, প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সব সময় নির্বাচনের পক্ষে। ইতোমধ্যে আমাদের নির্বাচনি ইশতেহার তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। আমাদের দলের নেতারা সুশীল সমাজ, যুবক-তরুণ ও বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষদের কথা শুনছেন। তারা দেশটাকে কীভাবে দেখতে চায়, সেই তথ্যগুলো আমরা নিচ্ছি। এগুলো আমাদের নির্বাচনি ইশতেহারে থাকবে। তিনি বলেন, নির্বাচন সামনে রেখে আমরা বিএনপি-জামায়াতের অপপ্রচারের বিরুদ্ধে জনগণের কাছে সত্য তুলে ধরব। একই সঙ্গে আমাদের সময়ে যে উন্নয়নগুলো হয়েছে সেগুলো তৃণমূলে গিয়ে মানুষকে জানাব। বিএনপি যে কখনো গণতন্ত্র ও নির্বাচনে বিশ্বাস করে না, তার প্রমাণগুলো আমরা তুলে ধরব।

বিএনপির দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। বাংলাদেশে সংবিধান অনুযায়ী আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে জানিয়ে তথ্যমন্ত্রী বলেন, নির্বাচন কমিশন স্বাধীন, তারা কখন নির্বাচনি তফসিল ঘোষণা করবে এটি তাদের এখতিয়ার। নির্বাচন কমিশন যে সময় তফসিল ঘোষণা করবে আমরা; বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সে অনুযায়ী নির্বাচন করার জন্য প্রস্তুত আছি। আমাদের প্রস্তুতি চলছে।

তিনি বলেন, বিএনপির উদ্দেশ্য হচ্ছে, সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা, গণতন্ত্রকে ভূলুণ্ঠিত করা। যেটি তারা ২০১৪ সালে করার চেষ্টা করেছিল। ২০১৮ সালের নির্বাচনে গিয়েও নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করেছে।

একটি সূত্র জানায়, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পতন ও নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনে রয়েছে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট। তবে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্ততিতেও পিছিয়ে নেই দলটি। এরই মধ্যে প্রতিটি নির্বাচনি এলাকায় দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত করার কাজ এগিয়ে রেখেছে অনেকটাই।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, বিএনপি নির্বাচনমুখী দল। নির্বাচনের মাধ্যমেই আমরা কয়েকবার সরকার গঠন করেছি। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচনের বিকল্প কিছু নেই। আমরা নির্বাচনে অবশ্যই অংশ নেব, তবে তা হতে হবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। আন্দোলন করে তা আদায় করার পর নির্বাচনের বিষয়টি সামনে আসবে।

বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের নির্বাচনের প্রস্তুতির বিষয়টি দৃশ্যমান না হলেও প্রতিটি নির্বাচনি এলাকাকেন্দ্রিক আলাদা আলাদা জরিপ এবং প্রার্থী বাছাইয়ের বিষয়ে কাজ করছে দলের একটি উইং। বিএনপির নেতারা জানিয়েছেন, আন্দোলনে বিজয় ও নির্বাচনের বিষয়টি সামনে চলে আসলে প্রার্থী বাছাইয়ে দলকে কোনোভাবেই বেগ পেতে হবে না।

বিএনপির নেতারা মনে করেন, আন্দোলনে সফল হলে নির্বাচনের মাঠে জোয়ার এমনিতেই আসবে। ২০০১ সালের অস্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের উদাহরণ তাদের সামনে রয়েছে।

বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মজিবর রহমান সরোয়ার বলেন, আমরা যত সাংগঠনিক কার্যক্রম করছি, সবই নির্বাচনের প্রস্তুতির অংশ। মানুষ হাজার বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে বিএনপির সমাবেশে অংশ নিচ্ছে।

অন্যদিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনে লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে জাপা। এ ক্ষেত্রে দলের ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়ন করা হবে। যারা সাংগঠনিকভাবে ভালো কাজ করবেন নির্বাচনে তাদের অগ্রাধিকার দেবে দলটি।

জাপা চেয়ারম্যান জিএম কাদের বলেন, আমরা ৩০০ আসনে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছি। শুধু প্রার্থী হতে চাইলেই হবে না, ত্যাগীদের মূল্যায়ন করা হবে। অবস্থা বুঝে আমাদের ব্যবস্থা নিতে হবে। সাংগঠনিকভাবে যারা ভালো কাজ করবেন, তাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রার্থিতা দেয়া হবে।