চট্টগ্রামে অরক্ষিত খাল ও নালা যেন মৃত্যুকূপ

দায় নিচ্ছে না চসিক-সিডিএ

প্রকাশ : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  সাইফুদ্দিন তুহিন, চট্টগ্রাম

চট্টগ্রাম নগরীর খোলা ও অরক্ষিত খাল ও ড্রেনে পড়ে মৃত্যু থামছেই না। খোলা ড্রেন ও খাল যেন মরণফাঁদ। গেল কয়েক বছরে খাল-নালায় পড়ে মারা গেছে ৯ জন। সবগুলো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে নগরী এবং নগরীর কাছের এলাকায়। এখন বৃষ্টি হলেই মৃত্যুর আতঙ্ক তাড়া করে নগরবাসীকে। চলতি বর্ষা মৌসুমে খাল নালায় পড়ে বেশ কয়েকজন শিশুর মৃত্যু হয়। সর্বশেষ চট্টগ্রাম নগরীর এক খাল থেকে এক শিশুর মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। নিখোঁজ হওয়ার একদিন পর ৫ বছর বয়সি শিশু মো. আবদুলের লাশ ২ সেপ্টেম্বর রাতে নগরীর ডবলমুরিং থানার সিডিএ আবাসিক এলাকার খাল থেকে উদ্ধার করা হয়। নগরীর হালিশহর থানার পাঁচতলা এলাকার শফিক কলোনির কামালের ছেলে আবদুল। পরিবারের ধারণা-শিশুটি খেলতে গিয়ে খালে পড়ে যেতে পারে। এর আগে ২৭ আগস্ট চট্টগ্রামের উত্তর আগ্রাবাদের রঙ্গিপাড়া এলাকার নালায় পড়ে দেড় বছরের শিশু ইয়াছিন আরাফাতের মৃত্যু হয়। নগরীর উন্মুক্ত নালা-নর্দমায় পড়ে দুই বছরে শিক্ষার্থী, নারী, শিশু ও ব্যবসায়ীসহ সাতজনের মৃত্যু হয়। সালেহ আহমেদ নামে একজনের খোঁজ মেলেনি এখনো। তিনি ২ বছর আগে মুরাদপুর এলাকায় পা পিছলে খালে পড়ে যান। তার সন্তানরা এখনো বাবার মরদেহের খোঁজ পেতে ধরনা দিচ্ছেন সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের কাছে।

শিশু আবদুলের পরিবারের সদস্যরা জানায়, গেল শুক্রবার বিকাল ৩টার দিকে খেলতে গিয়ে আবদুল নিখোঁজ হয়। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তাকে পাওয়া যায়নি। এলাকার শফিক কলোনির পাশের খালে শিশুটি পড়ে যায় বলে তাদের ধারণা। খালে শিশুটির লাশ ভাসমান অবস্থায় দেখতে পেয়ে তার দাদা আবদুল মান্নান চমেক হাসপাতালে নিয়ে যান। ডবলমুরিং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাখাওয়াত হোসেন বলেন, শিশু নিখোঁজ হওয়ার বিষয় আমরা ঘটনার দিনই অবহিত হই। শিশুটির বাসা হালিশহর থানার বাদশা মিয়া ব্রিকফিল্ড রোড এলাকায়। ডবলমুরিং থানার সিডিএ ৪ নম্বর রোডের মুখে খাল থেকে মরদেহ পাওয়া গেছে। তার বাসা থেকে এ এলাকার দূরত্ব আধা কিলোমিটার। মা-বাবার ধারণা, শিশুটি খেলতে গিয়ে খালে পড়ে গেছে। ওসি আরো বলেন, এ ঘটনায় থানায় অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে। ময়নাতদন্ত রিপোর্টে অন্য কিছু পাওয়া গেলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। এর আগে গত ৭ আগস্ট হাটহাজারী সরকারি ডিগ্রি কলেজের ছাত্রী নিপা পালিত (২১) পরীক্ষা দেয়ার জন্য বের হলে অসাবধানতাবশত ড্রেনে পড়ে যান। স্থানীয় লোকজন তাকে উদ্ধার করেন। ততক্ষণে তার মৃত্যু হয়। নিপা পালিত সিটি করপোরেশনের ১ নম্বর ওয়ার্ডের হাটহাজারী উপজেলার নন্দিরহাট ইসলামিয়াহাট বাদামতল এলাকার উত্তম পালিতের মেয়ে। তার মতো নগরীতে গত কয়েক বছরে নালা ও গর্তে পড়ে ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। এরপরও এসব খাল ও ড্রেন সংস্কার করে ঝুঁকিমুক্ত করার কোনো উদ্যোগ নেই। চসিক সূত্র জানায়, নগরীতে মোট ৫৭টি খাল এবং ৭৬৫ কিলোমিটার ড্রেন রয়েছে। ২০২১ সালে ড্রেন, খাল ও ফুটপাতের ঝুঁকিপূর্ণ স্থানগুলোর ওপর জরিপ চালায় সিটি করপোরেশন। জরিপের পর ৫ হাজার ৫২৭টি ঝুঁকিপূর্ণ স্থান চিহ্নিত করা হয়, যার আয়তন ছিল ১৯ কিলোমিটার। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত গত সাত বছরে নগরীর অরক্ষিত ড্রেন ও খালে পড়ে অন্তত ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন বহু লোক। এর মধ্যে ২০২১ সালের ২৫ আগস্ট মুরাদপুর মোড়ে চশমা খালে পানির স্রোতে পা পিছলে পড়ে ডুবে যান সালেহ আহমেদ (৫০) নামে এক সবজি ব্যবসায়ী। তার লাশ এখনও পায়নি পরিবার। একই বছরের ৭ ডিসেম্বর ষোলশহর রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় একই খালে পড়ে যায় কামাল উদ্দিন (১০) নামে এক শিশু। নিখোঁজের তিন দিন পর তার লাশ উদ্ধার হয়।

বন্দর নগরী চট্টগ্রামের অধিকাংশ খাল ও ড্রেন রয়েছে খোলা এবং অরক্ষিত অবস্থায়। ২০২১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর নগরীর আগ্রাবাদ মোড়ে ড্রেনে পড়ে শেহেরিন মাহমুদ সাদিয়া (১৯) নামে চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক ইসলামিক ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের এক শিক্ষার্থী মারা যান। ২০২১ সালের ৩০ জুন ষোলশহরের চশমা পাহাড় এলাকায় অটোরিকশা খালে পড়ে তিনজন নিখোঁজ হন। পরে চালক সুলতান (৩৫) ও যাত্রী খাদিজা বেগমের (৬৫) মরদেহ উদ্ধার করা হয়। বাকি একজনকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। চলতি বছরের ৯ এপ্রিল সদরঘাট নালাপাড়া এলাকায় অরক্ষিত ড্রেনে পড়ে তিন বছরের শিশু ওজাইফা মারা যায়। ২০২২ সালের ১৫ এপ্রিল ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরিরা শহরের কালুরঘাট এলাকার ওসমানিয়া খাল থেকে অর্ধডুবন্ত অবস্থায় এক নারীকে উদ্ধার করে। এর আগে ২০১৮ সালের ৯ জুন নগরীর আমিন জুট মিল এলাকায় আল আমিন নামে এক শিশু ড্রেনে পড়ে যায়। পরে তাকে উদ্ধার করা হয়। হাটহাজারী উপজেলার অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা শীলব্রত বড়ুয়া ২০১৭ সালের ৩ জুলাই বাকলিয়ায় একটি কমিউনিটি সেন্টারে বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়ে পা পিছলে নালায় পড়ে আহত হন। সরেজমিন দেখা গেছে, গত আগষ্টে ভারি বর্ষণের চট্টগ্রামে ভয়াবহ জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। পানিতে নালা-খাল এবং সড়ক পানিতে একাকার হয়ে যায়। জলাবদ্ধতায় কোনটা সড়ক এবং কোনটা খাল-নালা, তা দেখা যায় না। যে কারণে সড়ক মনে করে খাল-নালায় পা দিয়ে তলিয়ে যান লোকজন। এখনো নগরীর মুরাদপুর, ২ নম্বর গেটসহ নগরীর বিভিন্ন স্থানে খোলা খাল-ড্রেন রয়েছে। যেগুলোতে ঘটছে দুর্ঘটনা। বিশেষ করে নগরীর অন্যতম প্রধান সড়ক মুরাদপুর থেকে বহদ্দারহাট পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশের ড্রেন অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। ফুটপাতের পাশের বিশাল ড্রেনগুলো এখনো খোলা। পথচারীরা ড্রেনে পড়ার ঝুঁকি নিয়ে ফুটপাত পার হচ্ছেন। এ ব্যাপারে নগরীর হালিশহর এলাকার বাসিন্দা ফজলুল হক জানান, খাল নালার ঝুঁকি কমাতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর দায় অনেক বেশি। ঝুঁকি কমানো মানে হাঁটতে গেলেই পা সটকে পড়ে যাওয়া বন্ধ করতে হবে। এজন্য নিরাপত্তার সবগুলো নিয়ম অনুসরন করতে হবে। দেয়া প্রয়োজন নিরাপত্তা দেয়াল। কিন্তু সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো দায় আছে বলে মনে হয় না। চসিক-সিডিএ’র অবহেলার কারণে এসব মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। দুই সংস্থার গাফিলতির কারণে এসব মৃত্যুকূপ সংস্কার হচ্ছে না। নগরীর বাদুরতলা এলাকার বাসিন্দা ফিরোজ আহমদ বলেন, বর্ষাকালে মৃত্যুর ঘটনা ঘটলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর তৎপরতা শুরু হয়। এরপর সারা বছর কোনো তৎপরতা থাকে না। এজন্য খাল-নালায় পড়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নিলে একের পর এক মৃত্যুর ঘটনা ঘটতেই থাকবে।