ঢাকায় রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী

অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদারের তাগিদ

আজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক

প্রকাশ : ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

দুই দিনের সফরে ঢাকায় পৌঁছেছেন রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ। তার এই সফরকে ঐতিহাসিক হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। কারণ, মস্কোর ইতিহাসে বাংলাদেশ সফরকারী প্রথম রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী হলেন ল্যাভরভ। গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ল্যাভরভকে স্বাগত জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন। এ সময় ঢাকায় নিযুক্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আলেক্সান্ডার মান্টিটস্কি উপস্থিত ছিলেন। বিমানবন্দর থেকে ল্যাভরভ রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ওঠেন। সেখানেই দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনুষ্ঠানিক বৈঠক হয়েছে। দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় দুই দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ ও রাশিয়ার পারস্পরিক সম্পর্ক জোরদার, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের অগ্রগতি, প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ অব্যাহত থাকছে। পাশাপাশি ইউক্রেন পরিস্থিতি, ভূরাজনীতি, খাদ্য নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনায় হয়েছে। এছাড়া রাশিয়া থেকে গম এবং সার আমদানির বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছে ঢাকা।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বৈদেশিক শক্তির তালিকায় বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের বিজয়কে ত্বরান্বিত করেছিল রাশিয়া। বাংলাদেশের ইতিহাসে রাশিয়ার ভূমিকা গুরুত্বসহকারে দেখা হয়। তবে বর্তমানে ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়া যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ায় যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের চাপে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে রাশিয়া। এমন পরিস্থিতিতে বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা বাড়াতে জোর দিচ্ছে মস্কো। আর এর দায়িত্ব কাঁধে পড়েছে মস্কোর শীর্ষ কূটনীতিক সের্গেই ল্যাভরভের, যিনি রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বে রয়েছেন।

কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার পর পশ্চিমা চাপে কোণঠাসা রাশিয়া আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা বাড়ানোর বিষয়টি জোর দিচ্ছে। পরিবর্তিত ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বন্ধুত্ব ঝালাইয়ের পাশাপাশি নতুন বন্ধু খোঁজাও রাশিয়ার অগ্রাধিকার। সে ক্ষেত্রে ঐতিহাসিকভাবে পরীক্ষিত বন্ধুপ্রতিম বাংলাদেশকে স্বাভাবিকভাবেই পাশে চাইছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে ভারত ও রাশিয়ার মৈত্রী চুক্তির সুবিধা পেয়েছিল বাংলাদেশ। এই চুক্তির কারণেই চীন ও আমেরিকার মতো শক্তিধর দেশগুলো পাকিস্তানের পক্ষে হস্তক্ষেপ করতে পারেনি। বাংলাদেশের দুর্দিনে রাশিয়ার বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়- রাশিয়া সব সময় বাংলাদেশের পাশে ছিল, আছে এবং থাকবে। বর্তমানে ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের মধ্যেও বাংলাদেশ নিয়ে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছে দেশটি। সেজন্যই ভারতের নয়াদিল্লিতে জি-২০ সম্মেলনে যাওয়ার আগে গতকাল বাংলাদেশে এসেছেন রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ। আজ সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তার সৌজন্য সাক্ষাৎ হবে।

ঐতিহাসিক বন্ধুত্বে যেন কোনো পরাশক্তির কারণে চিড় না ধরে, সেই বার্তা দিতেই সংক্ষিপ্ত সফরে গতকাল সন্ধ্যায় ঢাকায় আসেন রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ল্যাভরভ। স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর মস্কোর কোনো পররাষ্ট্রমন্ত্রী এই প্রথম বাংলাদেশ সফরে আসছেন।

ঢাকা-মস্কো দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ঝালাইসহ বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ল্যাভরভের এ সফরের রাজনৈতিক গুরুত্ব অনেক বলে মনে করছেন ঢাকার কূটনীতিবিদরা। তারা বলেছেন, মস্কোর সঙ্গে ঢাকার যে ঐতিহাসিক সম্পর্ক, তা যেন অটুট থাকে এবং সামনের দিনেও বাংলাদেশ যেন দেশটির পাশে থাকে সেই বার্তা সম্ভাব্য বৈঠকগুলোতে ল্যাভরভ দেবেন বলে মনে করা হচ্ছে।

দায়িত্বশীল এক কূটনীতিকের ভাষ্য, আন্তর্জাতিক ফোরামগুলোতে রাশিয়া এখন অনেকটাই বিছিন্ন হয়ে পড়েছে। অন্যান্য প্রভাবশালী পরাশক্তির কারণে যেন ঢাকার অবস্থান পরিবর্তন না হয়, সেটাই হয়তো মস্কোর চাওয়া থাকবে। অনেক কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে বাংলাদেশ কিন্তু পরোক্ষভাবে রাশিয়াকে সমর্থন দিয়ে গেছে। আমরা ভোট দেয়া থেকে বিরত থাকছি। সেটা কিন্তু ঠিকই রাশিয়ার পক্ষে যাচ্ছে।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনায় রাশিয়ার ৬৯টি জাহাজকে যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি ল্যাভরভ তুলবেন বলে ইঙ্গিত রয়েছে। এক্ষেত্রে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য মালামাল নিয়ে আসা রুশ জাহাজকে যে পরিমাণ ঝামেলায় পড়তে হয়েছে, তা গুরুত্ব দিয়ে আলোচনায় তুলবেন ল্যাভরভ।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে বলেন, রাশিয়ার ইকোনমিক অপারেটরস আছে। জাহাজ রুশদের একটি ইকোনমিক অপারেটরস। রাশিয়ার যে ৬৯টা জাহাজে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, সেটা লিফট করার ব্যাপারে তারা বলতে পারে। তাদের যুক্তি হতে পারে ওটা দ্বিপক্ষীয় নিষেধাজ্ঞা, তা বাংলাদেশ কেন পালন করতে যাবে। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা কেন মানবে বাংলাদেশ, সেটাই হয়তো তাদের প্রশ্ন হতে পারে। কিন্তু এটার উত্তর আমাদের কাছে নেই।

কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলেছে, ঢাকা-ওয়াশিংটনের সম্পর্কে যে টানাপড়েন তৈরি হয়েছে, তার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ মস্কোর সঙ্গে সম্পর্ক অটুট রাখা। আর মস্কোর দিক থেকে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার তালিকায় থাকা জাহাজকে বাংলাদেশে ভিড়তে না দেয়ায় বিপদ হয়েছে ঢাকার জন্য। কেন না, ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের কূটনৈতিক পত্র পেয়ে রুশ জাহাজকে ফিরিয়ে দেয়া হয়। এক জাহাজকে কেন্দ্র করে ঢাকা-মস্কো সম্পর্কে অনেক ঘটনাই ঘটে গেছে। রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরে ঢাকা-মস্কোর মধ্যে কোনো চুক্তি হবে না। তবে দ্বিপক্ষীয় লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্কের আওতায় দুই দেশের মধ্যে ঝুলে থাকা চুক্তির অগ্রগতি নিয়ে আলোচনার সুযোগ থাকছে বলে মনে করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

ঢাকার কূটনৈতিক অঙ্গন সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে বৈশ্বিক মেরুকরণ চলছে। এমন পরিস্থিতিতে অনেক হিসাব কষেই চলতে হচ্ছে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোকে। সম্পর্ক রক্ষায় করতে হচ্ছে ভারসাম্য। এছাড়া বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সতর্ক থাকতে হচ্ছে ঢাকাকে।

ল্যাভরভ আজ সকালে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদেন করবেন। এরপর তিনি গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে জি-২০ সম্মেলনে যোগ দিতে ঢাকা থেকে নয়াদিল্লির উদ্দেশে রওনা করবেন রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

এ বিষয়ে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেন, রাশিয়ার সঙ্গে আমাদের অনেক দিনের সম্পর্ক। সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক বিশ্বের যেসব জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, বিশেষ করে ইউক্রেন সংকটের পর থেকে; সেগুলো নিয়ে আলোচনা হবে। আমরা রাশিয়াকে একটা অনুরোধ করতে পারি, দ্রুত যেন একটা শান্তিপূর্ণ সমাধান বের করা যায়।

ল্যাভরভের সঙ্গে আলোচনায় খাদ্য, সার ও ফুয়েলের মতো বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে বলে জানান মাসুদ বিন মোমেন। তিনি বলেন, আমাদের যে সমস্যা রয়েছে তা আমরা তুলে ধরব।

মস্কোতে ল্যাভরভের ঢাকা সফর নিয়ে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাকারোভা জানান, সফরে বাংলাদেশের সঙ্গে রাশিয়ার বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ‘আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক’ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হবে।

পরিবর্তিত ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ছাপিয়ে প্রথম রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরে ঐতিহাসিক সম্পর্ককে আগে রাখতে চান সাবেক রাষ্ট্রদূত ওয়ালিউর রহমান। সাবেক এ রাষ্ট্রদূত বলেন, রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বাংলাদেশে এ প্রথম সফর। এটা আমাদের জন্য অনেক বড় একটা দিন। সোভিয়েত ইউনিয়নের সময়ে আমাদের সম্পর্ক খুব গভীর ছিল। তারপর যখন রাশিয়া ফেডারেশন হলো, তখনও আমাদের সম্পর্ক খুব ভালো। কথা হচ্ছে, রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফর কেন গুরুত্বপূর্ণ? সোভিয়েত ইউনিয়ন আমাদের যুদ্ধের সময় সঙ্গে ছিলেন এবং তারা ৮ আগস্ট ১৯৭১ ভারতের সঙ্গে একটা ফ্রেন্ডশিপ ট্রিটি করল। সেই ট্রিটির বলে তারা ভারতকে সাহায্য করেছে এবং আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে একটা প্রপিটেবল পর্যায়ে নিয়ে আসতে সাহায্য করেছে।

রাষ্ট্রদূত ওয়ালিউর রহমান বলেন, ১৬ ডিসেম্বর যে আমরা বিজয় দিবস পালন করছি, তার প্রেক্ষাপটেও রাশিয়ার ভূমিকা রয়েছে। ওই সময় জাতিসংঘে তারা যদি ভেটো না দিত ১৬ ডিসেম্বর মিত্র বাহিনীর আত্মসমর্পণ হয় না। সৌভিয়েত থেকে রাশিয়া হলেও তাদের চরিত্র একই রয়ে গেছে। ল্যাভরভকে ওই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা স্বাগত জানাব, সম্মান দেব।