ঢাকা ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৯ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বাংলাদেশ ত্যাগ

কূটনৈতিক সাফল্যে উজ্জীবিত ঢাকা

কূটনৈতিক সাফল্যে উজ্জীবিত ঢাকা

রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভের ঢাকা সফরে বাংলাদেশ কূটনৈতিক সাফল্যে অনেকটাই উজ্জীবিত হয়েছে। কারণ বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দুই দেশের সম্পর্ক আরো মজবুত হয়েছে। যাকে উভয়পক্ষই অর্থপূর্ণ বলেছে। গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মধ্যে বৈঠক শেষে গতকাল শুক্রবার গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ল্যাভরভ। এ সময় আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দ্রুত বন্ধের উপায় খুঁজে বের করার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরে প্রধানমন্ত্রীর উপ-প্রেস সচিব হাসান জাহিদ তুষার সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। সেখানে বলা হয়েছে- প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যুদ্ধ বন্ধ এবং শান্তিপূর্ণ প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। কারণ কোভিড মহামারি যুদ্ধ এবং নিষেধাজ্ঞা-পাল্টা নিষেধাজ্ঞার ফলে সৃষ্ট খাদ্য ও জ্বালানি সংকটে সারা বিশ্বে ভোগান্তি হচ্ছে।

যুদ্ধ, নিষেধাজ্ঞা-পাল্টা নিষেধাজ্ঞার কারণে সৃষ্ট খাদ্য-শস্য, সার, জ্বালানি সংকটে আফ্রিকাসহ স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো যে অর্থনৈতিক ঝুঁকিতে পড়েছে তা বিশেষভাবে বিবেচনা করার আহ্বান জানিয়ে তা থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজে বের করার কথাও বলেন শেখ হাসিনা। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ইস্যুতে বাংলাদেশে অবস্থানের প্রশংসা করে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ বলেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ ইস্যুতে বাংলাদেশের অবস্থান ভারসাম্যপূর্ণ এবং দায়িত্বশীল। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেওয়া ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়’ এই পররাষ্ট্র নীতির কথা উল্লেখ করেন। এই নীতিকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করে অর্থনীতিসহ বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নে সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে কাজ করছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানো, যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে মাইন অপসারণে রাশিয়ার অবদানের কথা স্মরণ করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, রাশিয়া বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত এবং পরীক্ষিত বন্ধু। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৭২ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ১৯৮২ সালে ও ২০১৩ সালে তার নিজের রাশিয়া সফরের কথা উল্লেখ করেন। দুই দেশের সম্পর্ককে আরো জোরদার করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন প্রধানমন্ত্রী এবং রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী। একইসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী রাশিয়াকে বাংলাদেশে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির আহ্বান জানান। আসন্ন অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য প্রথম ধাপে ‘পারমাণবিক জ্বালানি’ আসবে। এ উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লামিদির পুতিনকে ভার্চুয়ালি অংশগ্রহণ করার আমন্ত্রণ জানান প্রধানমন্ত্রী। এ সময় রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আর্থ-সামাজিক, অবকাঠামোসহ বাংলাদেশের সার্বিক অগ্রগতির প্রশংসা করেন। বাংলাদেশের সঙ্গে রাশিয়ার তিন লাখ টন গম আমদানি চুক্তির কথা উল্লেখ করে সারের ব্যাপারেও দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির উপায় খুঁজে বের করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন প্রধানমন্ত্রী।

এর আগে গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেনকে পাশে রেখে ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ল্যাভরভ বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের চাপের পরও জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করায় বাংলাদেশের প্রশংসা করেন। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের পর দ্বিতীয় বৃহত্তম অংশীদার বাংলাদেশের সঙ্গে রাজনৈতিকসহ সর্বস্তরে সম্পর্ক জোরদারে আগ্রহী রাশিয়া। একইসঙ্গে দুই দেশের ব্যবসা ও বিনিয়োগ বাড়ানো, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ এগিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি গাজপ্রমের গ্যাসকূপ খনন অব্যাহত রাখা, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহসহ দ্বিপক্ষীয় নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। রাশিয়া থেকে ভবিষ্যতে গম ও সার বিক্রির বিষয়ে স্থায়ী রূপরেখা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই ভারতের পাশাপাশি বাংলাদেশের বন্ধু রাষ্ট্র হচ্ছে রাশিয়া। বাণিজ্যিকভাবে দুই দেশ এতটাই জড়িয়ে গেছে যে তাতে কোনো ছেদ পড়লে ভালোর চেয়ে মন্দই হবে। সেজন্য যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া নিষেধাজ্ঞার পর রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মালামাল নিয়ে আসা ৬৯ রুশ জাহাজের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রুশ পরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে একান্ত বৈঠক, যৌথ সাংবাদিক সম্মেলন ও নৈশভোগে আলাপচারিতায় বিভিন্ন বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরেন। দুই ঘণ্টার দ্বিপক্ষীয় বৈঠক এবং পরবর্তীতে মস্কোর সঙ্গে ঢাকার গভীর সম্পর্কের বিষয়টি উঠে এসেছে। ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশও ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষয়ক্ষতি এবং পরাশক্তিগুলোর প্রতিযোগিতাকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলে ছায়া যুদ্ধ পরিহারের বিষয়টিও স্থান পায়।

রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তারা ঢাকা ও মস্কোর মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্পর্ক বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে, কারণ ভারতের পর বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় রাশিয়ার সবচেয়ে বড় অংশীদার।

ল্যাভরভ বলেন, রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান খুঁজতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে অব্যাহত আলোচনাকে সমর্থন করে রাশিয়া। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন এবং তা ধারাবাহিকভাবে বাস্তবায়নের ওপর জোর দিয়েছেন।

বাংলাদেশ সংলাপ এবং আলোচনার মাধ্যমে যে কোনো সংকট সমাধানের পক্ষে নিজেদের অবস্থানের কথা তুলে ধরার সুযোগ পেয়েছে। রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার বক্তব্যে বাংলাদেশের প্রতি মস্কোর সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন। যৌথ সংবাদ সম্মেলন শেষে নৈশভোজে অংশ নেন মোমেন-ল্যাভরভ। সেখানেও টেবিল তারা জাতিসংঘ, আঞ্চলিক ও অন্যান্য বৈশ্বিক ফোরামে সমর্থন ও সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা করেন। সফরের দ্বিতীয় দিন ল্যাভরভ গতকাল শুক্রবার সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন এবং ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানান।

ল্যাভরভের উপস্থিতিতে স্পষ্ট ভাষায় মোমেন বলেন, পরাশক্তিগুলোর প্রতিযোগিতাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ এ অঞ্চলে ছায়া যুদ্ধ দেখতে চায় না। বাংলাদেশ সংলাপ এবং আলোচনার মাধ্যমে যে কোনো সংকট সমাধানের পক্ষে রয়েছে।

মোমেন বলেন, রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ

সফরে আসায় ঢাকা অত্যন্ত আনন্দিত। কারণ রাশিয়ার সঙ্গে আমাদের

গভীর সম্পর্ক রয়েছে।

তিনি বলেন, আমরা যুদ্ধ চাই না। আমরা কোথাও কোনো প্রক্সি ওয়ারও দেখতে চাই না। আমরা চাই সংলাপ ও আলোচনার মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান হোক। আমরা আমাদের নিজস্ব স্বার্থ অনুসরণ করে চলি এবং আজ পর্যন্ত আমরা স্বাধীন নীতি বজায় রেখেছি।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরো বলেন, ল্যাভরভের সঙ্গে আলাপকালে

তিনি রোহিঙ্গা ইস্যু, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ এবং রাশিয়ার বৃহত্তর

বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের প্রবেশাধিকার নিয়ে আলোচনা

করেছেন। নিষেধাজ্ঞাসহ বিভিন্ন উপায়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে বাংলাদেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের চাপ আছে কি না জানতে চাইলে আব্দুল মোমেন বলেন, আমাদের পররাষ্ট্রনীতি হচ্ছে ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়।’ আমরা ভারসাম্য কূটনীতি মেনে চলার চেষ্টা করি।

আমরা আমাদের আগ্রহকে গুরুত্ব দিই। আমরা স্বাধীন ও সার্বভৌম সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকি।

আব্দুল মোমেন বলেন, আমাদের আলোচনার মধ্যে অনেক ইস্যু উঠে এসেছে। আমাদের ইস্যু ছিল রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, এটা মোটামুটি যথা সময়ে শেষ হবে। রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এ ইস্যুতে তারা (রাশিয়া) আমাদের সঙ্গে একাত্ম।

রাশিয়া বাংলাদেশকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস এবং অপরিশোধিত তেল আনার প্রস্তাব দিয়েছে এমন মন্তব্য করে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তাদের দেশ থেকে আমরা এলএনজি আনতে পারি। তারা আমাদের প্রস্তাব করেছেন, তাদের দেশ থেকে অপরিশোধিত তেল আনতে পারি।

ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশও ব্যবসা-বাণিজ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানান আব্দুল মোমেন। তিনি বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে অসুবিধা সৃষ্টি হয়েছে, সেটি তুলে ধরেছি। আমরা বলেছি, তাদের দেশে অর্থনৈতিক একটা কমিশন আছে, আমরা তার সুবিধা নিতে চাই। বাকি রাষ্ট্র যারা সদস্য, বিশেষ করে কাজাখস্তান, তাদের অনুমতি লাগবে। সবাই মিলে যেন সিদ্ধান্ত নেয়।

এর আগে গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তা থেকে বিশেষ ফ্লাইটে ল্যাভরভ ঢাকায় এসেছিলেন। তখন ঢাকার

হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ল্যাভরভকে স্বাগত জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন। কারণ কোনো রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এটাই প্রথম ঢাকা সফর ছিল। আর গতকাল দ্বিপক্ষীয় সফরের সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে দুপুরে ঢাকার হযরত শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে বিশেষ ফ্লাইটে দিল্লির উদ্দেশে রওনা হন ল্যাভরভ।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত