তৃণমূল নেতৃত্বকে অবমূল্যায়নের অভিযোগ

ঢাবি-কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সম্পর্কে টানাপড়েন

প্রকাশ : ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  লিটন ইসলাম, ঢাবি প্রতিনিধি

নতুন কমিটি ঘোষণা হওয়ার এক বছর না পেরোতেই সম্পর্কে টানাপড়েন শুরু হয়েছে আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ‘নিউক্লিয়াস’ খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে। গত জুলাইয়ে ঘোষিত সংগঠনের কেন্দ্রীয় সংসদের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের অনুসারীদের কম পদায়ন; অধিভুক্ত সাত কলেজকে ঢাবি শাখার অধীনে আসা নিয়ে টানাটানি; ছাত্র সমাবেশ সফল করতে ঢাবি ছাত্রলীগকে অর্থ না দেয়া; কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ হস্তক্ষেপমুক্ত ঢাবি শাখা এবং সর্বশেষ ১ সেপ্টেম্বরের ছাত্র সমাবেশে ঢাবি শাখাকে একপেশে রেখে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রাধান্য দেয়া ও তৃণমূল নেতৃত্বকে অবমূল্যায়নের অভিযোগে তাদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের বিষয়টি জোরাল হয়। এতে সংগঠনের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির আশঙ্কা করছেন ছাত্রলীগের তৃণমূল ও কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকেই।

ছাত্রলীগের একাধিক নেতা সূত্রে জানা যায়, গত ১ সেপ্টেম্বর ছাত্রলীগঘোষিত ছাত্র সমাবেশ সফল করার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের ইউনিটকে অর্থ দিলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগকে কোনো ধরনের অর্থ দেয়নি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। এছাড়া, ছাত্র সমাবেশে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ করে দেয় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ যাকে ভালো চোখে দেখেনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ। শুধু তাই নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগকে বিভিন্ন সিদ্ধান্তে না রেখে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ একাই সব সিদ্ধান্ত নেয় বলে অভিযোগ ঢাবি ছাত্রলীগের। আগস্টের প্রোগ্রাম হওয়া সত্ত্বেতেও ঢাবি ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে বক্তব্য দেয়ার সুযোগ দেয়নি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। গত ১৩ জুলাই ঘোষিত সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটিতে শয়ন ও সৈকতের অনুসারীদের কম পদায়ন করাও একটি কারণ বলে জানান ছাত্রলীগের একাধিক নেতা। এছাড়া, দীর্ঘদিন কমিটি না হওয়া ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগসহ অধিভুক্ত সাত কলেজ শাখার নিয়ন্ত্রণ চায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ। তাদের দাবি, এতে অ্যাকাডেমিক মানের সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক মানেরও উন্নয়ন ঘটবে সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের। তবে এতে সম্মতি জানায়নি সংগঠনের কেন্দ্রীয় সংসদ। গত ১৭ জুলাই ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন সভাপতি শয়ন ও সাধারণ সম্পাদক তানভীর। এ সময় তারা অধিভুক্ত সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের নানান সংকট সমাধানের আশ্বাস দিয়ে একসঙ্গে কাজ করার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন। এর পরই সংগঠনের সাত কলেজ শাখার নিয়ন্ত্রণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের হাতে যাওয়ার খবর প্রকাশিত হয়। তবে একদিন পরই কলেজ ছাত্রলীগের পদপ্রত্যাশীদের থেকে বায়োডাটা আহ্বান করে সে আলোচনায় এক প্রকার অকার্যকর করে দেয় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। সর্বশেষে বিষয়টির মীমাংসা আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা করবেন বলে আশ্বাস দেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

এসব কারণে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাথে সম্পর্কে টানাপড়েন শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের, যা স্পষ্ট হয় গত মঙ্গলবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি মাজহারুল কবির শয়নের এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে। সেই স্ট্যাটাসে শয়ন লিখেছেন- কেন্দ্রীয় কমিটির কাজ কেন্দ্রীয় বিষয়াদি সম্পাদন করা; সারাদেশের ইউনিটগুলোর মাঝে সমন্বয় সাধন করা; কর্মসূচি প্রণয়ন করা ও শৃঙ্খলা, গঠনতন্ত্রের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করা। এর বাইরে ৩০০ জন কেন্দ্রীয় নেতা দ্বারা ব্যক্তিগতভাবে পাঁচজন কর্মী সংগঠন করা বর্তমান কাঠামোতে সম্ভব না।

শয়ন লিখেন- ছাত্রলীগের প্রাণ হলো তৃণমূল তথা বিভিন্ন ইউনিট ; যারা মাত্র কয়েক দিন আগেই সম্মিলিতভাবে লাখো কর্মীর সমাগম করে দেখিয়েছে। এরাই সংগঠনের প্রাণ। এরা দামি ফ্ল্যাটে থাকেন না, দামি গাড়িতে ঘুরেন না, এরা নিজের পরিবারকে ঠকিয়ে, পেটে ক্ষুধা রেখে, টিউশনির টাকা জমিয়ে, ছেঁড়া স্যান্ডেল-ঘর্মাক্ত জামা পড়ে রাজপথে জীবন উৎসর্গ করার ব্রত নিয়ে সংগঠনকে টিকিয়ে রাখে।

তিনি আরো লিখেছেন, ’মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বঙ্গবন্ধু তনয়া, আমরা অনেকেই প্রায়শই নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থের জন্য সংগঠনকে নিলামে তুলে ফেলি। আমাদের মনে রাখতে হবে, ছাত্রলীগের ইতিহাস বাঙালির ইতিহাস। আমাদের মনে রাখতে হবে, আমাদের জীবনের কর্ম আমাদের ফিরিয়ে দেয়া হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, ইতিহাস কখনো কাউকে ক্ষমা করে না। আমাদের আশ্রয়স্থল দেশরত্ন শেখ হাসিনা কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি-সম্পাদকসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয় এবং ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদকের নাম ঘোষণা করেন। আমি নিশ্চিত বঙ্গবন্ধু তনয়ার হাতে সময় থাকলে সারা বাংলাদেশের সব জেলা-উপজেলা কমিটি নিজ হাতে গঠন করতেন। ছাত্রলীগের সর্বোচ্চ পদ থেকে তৃণমূলের সর্বশেষ কর্মীর এই বিষয়টি অনুধাবন করা উচিত।’

শয়নের এই পোস্টের পর দেশজুড়ে শুরু হয় নানা আলোচনা-সমালোচনা। তার এই স্ট্যাটাসের পর পরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত, ঢাকা মহানগর উত্তরের সভাপতি রিয়াজ মাহমুদ, সাধারণ সম্পাদক সাগর আহমেদ শামীম, ঢাকা মহানগর উত্তরের সভাপতি রাজিবুল ইসলাম বাপ্পী ও সাধারণ সম্পাদক সজল কুণ্ডুও তাদের নিজ নিজ ফেসবুক আইডি থেকে পোস্টটি শেয়ার করেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের এক নেতা বলেন, ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম ও সাধারণ সম্পাদক ইনান আমাদের মতো তৃণমূল নেতৃত্বকে অবমূল্যায়ন করে যাচ্ছেন। এতে করে আমাদের মতো যারা তৃণমূল নেতাকর্মীরা রাজনীতিতে নিরুৎসাহিত হবে। তৃণমূল হচ্ছে ছাত্রলীগের প্রাণ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি মাজহারুল কবির শয়ন আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, অন্যান্য ইউনিট ও জায়গার সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্থক্য রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি স্বতন্ত্র ইউনিট এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটি জননেত্রী শেখ হাসিনা নিজেই ঘোষণা করেন। আন্দোলন, সংগ্রাম যা হয় সব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে গঠিত হয়। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের কোনো সভা, মিছিল করতে হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক করতে হয়। এটি আমাদের মাথায় রাখা উচিত এবং এটি হচ্ছে বাস্তবতা।

তার ফেসবুক স্ট্যাটাসের বিষয়ে জানতে চাইলে শয়ন বলেন, আমি তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের জন্য কথা বলেছি। তারা যাতে উপেক্ষিত না হয়। সাত কলেজ শাখা ছাত্রলীগকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে যুক্ত করার বিষয়ে তিনি বলেন, এটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জানাবেন। আমরা সেই সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি। টানাপড়েনের বিষয়টি পরোক্ষভাবে স্বীকার করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় না মহানগরের নেতারাও এটা (শয়নের ফেসবুক পোস্ট) শেয়ার করেছেন। শয়ন ভাই যে কথাগুলো বলেছেন এটা যৌক্তিক। নেত্রী আমাদেরকে দায়িত্ব দিয়েছেন তৃণমূলের ভাগ্য পরিবর্তন করার জন্য; আমাদের ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের স্মার্ট বাংলাদেশের স্মার্ট নাগরিক হিসেবে তৈরি করার জন্য। একইসাথে সামনে যে নির্বাচন সেটাতেও ছাত্রলীগের অনেক বড়

ভূমিকা থাকবে। সে জায়গা থেকে আমার মনে হয়েছে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের নিয়ে কাজ করার অনেক সুযোগ রয়েছে কিন্তু আমরা সেটা করছি না; অবহেলা করছি।

এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনানের মুঠোফোনে ফোন করা হলে তারা সাড়া দেননি।