ঢাকা ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৯ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

চলমান আইনি প্রক্রিয়ায় বিদেশি হস্তক্ষেপ

বিভ্রান্তি নিরসনে কূটনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণের তাগিদ

রাজনৈতিকভাবে যড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে হবে আওয়ামী লীগকে
বিভ্রান্তি নিরসনে কূটনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণের তাগিদ

আগামী বছরের শুরুতে দেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সব প্রস্তুতি শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন। এরই মধ্যে ভোটার তালিকা হালনাগাদ ও সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ সম্পন্ন হয়েছে। নতুন ভোটার হওয়ার জন্য আবেদন আহ্বান করা হয়েছে। চলছে ভোটের উপকরণ সংগ্রহের কাজ। সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্যালটের মাধ্যমে ভোট গ্রহণের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। সাংবিধানিক এই প্রতিষ্ঠান জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করতে প্রস্তুতি জোরদার করার প্রেক্ষাপটে শুরু হয়েছে দেশবিরোধী যড়যন্ত্র। বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা অবমূল্যায়ন করার জন্য রাজপথের বিরোধীদল বিএনপিই শুধু মাঠে নামেনি, তাদের সঙ্গে সুর মিলিয়েছে এ দেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। বিদেশে তার গ্রহণযোগ্যতা দেশের তুলনায় হয়তো অনেক বেশি। সে কারণে তিনি তার ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়ার জন্য বিদেশিদের মাধ্যমে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার ওপর চাপ সৃষ্টি করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন। ভিনদেশি মানুষের ওপর ভর করে তিনি তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণের পথে হাঁটছেন। দেশের প্রচলিত বিধিবিধান জলাঞ্জলি দিয়ে তাকে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে কেন রাখা হলো না, সরকারের প্রতি সেটাই ছিল তার একসময়ের অভিযোগ। অথচ ৬৫ বছরের বেশি কোনো ব্যক্তির সরকারি প্রতিষ্ঠানের বিশেষায়িত শীর্ষ পদে দায়িত্ব পালনের সুযোগ যে নেই, সেটা তিনি হয়তো বুঝতে পারেননি। আদালতের রায়ের মাধ্যমে তিনি প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। আবার কোটি কোটি টাকার কর ফাঁকির মামলা এড়ানোর জন্য তিনি নানা কৌশল অবলম্বন করেন। কিন্তু আইন তার নিজস্ব গতিতে চলে বলেই তিনি কর ফাঁকি দেয়া থেকে মুক্তি পাননি। বাধ্য হয়ে তাকে করের টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে।

সর্বশেষ তিনি সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছেন নিজ প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের পাওনা বুঝিয়ে না দিয়ে। তিনি তার কর্মচারীদের পাওনা দেবেন না। তাদের আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবেন- এটা তো সুস্থ চিন্তা-চেতনার বহিঃপ্রকাশ নয়। এই অন্যায্য ও বেআইনি কাজটি জায়েজ করার জন্য তিনি ১৬০ জন বিদেশি ব্যক্তির বিবৃতি নিয়ে আসলেন। তার মধ্যে ১০০ জন তার মতো নোবেল বিজয়ী। বিবৃতিতে তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করলেন বিচারপ্রক্রিয়া বন্ধ করতে। প্রশ্ন উঠেছে, নোবেলজয়ী ব্যক্তিত্বরা কি তাহলে আইনের ঊর্ধ্বে? তাদের কোনো অন্যায়ের কি কোনো বিচার হবে না? একজন নোবেল বিজয়ীর কি একাধিক ভোট দেয়ার সুযোগ রয়েছে। শাশ্বত উত্তর হচ্ছে- না। তাহলে অধিকার ও আইন আদালতের কাছে সবাইতো সমান। তা না হলে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনি আইনিবিধি লঙ্ঘনের দায়ে অতিসম্প্রতি কারাগারে হাজির হয়ে জামিন নিয়েছেন। বিদেশে অনেক মন্ত্রীপর্যায়ের ব্যক্তির ক্ষেত্রে রাস্তায় ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনের দায়ে বিনা বাক্যে জরিমানা দিয়ে নিষ্কৃতি পাওয়ার নজির রয়েছে। এটা তো দোষ বা অসম্মানের নয়। বরং দেশের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার অনন্য দৃষ্টান্ত। তারা যদি আইনের প্রতি অবিচল থেকে আইনি প্রক্রিয়ায় অভিযোগ থেকে মুক্তি পেতে পারেন, তা হলে আমাদের দেশের নোবেল বিজয়ী কেন এত দায়মুক্তি কামনা করেন, তা বোধগম্য নয় বলে মনে করছে সচেতন মহল।

নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস ইস্যু নিয়ে বিবৃতি-পাল্টা বিবৃতির রেষ কাটতে না কাটতে আবার শুরু হলো নতুন চমক। এই চমক সৃষ্টি করলেন অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন ডেপুটি অ্যাটনি জেনারেল (ডিএজি) এমরান আহম্মদ ভূঁইয়া। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে তিনি একটি বানোয়াট কাহিনী তৈরি করে রাজনৈতিক ও গণমাধ্যমে রীতিমতো ঝড় তুলেছেন। তার বক্তব্যের মূল কথা ছিল- শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূসকে বিচারিক হয়রানি করা হচ্ছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া রাষ্ট্রের একজন আইন কর্মকর্তার এ ধরনের বক্তব্য রাজনৈতিক ও আইন অঙ্গনে বেমানান।

সাংবাদিকদের সামনে তার ব্যক্তিগত মতামত তুলে ধরার সুযোগ আইনি পরিভাষায় তার নেই। পদত্যাগ করে অথবা অ্যাটর্নি জেনারেলের অনুমতি নিয়ে তার কথা বলা উচিত ছিল। তিনি তার কোনোটিই করেননি। বরং অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস নিয়ে তিনি বিভ্রান্তিকর তথ্য পরিবেশন করেছেন। তিনি যথারীতি বরখাস্ত হলেন। রাগে-ক্ষোভে তিনি শুক্রবার চলে গেলেন ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসে। তিনি বা তার পরিবারের কেউ মার্কিন নাগরিক নন। তার কাছে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার জন্য কোনো ভিসা নেই। তিনি সেখানে বেশ কয়েক ঘণ্টা কাটালেন অভ্যর্থনা কক্ষে। স্ত্রী ও তিন কন্যা নিয়ে সেখানে অবস্থান নেয়ার আগে তিনি একটি জাতীয় ইংরেজি দৈনিকের এক সাংবাদিককে ক্ষুদে বার্তা পাঠালেন। ফলে খবরটি ছড়িয়ে পড়ল গণমাধ্যমে। প্রশ্ন হচ্ছে- এমরান আহম্মদ ভূঁইয়া তো একজন বিশিষ্ট আইনজীবী। তিনি কোন অধিকারে মার্কিন দূতাবাসে গিয়ে আশ্রয় নিলেন? কথিত একটি বিবৃতি স্বাক্ষর না করার কারণে তিনি এমন কোনো অপরাধ করেননি যাতে তিনি গ্রেপ্তার হবেন। ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলের পদ থেকে এমরান আহম্মদ ভূঁইয়া বরখাস্ত হওয়ার পর স্ত্রী-কন্যাদের নিয়ে ‘আশ্রয় চাইতে’ ঢাকার মার্কিন দূতাবাসে গিয়ে প্রায় সাড়ে ৩ ঘণ্টা দূতাবাসের মূল ফটকের পাশের অভ্যর্থনাকক্ষে অবস্থানের পর সন্ধ্যার দিকে আবার বাসায় ফিরে গেছেন। সরকারের অবস্থানের বাইরে গিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে করা মামলার বিষয়ে গত সোমবার বক্তব্য দিয়েছিলেন ডিএজি এমরান আহম্মদ ভূঁইয়া। রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া রাষ্ট্রের একজন আইন কর্মকর্তার এমন বক্তব্য রাজনৈতিক ও আইন অঙ্গনে ছিল বেমানান। তার বক্তব্যের মূল কথা ছিল- শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূসকে বিচারিক হয়রানি করা হচ্ছে। তার এ বক্তব্যের পরের দিন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার ইঙ্গিত দেন।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও এমরান আহম্মদ ভূঁইয়ার ব্যক্তিগত আক্রোশে বিশ্বের শক্তিধর দেশের কাছে প্রতিকার চাওয়ার মনমানসিকতা তাদের অজ্ঞতারই বহিঃপ্রকাশ। কেন না, কোনো রাষ্ট্রপ্রধান তার নিজ দেশে প্রতিপক্ষের অযাচিত হস্তক্ষেপের শিকার হলে, তাকে তার অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাষ্ট্র আশ্রয় দিয়ে থাকে; এ ধরনের নজির বিশ্বে রয়েছে। তবে ড. ইউনূস ও এমরান আহম্মদ ভূঁইয়া তো রাষ্ট্রের কোনো শীর্ষ ব্যক্তিত্ব নন যে, তাকে অন্য কোনো রাষ্ট্র আশ্রয় দেবে কিংবা তার হয়ে লড়াই করবে!

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে আমাদের দেশের গুটিকয়েক রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য বিদেশি ‘প্রভুদের’ ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল। তৃণমূল পর্যায়ের সমর্থন নিয়েই বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সরকার দেশ পরিচালনা করছে। আওয়ামী লীগ হচ্ছে এমন একটি রাজনৈতিক দল, যাকে রাজপথে মোকাবিলা করা কঠিন। সে কারণে যারা ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন, তারা নিজেদের রাজনৈতিক শক্তি কিংবা জনগণের ভোটের ওপর নির্ভর না করে বরং বিদেশিদের ওপর ভর করে থাকে। তবে ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এটা যে সম্ভব নয়, তার প্রমাণ পেয়েছে আওয়ামীবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো। আদালতের মাধ্যমে বাতিল হয়ে যাওয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবির ব্যাপারে এ পর্যন্ত কোনো দেশ, প্রতিষ্ঠান কিংবা ব্যক্তি বাংলাদেশ সরকারকে বিবেচনা করারও প্রস্তাব দেয়নি। আর এমরান আহম্মদ ভূঁইয়া তিনটি ব্যাগে করে কাপড়চোপড় নিয়ে সপরিবারে মার্কিন দূতাবাসে আশ্রয় নিতে গিয়ে সেখানে কার্যত ‘অনুপ্রবেশ’ করেছেন। এই অনুপ্রবেশের কারণে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানাতে পারে মার্কিন দূতাবাস। কেন না, একটি সুরক্ষিত কূটনৈতিক পাড়ায় তার এমন ‘রুচিহীন’ নজিরবিহীন কর্মকাণ্ড বিবেকসম্পন্ন মানুষ সহজেই মেনে নেয়নি। মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের আত্ম সম্মানের ওপর এমরান আহম্মদ ভূঁইয়ার এ হীন মনোভাবাপন্ন কর্মকাণ্ড আঘাত হেনেছে। দেশের কূটনীতিকরা বলেছেন, বিএনপি, ড. ইউনূস ও এমরান আহম্মদ ভূঁইয়ার ব্যাপারে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশে অবস্থিত দূতাবাসগুলো অবহিত করার সময় এসেছে। ক্ষমতায় যেতে, স্বার্থ উদ্ধার কিংবা ব্যক্তিগত ক্ষোভের বশীভূত হয়ে বিদেশিদের কাছে গিয়ে নালিশ জানানোর প্রবণতা বেড়ে গেলে জাতি হিসেবে আমরা অনেক পিছিয়ে পড়ব। উন্নত সমৃদ্ধ দেশ গঠনের প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত না হলেও আত্মসম্মানের দিক দিয়ে আমরা অনেক ছোট হয়ে যাব। আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া একটি ঐতিহ্যবাহী পুরোনো দল। এই দলের মাধ্যমে এসব যড়যন্ত্র মোকাবিলা করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। তাই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বিদেশি রাষ্ট্র ও কূটনৈতিকদের আমন্ত্রণ জানিয়ে তাদের কাছে দেশের প্রকৃত আইনিব্যবস্থা ও বিচার প্রক্রিয়া সম্পর্কে অবহিত করা উচিত।

তারা বলেছেন, দীর্ঘদিন ধরে নোবেল বিজয়ী ওই ব্যক্তি বাংলাদেশের ব্যাপারে বিদেশি হস্তক্ষেপ কামনা করে নানা অপতৎপতা চালিয়ে যাচ্ছেন। বিভিন্ন দেশ-বিদেশি বন্ধুদের কাছে বাংলাদেশের নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে নানা বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে দেশের ভাবমূতি ক্ষুণ্ণ করছেন।

কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে ড. ইউনূস বিষয়ে খোলাচিঠি (বিবৃতি) দিয়েছিলেন বিশ্বের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃস্থানীয় দেড় শতাধিক ব্যক্তি। তাদের মধ্যে শতাধিক নোবেল বিজয়ীও রয়েছেন। শতাধিক নোবেলজয়ীর ওই খোলাচিঠির বিপরীতে অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় থেকে প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দেয়ার কথা রয়েছে- এমন দাবি করে এমরান বলেছিলেন, ‘অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসে কর্মরত সবাইকে এতে স্বাক্ষর করার জন্য নোটিশ করা হয়েছে। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এ বিবৃতিতে স্বাক্ষর করব না।’

এদিকে বাংলাদেশের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে এখন ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রসঙ্গ। সর্বত্রই তাকে নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে। রাজনৈতিক নেতাদের বিভিন্ন রকম মন্তব্য গণমাধ্যমে আসছে। দিন দিন তার অতীত কর্মকাণ্ড নিয়ে মানুষ এখন নানারকম কথা-বার্তা বলছেন। বের হয়ে আসছে তার অতীত জীবনের নানা দিক। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অতীত জীবনের কর্মকাণ্ড নিয়ে অনেকেই এখন অবাধ তথ্য প্রবাহের সুযোগ গ্রহণ করছেন। তার রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা, অতীতে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের গঠনতন্ত্র তৈরির ক্ষেত্রে তার ভূমিকা ছাড়াও দেশে অস্বাভাবিক সরকার প্রতিষ্ঠায় তার সম্পৃক্ততার বিষয়টিও এখন রাজনৈতিক মহলে আলোচ্য বিষয়। প্রিন্ট এবং ইলেক্টনিকস মিডিয়ার টক শো অনুষ্ঠানের শিরোনামও এখন ড. ইউনূস। ১৬০ জন বিদেশি নাগরিকের বিবৃতি আদায় করতে গিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূস এখন পাল্টা বিবৃতি বাণে জজরিত। প্রতিদিনই দেশ-বিদেশে বাংলাদেশি পেশাজীবী সংগঠনের পক্ষ থেকে তার বিরুদ্ধে বিবৃতি দেয়া হচ্ছে। গণমাধ্যমে প্রতিদিনই ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সমালোচনা করে যেসব পাল্টা বিবৃতি দেয়া হচ্ছে, তিনি তার কোনোটির প্রতিবাদ করছেন না।

নতুন করে কোনো দেশ কিংবা আন্তর্জাতিক সংগঠন ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে আর কোনো বিবৃতি দিচ্ছে না। নতুন করে কোনো বিবৃতি তিনি আদায়ও করতে পারছেন না। দেশের অভ্যন্তরে তার অনেক শুভাকাঙ্ক্ষি থাকলেও তারা এই সময়ে প্রকাশ্যে এগিয়ে আসছে না। ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশ সরকার এবং দেশকে তার প্রতিপক্ষ মনে করে বিদেশি বন্ধুদের কাছে দেশের নেতিবাচক ভাবমূর্তি তুলে ধরে সহানুভূতি কামনা করতে গিয়ে ১৬০ বিশিষ্ট ব্যক্তির বিবৃতি আদায় করেছেন। এসব বিখ্যাত ব্যক্তিরা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মুখের কথা বিশ্বাস করে এবং তার ওপর আস্থা রেখেই বিবৃতি দিয়েছেন।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নামে দায়ের করা মামলার বিচারিক প্রক্রিয়া বন্ধ রাখতে একটি নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের ওপর যে চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে, সেটি বিশ্বে নজিরবিহীন। কেন না, কোনো দেশের নিজস্ব আইনি প্রক্রিয়াকে বিবৃতি দিয়ে বাধাগ্রস্ত করা হলে বিশ্বসভ্যতা অন্ধকারাচ্ছন্ন পথে হাঁটতে থাকবে। যেসব বিশিষ্ট ব্যক্তি এই বিবৃতি দিয়েছেন, তারা মূল তথ্যটি হয়তো জানেন না। তারা বিভ্রান্ত হয়েই হোক, কিংবা বন্ধুত্বের অন্ধ বিশ্বাসেই হোক; একটি বিবৃতি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সরকারের উদ্দেশ্যে দিয়েছেন। তাদের এই আহ্বান প্রতিপালন করতে গেলে বাংলাদেশের আইনি কাঠামো ভেঙে পড়বে এবং দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতির শেকড় মজবুত হবে।

১৬০ জনের বিবৃতি আনতে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করতে হয়েছে বলে দাবি করেছেন, সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। আইনি প্রক্রিয়া আইনি উদ্যোগে মোকাবিলা করাই শ্রেয়। যারা এ ধরনের বিবৃতি দিয়ে আইনি প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে চেয়েছেন, তারা হয়তো তাদের বিভ্রান্তি অনুধাবন করতে পেরেছেন। আর সে কারণে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পক্ষে আর কোনো বিবৃতি দেয়া হচ্ছে না। কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলেছে, ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিদেশি নাগরিকদের কাছ থেকে বিবৃতি আদায় করতে গিয়ে তাদের কাছে ভুল তথ্য উপস্থাপন করে তাদের বিভ্রান্তি করেছেন। তাদের এই বিভ্রান্তি দূর করতে কূটনৈতিক পন্থা গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশে অবস্থিত সব দূতাবাসের কাছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়া সম্পর্কে অবহিত করে চিঠি দিতে হবে। এছাড়া বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসকে এ ব্যাপারে সক্রিয় করতে হবে। কেন না, ড. ইউনূস বাংলাদেশ সম্পর্কে নানা বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে দেশের ভামূর্তি ক্ষুণ্ণ করছেন। দেশের ভাবমূর্তি সমুন্নত রাখতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বিদেশিদের কাছে প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরতে হবে।

আমাদের দেশে যেসব রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগবিরোধী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত, কেবল তারাই ড. ইউনূসের প্রতি সহানুভূতিশীল। অথচ ইউনূসের পক্ষে আজ পর্যন্ত তারা কোনো বিবৃতি দেয়নি কিংবা কোনো প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেনি। দেশের মানুষকে আস্থায় আনতে না পারলে বিদেশি শক্তির ভরসায় থেকে কায়েমি স্বার্থ হাসিল করা যায় না। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের মানুষের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা অর্জন করতে পেরেছিলেন বলেই তার ডাকে এদেশের মানুষ মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্যদিয়ে সশস্ত্র সংগ্রামে অংশ নিয়ে আত্মবিসর্জন দিয়েছেন। নোবেল বিজয়ী হলেই যে তিনি আইনের ঊর্ধ্বে তা কিন্তু নয়। তার বিরুদ্ধে সরকার কোনো আইনি পদক্ষেপ নেয়নি, নিয়েছেন তার প্রতিষ্ঠানে কাজ করা কর্মচারীরা। তিনি তাদের নায্য পাওনা পরিশোধ করেননি।

আওয়ামী লীগ সরকারবিরোধী একটি মহলের ধারণা, একটি প্রভাবশালী দেশ বাংলাদেশের ক্ষমতা পরিবর্তনে সহায়তা করবে এবং পরিবর্তিত সরকারের প্রধান হবেন ড. ইউনূস। গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সুদের ঘানি টানতে টানতে এদেশের কত মানুষ যে সর্বশান্ত হয়েছেন, কত মানুষ যে আত্মহত্যা করেছেন, তার হিসাব থাকলে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেয়ার জন্য ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে আরো অনেক মামলা হতো। বাংলাদেশের কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে গ্রামীণ ব্যাংক সামাজিক দায়বদ্ধতা হিসেবে কোনো আর্থিক সহায়তা দিয়েছে- এমন নজির বিরল। ড. ইউনূস মহান একুশে ফেব্রুয়ারিতে কোনো শহীদ মিনারে গিয়ে ভাষাসৈনিকদের শ্রদ্ধা জানান না। মহান স্বাধীনতা দিবস কিংবা মহান বিজয় দিবসে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে গিয়ে একাত্তরে শহীদদের প্রতি কোনো শ্রদ্ধা নিবেদন করেন না। দেশের কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তির জানাজা কিংবা তাদের স্মরণসভায় যোগ দেন না। দেশের দারিদ্র্য ও অবহেলিত মানুষের আর্থ-সামাজিক মুক্তির জন্য কোনো দিকনির্দেশনা দেন না। তিনি তার ব্যবসায়িক কমকাণ্ডের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করা ছাড়া অন্য কোনো চিন্তা করেন না। বরং স্বপ্নের পদ্মা সেতুর মতো মেগা প্রকল্পে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে তিনি হস্তক্ষেপ করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার নিজের অর্থে পদ্মা সেতু করে সেই বিশ্বব্যাংককে দেখিয়ে দিয়েছেন- ‘আমরাও পারি’। বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাবাষির্কীর অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পেয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণের গল্প শুনিয়ে এসেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। তিনি বিশ্বব্যাংকের ভুল শুধরিয়ে দিয়েছেন। বিশ্ব ব্যাংক পরবর্তীতে তাদের ভুল বুঝতে পেরে পদ্মা সেতুতে বিনিয়োগ করার প্রস্তাব দিলেও বঙ্গবন্ধুকন্যা সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন। সেই বিশ্ব ব্যাংক এখন বাংলাদেশকে কারণে-অকারণে আগ বাড়িয়ে ঋণ দিচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু নির্মাণের ক্ষেত্রে যদি অটল না থাকতেন, তা হলে জাতি পদ্মা সেতুর মতো এমন একটি মহাপ্রকল্প বাস্তবায়নের আকক্সক্ষা থেকে অনেক দূরে থাকত। ড. ইউনুসের বিরুদ্ধে কোনো একটি মামলা বাংলাদেশ সরকার করেনি। এসব মামলা করেছেন, তার প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা। তিনি তাদের নায্য পাওন পরিশোধ করেননি। তিনি কোটি কোটি টাকার কর ফাঁকি দিতে গিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মামলায় অভিযুক্ত হয়েছেন। গ্রামীণ ব্যাংকের মতো একটি জনপ্রিয় ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব তিনি পালন করেছেন। দেশের প্রচলিত নিয়ম অনুসারে একটা বয়সে তাকে অবসর গ্রহণ করতে হয়। ড. ইউনূস সেটি মানবেন না। তিনি অজীবন গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাকার অভিপ্রায় ব্যক্ত করে আদালতের দারস্ত হন। আদালত তাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। আদালত সূত্র জানিয়েছে, ইউনূসের বিরুদ্ধে ১৬৮টি মামলা রয়েছে। তার মধ্যে দুটি হচ্ছে ফৌজদারি মামলা। বাকিগুলো কর ফাঁকিসহ নানান মামলা। গ্রামীণ টেলিকমের মামলা রয়েছে ৬৪টি। গ্রামীণ কল্যাণের মামলা রয়েছে ৬৯টি, গ্রামীণ কমিউনিকেশন ২৫টি, গ্রামীণ ফিশারিজ আটটিসহ ১৬৮টি মামলা রয়েছে। এই মামলাগুলো করেছেন তারাই, যারা ড. ইউনূসের প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন।

আমাদের সংবিধানের ২৭নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভকারী। কাজেই ইউনূসের অনৈতিক কাজকর্মের বিরুদ্ধে যারা মামলা করেছেন, তাদেরও আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার রয়েছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত