ঢাকা ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৯ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

শেখ হাসিনা-ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ বৈঠক

বাংলাদেশ-ফ্রান্স সম্পর্ক পৌঁছেছে নতুন মাত্রায়

ঢাকা-প্যারিস দুটি চুক্তি স্বাক্ষর
বাংলাদেশ-ফ্রান্স সম্পর্ক পৌঁছেছে নতুন মাত্রায়

বাংলাদেশ-ফ্রান্সের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে। ফরাসি প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফরে দুই দেশের মধ্যকার অর্থনৈতিক ও উন্নয়নের ধারা আরো জোরদার হয়েছে। এমনকি বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশ ও ফ্রান্স দারুণ একতা ও প্যারিস এজেন্ডা ফর পিপলস অ্যান্ড দ্য প্ল্যানেটের কাঠামোয় বাংলাদেশ সক্রিয়ভাবে সমর্থন করেছে। দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক উন্নয়নে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাঁক্রোর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল বৈঠক শেষে যৌথ প্রেস ব্রিফিংয়ের আয়োজন করা হয়। সেই ব্রিফিংয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমার পিতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে যে বন্ধুত্বপূর্ণ বন্ধনের সূচনা করেছিলেন, তা নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে।’ শেখ হাসিনা তার বিবৃতিতে আরো বলেন, ‘আজ ফ্রান্স ও বাংলাদেশের মধ্যে আমাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের একটি ঐতিহাসিক দিন যা পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে বিকশিত হচ্ছে।’ এর আগে তিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ফরাসি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে দ্বিপাক্ষিক সমগ্র বিষয়ে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁর সঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। ফ্রান্স বাংলাদেশের সার্বভৌম নীতি, স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধা ও সমর্থন প্রকাশ করেছে, বিশেষ করে চলমান ভূ-রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার প্রেক্ষাপটে। তিনি বলেন, ‘আমরা উভয়েই আশা করি বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের মধ্যে এই নতুন কৌশলগত পদক্ষেপ আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় কার্যকর ভূমিকা রাখবে।’

প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, গত দেড় দশকে বাংলাদেশে সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা, উন্নয়ন ও সুশাসনের ওপর ভিত্তি করে এই নতুন সম্পর্কের ভীত রচিত হয়। তিনি বলেন, ফ্রান্স সরকার জনগণের মৌলিক ও মানবাধিকার রক্ষায় বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্বশীল ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ কর্মকাণ্ডে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে।

সরকার প্রধান বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির দর্শনীয় ও ধারাবাহিক অগ্রগতিতে ফরাসি সরকারের আস্থা ও প্রশংসা ব্যক্ত হয়েছে। জিএসপি প্লাস প্রকল্পের অধীনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাণিজ্য সুবিধা বাংলাদেশের জন্য অব্যাহত রেখে ভিশন-২০৪১ বাস্তবায়নে বাংলাদেশের জনগণ ও সরকারের পাশে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছে ফ্রান্স। তিনি বলেন, ‘তাই বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে আমি প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁর নেতৃত্বে ফ্রান্স সরকার ও ফ্রান্সের জনগণকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।’

বাংলাদেশের বিশ্বস্ত উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে শেখ হাসিনা বলেন, অবকাঠামো উন্নয়নে ফ্রান্স আমাদের অব্যাহত সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। তারা বাংলাদেশের কৌশলগত নিরাপত্তা অবকাঠামো নির্মাণে উন্নত ও বিশেষায়িত প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদানে আগ্রহ দেখিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের নেতৃস্থানীয় এবং দায়িত্বশীল আবাসিক শক্তি হিসেবে বাংলাদেশ ও ফ্রান্স এই অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে কাজ করবে।

সরকারপ্রধান উল্লেখ করেন, ‘আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলায় ফ্রান্সের নেতৃত্বকে স্বাগত জানাই এবং একটি টেকসই তহবিল গঠনের জন্য প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁর আহ্বানের প্রশংসা করি।’

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ বলেন, ফরাসি উড়োজাহাজ নির্মাণ সংস্থার তৈরি নতুন ১০টি এয়ারবাস কিনতে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ঢাকা। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের বরাদ দিয়ে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক শেষে বিবৃতিতে ম্যাক্রোঁ বলেছেন, ইউরোপীয় মহাকাশ শিল্পে আস্থা রাখার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ জানাই। ‘এ ৩৫০’ মডেলের ১০টি এয়ারবাসের জন্য প্রতিশ্রুতিটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’

ফরাসি কর্মকর্তারা জানান, ‘এ ৩৫০’ মডেলের ওয়াইডবডির উড়োজাহাজের জন্য চুক্তিটি চূড়ান্ত হচ্ছে রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স লিমিটেডের সঙ্গে। ‘এয়ারবাস এ ৩৫০’ হলো একটি দূরপাল্লার, ওয়াইডবডির ও দুই ইঞ্জিনবিশিষ্ট জেট বিমান। এটা এয়ারবাস কোম্পানি নির্মাণ করে থাকে। ৫১ বছরে বাংলাদেশের ২০টিরও বেশি বোয়িং সমৃদ্ধ উড়োজাহাজ রয়েছে। বেশিরভাগই ওয়াইডবডির বিমান। তবে এখনো কিছু ড্যাশ-৮ রয়েছে বহরে। এবার এয়ারবাস কিনতে আগ্রহী বাংলাদেশ সরকার।

এছাড়া বৈঠকে শিক্ষা, সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত বিনিময় নিয়ে ফ্রান্সের সঙ্গে কার্যকর আলোচনা হয়েছে বলেও জানান শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী একই সঙ্গে ফ্রান্সের সরকার ও ফ্রান্সের জনগণের প্রতি শুভেচ্ছা জানান এবং দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের আরো সমৃদ্ধি কামনা করেন।

এর আগে গতকাল সকাল ১০টা ২০ মিনিটে ফরাসি প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পৌঁছলে শেখ হাসিনা টাইগার গেটে ফুলের তোড়া দিয়ে তাকে স্বাগত জানান। পরে দুই নেতা একান্ত বৈঠকেও মিলিত হয়েছেন। দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের আগে শেখ হাসিনা ও ইমানুয়েল ম্যাখোঁ একটি ফটো সেশনেও অংশ নেন। দুই নেতার উপস্থিতিতে দুটি চুক্তিও স্বাক্ষর হয়। ভারতের নয়াদিল্লিতে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে যোগদান শেষে দুই দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে গত রোববার সন্ধ্যায় ঢাকায় এসেছিলেন ম্যাক্রোঁ। এটি ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁর প্রথম বাংলাদেশ সফর। এর আগে প্রথম ফরাসি প্রেসিডেন্ট হিসেবে ফ্রাঁসোয়া মিতেরাঁ ১৯৯০ সালের ২০ থেকে ২৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সফর করেন। গতকাল বিকালে প্যারিসের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট।

প্রধানমন্ত্রী ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টকে উপহার সামগ্রী প্রদান করেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ছাড়ার আগে ম্যাঁক্রোর সেখানে রক্ষিত দর্শনার্থী বইয়ে স্বাক্ষর করেন। এর আগে তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন এবং পরে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমন্ত্রণে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাঁক্রো এ সফরে আসেন। তার এই সফরের মধ্যদিয়ে ‘কিছু প্রকল্প কংক্রিটাইজ’ এবং দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরো জোরদার হয়েছে।

১৯৯০ সালের ২০ থেকে ২৪ ফেব্রুয়ারি সাবেক ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফাঁসোয়া মিতেরা বাংলাদেশ সফর করেছিলেন। এরপর দ্বিতীয়বারের মতো কোনো ফরাসি প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ সফরে এলেন। যদিও বাংলাদেশে ম্যাঁক্রোর এটি প্রথম সফর। দুই দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সম্পর্ক ১৯৯০ সালের শুরু থেকে এই পর্যন্ত অনেক দূর এগিয়েছে। বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের মধ্যে মোট বাণিজ্য ২১০ মিলিয়ন ইউরো থেকে আজ ৪ দশমিক ৯ বিলিয়ন ইউরোতে উন্নীত হয়েছে এবং রপ্তানির ক্ষেত্রে ফ্রান্স পঞ্চমতম দেশ। ফরাসি কোম্পানিগুলো এখন ইঞ্জিনিয়ারিং, জ্বালানি, এরোস্পেস এবং ওয়াটার সেক্টরসহ বিভিন্ন খাতে জড়িত। বাংলাদেশ ও ফ্রান্স আশা করছে, ফরাসি প্রেসিডেন্টের সফর দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে।

ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে যোগদান শেষে ম্যাঁক্রো দুই দিনের সরকারি সফরে গত রোববার সন্ধ্যায় ঢাকায় আসেন। বিমানবন্দরে প্রধানমন্ত্রী ফুলের তোড়া দিয়ে ম্যাঁক্রোকে স্বাগত জানান। ম্যাঁক্রোকে লাল গালিচা সংবর্ধ্বনা দেয়া হয়। এ সময়ে উভয় দেশের জাতীয় সঙ্গীত বাজানো হয়। সশস্ত্র বাহিনীর পক্ষ থেকে তাকে গার্ড অব অনার প্রদান এবং ২১ বার তোপধ্বনি দেয়া হয়। ম্যাঁখো এ সময়ে গার্ড পরিদর্শন করেন। বিমানবন্দর থেকে তিনি হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে যান। সেখানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক তার সম্মানে আয়োজিত একটি আনুষ্ঠানিক নৈশভোজে অংশ নেন ম্যাঁক্রো। ফরাসি প্রেসিডেন্ট পরে স্থানীয় ব্যান্ড জলের গানের মিউজিক্যাল শো উপভোগ করতে ধানমন্ডি লেকে যান। এ সময় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ উপস্থিত ছিলেন।

বাংলাদেশ-ফ্রান্সের চুক্তি স্বাক্ষর : বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ ও স্থানীয় সরকার প্রকল্পে অর্থায়নে দুটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ ও ফ্রান্স। গতকাল সোমবার গণভবনে ম্যাক্রোঁ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর চুক্তি দুটি স্ব করা হয়।

দুই শীর্ষ নেতার উপস্থিতিতে স্বাক্ষরিত চুক্তিগুলো হলো- বঙ্গবন্ধু-২ আর্থ অবজারভেশন স্যাটেলাইট সিস্টেম সম্পর্কিত বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড (বিএসসিএল) এবং এয়ারবাস ডিফেন্স অ্যান্ড স্পেস এসএএস, ফ্রান্সের মধ্যে সহযোগিতার বিষয়ে লেটার অব ইনটেন্ট। দ্বিতীয় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) এবং ফ্রান্স ডেভেলপমেন্ট এজেন্সি (এএফডি) একটি ঋণ সুবিধার আওতায় নগর শাসন ও অবকাঠামো উন্নয়ন কর্মসূচি সংক্রান্ত চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন।

তুরাগ নদী ঘুরলে ম্যাঁক্রো : ফরাসি প্রেসিডেন্ট রাজধানীর তুরাগ নদে নৌকা ভ্রমণে যান। বৃষ্টির মধ্যে তুরাগ নদ ঘুরে দেখেন ম্যাক্রোঁ। এ সময় তিনি নৌকাবাইচ উপভোগ করেন। ঢাকায় ফ্রান্স দূতাবাস এবং সামাজিক সংস্থা ফ্রেন্ডশিপ যৌথভাবে আয়োজন করে এই পানশী নৌকাভ্রমণের আয়োজন করে। মিরপুর বড় বাজার ইকো পার্ক ঘাট থেকে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ এবং অন্যান্য সফর সঙ্গীকে নিয়ে তুরাগ নদীতে যাত্রা করে ফ্লেচেডি’অর নামের ফ্রেন্ডশিপ নির্মিত পানশী নৌকাটি। এরপর সাভারের কাউন্দিয়া ইউনিয়নের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া কর্ণাতলী নদীতে প্রবেশ করে পানশী নৌকাটি। সেখানে কিছু সময় কাটান তারা।

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাঁক্রো’র সঙ্গে এ পানশী নৌকা ভ্রমণের অংশ নেন তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান সাবের হোসেন চৌধুরী, বাংলাদেশে নিযুক্ত ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত মেরি মাসদুপুই, ফ্রেন্ডশিপের প্রতিষ্ঠাতা নির্বাহী পরিচালক রুনা খান এবং দুই দেশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত