গ্রেপ্তার দাবি বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের

নানা ঘটনা ঘটিয়ে বরখাস্ত হলেন এডিসি হারুন

প্রকাশ : ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  লিটন ইসলাম, ঢাবি প্রতিনিধি

নানা অঘটন ও বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের পর এবার সাময়িক বরখাস্ত হলেন পুলিশের রমনা বিভাগের এডিসি হারুন অর রশিদ। গতকাল বিকালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের এক প্রজ্ঞাপনে এ আদেশ দেন রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন চুপ্পু। তবে হারুনকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করে গ্রেপ্তার করার দাবি জানান ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীরা।

রাজধানীর শাহবাগ থানায় গত শনিবার দিবাগত রাতে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও ফজলুল হক হলের সভাপতি আনোয়ার হোসেন নাঈম এবং কেন্দ্রীয় বিজ্ঞানবিষয়ক সম্পাদক ও ঢাবির শহীদুল্লাহ হলের সাধারণ সম্পাদক শরীফ আহমেদ মুনিমকে বেধড়ক পেটান পুলিশের রমনা বিভাগের এডিসি হারুন অর রশিদ। এরপর দেশজুড়ে শুরু হয় নানা আলোচনা-সমালোচনা। হারুনের বিচারের দাবি জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরব হতে শুরু করেন ছাত্রলীগের বর্তমান ও সাবেক নেতৃবৃন্দ। মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা।

ছাত্রলীগের একাধিক নেতা সূত্রে জানা যায়, গত শনিবার পুলিশের ৩১ ব্যাচের ক্যাডার এডিসি হারুন ৩৩ ব্যাচের আরেক নারী পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে বারডেম হাসপাতালের একটি কক্ষে আড্ডা দিচ্ছিলেন। ওই সময় নারী কর্মকর্তার স্বামী কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের ওই দুই নেতাকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে যান। নারী কর্মকর্তার স্বামীও একজন ক্যাডার কর্মকর্তা। তার সঙ্গে এডিসি হারুনের বাকবিতণ্ডা হয়। এক পর্যায়ে সেটি হাতাহাতিতে রূপ নেয়। এরই জেরে পুলিশ ডেকে এনে তাদের থানায় নিয়ে নির্মম নির্যাতন করা হয়। জানা যায়, নারী কর্মকর্তা একসময় হারুনের স্ত্রী ছিলেন। পরে তাদের মধ্যে বিচ্ছেদ হয়ে আবার সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে ভুক্তভোগী শরীফ আহমেদ মুনীম আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমি, নাঈম ও আমাদের এক বড় ভাই সরকারি কর্মকর্তা বারডেম হাসপাতালে গিয়ে দেখি, এডিসি হারুন এবং আমাদের সঙ্গের বড় ভাইয়ের স্ত্রীর সঙ্গে একটি কক্ষে গল্প করছেন। পরে জানছি তাদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে প্রেমের সম্পর্ক চলছে। এ ঘটনায় ওই বড় ভাইয়ের সঙ্গে এডিসি হারুনের বাকবিতণ্ডা হয়। এরপর এডিসি হারুন ফোন করে থানা থেকে ফোর্স নিয়ে আসেন।’

মুনীম বলেন, ‘নাঈম ভাইসহ আমাকে শাহবাগ থানার আনা হয়। পরে পরিদর্শকের কক্ষে এসআই ও কনস্টেবলরা আমাদের মারধর করেন। আমাকে হাসপাতালে নেওয়ার সময়ও মারধর করে। আমি পড়ে আছি দেখে তারা ভয় পেয়ে যায়, তাই আর মারেনি। নাঈম ভাইকে রাস্তায় মারেনি। কক্ষে এনে এডিসি হারুন প্রথমে তাকে দুটো চড় দেন। এরপর এসআই কনস্টেবলদের মারতে নির্দেশ দেন। ওরা প্রচণ্ড মারধর করেন। একপর্যায়ে তার দাতের অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। বুট দিয়ে পারায় এবং বেয়নেট দিয়ে একটানা সাত-আট মিনিট মারে।’

তিনি বলেন, ‘পরে সেখানে নিউমার্কেট জোনের কর্মকর্তা শাহেনশাহ মাহমুদ, ডিবির এডিসি রমনা রিপন, এডিসি রমনা মুকুল ও ওসি নুর মোহাম্মদ আসেন। তারা আমাদের পরিচিত। তারা আমাদের এ অবস্থা দেখে খুবই হতবাক হন। নাঈমের অবস্থা দেখে তারা ভাবছে মারা যায় কি না। বুট দিয়ে পেটের মধ্যে আঘাত করা হয়েছে। তারপর এডিসি মুকুলের গাড়িতে করে কাকরাইলে ইসলামী ব্যাংক সেন্ট্রাল হাসপাতালে ভর্তি করেন।’

আরেক ভুক্তভোগী আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘রাষ্ট্রপতির সহকারী একান্ত সচিব আজিজুল হক তার এলাকার বড় ভাই। তাদের বাড়ি গাজীপুরে। আজিজুল গত শনিবার সন্ধ্যায় ফোন করে তাকে ঢাকার শাহবাগের হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে যেতে বলেন। রাত ৮টার দিকে তিনি সেখানে যান।’ আনোয়ার বলেন, ‘বড় ভাই বারডেম জেনারেল হাসপাতালে আছেন জেনে সেখানে ছুটে যাই। হাসপাতালের চারতলায় গিয়ে দেখি রাষ্ট্রপতির সহকারী একান্ত সচিব আজিজুল হক ও পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার হারুন অর রশিদের মধ্যে বাকবিতণ্ডা হচ্ছে। আমিসহ ছাত্রলীগের আরো দুই নেতা মিলে তাদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করি।’ এ ঘটনার পর রাতেই শাহবাগ থানার সামনে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ভিড় করেন। পরে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. মো. মাকসুদুর রহমান, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ওয়ালী আসিফ ইনান ও পুলিশ কর্মকর্তারা রাতেই থানায় ঘটনার মীমাংসা করেন। এদিন রাতেই ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে ছাত্রলীগের সাবেক ও বর্তমান নেতাকর্মীরা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্ট্যাটাস দিয়ে বিচার দাবি করেন অনেকেই। হারুনের বিচারের দাবিতে গত দুই দিন মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের বিভিন্ন হল শাখা, ছাত্রদল ও ছাত্র ইউনিয়ন। যদিও কেন্দ্রীয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ কোনো ধরনের প্রতিবাদলিপি ও কর্মসূচি দেয়নি। তবে এ ঘটনার পরদিন গত রোববার দুপুরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে দেখা করে হারুনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানানো হয় বলে জানান ছাত্রলীগের সাধারণ ওয়ালী আসিফ ইনান। তিনি আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, ‘ঘটনাটা অত্যন্ত দুঃখজনক। আমি এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। এ ঘটনা জানিয়ে আমরা সভাপতিসহ (সাদ্দাম) স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয়ের সঙ্গে দেখা করেছি। তিনি তাৎক্ষণিক তাকে (হারুন) রিলিজ করেছেন।’ হারুনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়ে গতকাল দুপুরে ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুকের সঙ্গে দেখা করেন ছাত্রলীগের দুই শীর্ষ নেতা। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সামনে সাদ্দাম বলেন, যে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাটি ঘটেছে, সেটি নিয়ে ছাত্রলীগের সব স্তরের নেতাকর্মীদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছে। আমরা সে ঘটনাটির বিচার নিশ্চিতে কাজ করছি। যে বা যারা এ ঘটনায় জড়িত ছিলেন তাদের যেন যথোপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়, সে লক্ষ্যে আমরা গতকাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছি। ডিএমপি কমিশনারের সঙ্গেও দেখা করেছি। সাদ্দাম বলেন, তাদের সবার কাছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে আমাদের দাবিগুলো সুস্পষ্টভাবে জানিয়েছি। আমাদের দাবির বিষয়ে ডিএমপি কমিশনার আশ্বস্ত করেছেন। এরইমধ্যে প্রধান অভিযুক্ত এডিসি হারুনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত শুরু হয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে এ তদন্ত শেষে জড়িত বাকিদের বিরুদ্ধেও যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ ঘটনার পর এডিসি হারুনের বিরুদ্ধে বিচার বিভাগীয় তদন্তে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। এদিন সকালে তাকে প্রথমে সদর দপ্তরে সংযুক্ত করা হয়। এরপর নতুন প্রজ্ঞাপনে তাকে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নে (এপিবিএন) বদলি করা হয়। এরপর গতকাল বিকাল সাড়ে ৫টায় তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে প্রজ্ঞাপন জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ।

টিএসসিতে মানববন্ধন : এদিকে হারুনকে বরখাস্ত ও গ্রেপ্তারের দাবিতে গত রোববার ও গতকাল মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের সাবেক কয়েকজন নেতা। মানববন্ধনে উপস্থিত ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ওয়ালি উল্লাহ বলেন, এডিসি হারুন যা করেছে এটা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। আইনের পোশাক পরে তিনি এ ধরনের কাজ কখনো করতে পারেন না।

তাকে শুধু প্রত্যাহার করলেই হবে না। সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে হবে। আরবি বিভাগের শিক্ষার্থী জিএম সাদী বলেন, এডিসি হারুনের যে ঘটনাটি গতকাল আমরা জেনেছি সেটা হলো তার নৈতিক স্খলনের কারণে। তার ব্যক্তিগত ঝামেলা নিয়ে সে সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিকভাবে, অনৈতিকভাবে আইনের বিরুদ্ধে গিয়ে, প্রশাসনিক পাওয়ার দেখিয়ে, নির্মমভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষার্থীকে অমানবিকভাবে নির্যাতন করেছে। যেটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। গতকাল ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা’ ও ‘গাজীপুর জেলা ছাত্রকল্যাণ সমিতি’ ব্যানারে আয়োজিত এক মানববন্ধনে সংহতি জানিয়ে ছাত্রলীগের সাবেক কিছু মানববন্ধনে অংশগ্রহণ করেন। সাবেক এই নেতাদের মধ্যে আছেন সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা সোহান খান, শাকিল আহমেদ, সৈয়দ আরিফ হোসেন, হাসিব মীর প্রমুখ।

মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, ছাত্র অধিকার পরিষদের নেতাকর্মী- কাউকেই ছাড় দেননি এডিসি হারুন। সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনেও তিনি হামলা করেন। এডিসি হারুন মানসিক বিকারগ্রস্ত একজন পুলিশ কর্মকর্তা। বক্তারা আরো বলেন, শিক্ষার্থী দেখলেই এডিসি হারুন হামলা করতে এগিয়ে আসেন। এমন একজনকে পুলিশের এত বড় পদে কীভাবে রাখা হয়েছে?