ঢাকা ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৯ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ডেঙ্গুর ভয়াবহতা বাড়ছে

আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে টাস্কফোর্স গঠনের তাগিদ

আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে টাস্কফোর্স গঠনের তাগিদ

দেশজুড়ে বছরব্যাপী এডিস মশার কামড়ে মানুষ মরছে এবং ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে। মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুর সংক্রমণ পরিস্থিতি দিন দিন আরো খারাপ হচ্ছে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় ঢাকা দুই সিটি কর্পোরেশন প্রত্যেক ওয়ার্ডে টাস্কফোর্স ও কমিটি গঠন করেছে। তবে এসব টাস্কফোর্স কিংবা কমিটি এডিস মশা নিধনে কার্যকর ভূমিকায় নেই। সব মিলিয়ে ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবিলায় জাতীয় পর্যায়ে উদ্যোগ গ্রহণের সময় এসেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

গতকাল বুধবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু জ্বরে ৭৬৭ জন মারা গেছেন। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১ লাখ ৫৭ হাজার ১৭২ জন। তাদের মধ্যে রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে ৬৯ হাজার ৭৬০ জন ও ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলোতে ৮৭ হাজার ৪১২ জন ভর্তি হয়েছেন। বছরের একই সময়ে আক্রান্তদের মধ্যে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন এক লাখ ৪৬ হাজার ৪১৭ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৬৫ হাজার ৮৬ জন এবং ঢাকার বাইরের ৮১ হাজার ৩৩১ জন। এর আগে ২০২২ সালে ডেঙ্গুতে দেশের ইতিহাসের সর্বোচ্চ ২৮১ জন মারা যান।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত কয়েক বছর ধরে অব্যাহতভাবে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ঘটে চললেও সেদিকে তেমন গুরুত্ব দেয়নি সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলো। ফলে গত বছরের মতো চলতি বছরেও ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে। গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার ডেঙ্গু রোগীদের অবস্থা খুব তাড়াতাড়ি অবনতি হচ্ছে।

জানা গেছে, আক্রান্তদের মধ্যে ডেঙ্গুর চারটি ধরন পাওয়া যাচ্ছে। যারা এখন আক্রান্ত হচ্ছে, তাদের মধ্যে দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যাই বেশি। তবে ডেঙ্গু রোগটি নিয়ে বড় ধরনের গবেষণা, নজরদারি নেই। এখন পর্যন্ত শুধুমাত্র হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের তথ্য স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের কাছে আসছে। কিন্তু এর বাইরেও যে বিপুল মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন, ঘরে বসে চিকিৎসা নিচ্ছেন, তাদের তথ্য কোথাও নেই।

ঢাকা দুই সিটি কর্পোরেশনে এডিস মশা নিধনে কিছু পদক্ষেপ দেখা গেলেও দেশজুড়ে বড় ধরনের কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। ফলে এডিস মশার ঘনত্ব বেড়েছে। শহর থেকে গ্রামাঞ্চলে পলিথিন, প্লাস্টিকের বোতলের ব্যবহার বেড়েছে এবং এসব পলিথিন ও প্লাস্টিক যত্রযত্র ফেলে রাখায় পানি জমে যাওয়া, এতে সহজেই এডিস মশা জন্মায়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের ৬৪টি জেলায় ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। ডেঙ্গু মৌসুমের আগেই আক্রান্তের সংখ্যা ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে ২৫ থেকে ৪০ বছর বয়সি ব্যক্তিরা ডেঙ্গুতে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। আক্রান্তদের বেশিরভাগই ঢাকা শহরের বাসিন্দা।

চলতি বছরে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ায় ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) জুলাইয়ে ডেঙ্গু মোকাবিলায় প্রতিটি ওয়ার্ডে কাউন্সিলরকে আহ্বায়ক করে ৭ সদস্যের টাস্কফোর্স কমিটি গঠন করে। আদেশে উল্লেখ করা হয়, টাস্কফোর্স কমিটির দায়িত্ব হবে মশার সম্ভাব্য প্রজনন স্থানের তালিকা প্রস্তুত করা, যেমন নির্মাণাধীন ভবন, সুউচ্চ ভবন, টিনশেড বাড়ি, সরকারি অফিস, বেসরকারি অফিস, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শপিংমল, মার্কেট, হোস্টেল, ছাদবাগান, পরিত্যক্ত বাড়ি, জলাশয়, ড্রেন, খোলাবাজার ইত্যাদি এবং লার্ভা শনাক্তকরণ ও ধ্বংস করা। এছাড়া ডেঙ্গু রোগীর তালিকা প্রস্তুত করাসহ ডাটা এন্ট্রির কাজ করার কথাও আদেশে বলা হয়েছে। অন্যদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) এডিস মশা নিধনে প্রত্যেক ওয়ার্ড কাউন্সিলরকে আহ্বায়ক করে দশ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে।

ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন রোগতত্ত্ববিদ ড. মুশতাক হোসেন বলেন, বছরব্যাপী মানুষ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছেন। শহর-গ্রাম সবখানে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা ছড়িয়ে পড়েছে। এডিস মশা নিধনে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে আগামীতে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়ে যেতে পারে। আর আক্রান্ত বেশি হলে মৃত্যুর সংখ্যাও বেশি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সেজন্য আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার জন্য একটা টাস্কফোর্স গঠন করা দরকার।

তিনি বলেন, আবহাওয়া ও জলবায়ুর পরিবর্তন, তাপমাত্রার তারতম্য হ্রাস, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, অপরিচ্ছন্নতা ইত্যাদি কারণে সারা দেশে এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। ফলে ডেঙ্গু রোগটি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এতে দেশের ২৫ শতাংশ মানুষ অন্তত একবার ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে। অর্থাৎ প্রতি চারজনে একজন এরইমধ্যে এক বা একাধিকবার ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে।

এই বিশেষজ্ঞের মতে, দেশে ডেঙ্গু রোগের সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে শিশু, গর্ভবতী নারী এবং বৃদ্ধরা। তাই তাদের নিরাপত্তার বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া উচিত। এছাড়া ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে যাদের মৃত্যু হয়, তাদের ডেথ রিভিউ হয় খুব ধীরে। এটা আরো দ্রুত করা উচিত। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কীটতাত্ত্বিক জরিপ এবং আন্তঃমন্ত্রণালয় টাস্কফোর্স গঠনের পরামর্শ দেন এই রোগতত্ত্ববিদ।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং হেলথ অ্যান্ড হোপ স্পেশালাইজড হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. লেলিন চৌধুরী আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, ২০১৯ সালে এডিস মশার বিস্তারের মধ্য দিয়ে সারা দেশে ডেঙ্গু জ্বর ছড়িয়ে পড়েছে। এই এডিস মশা নিধনে বর্তমানে দুই সিটি কর্পোরেশন কিংবা প্রত্যেকটি পৌরসভায় খণ্ড খণ্ড টাস্কফোর্স অথবা কমিটি গঠন করেও কোনো লাভ হবে না। কারণ মশা তো গ্রাম ও শহর বোঝে না। সেজন্য এডিস মশা নিধনে জাতীয় পর্যায়ে সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। জনগণ যাতে করে এডিস মশা নিধনে একযোগে কাজ করতে পারে, এটি জাতীয়ভাবে নির্দেশনা দিতে হবে।

সম্প্রতি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় ডেঙ্গু প্রতিরোধে পাঁচটি সচেতনতামূলক পরামর্শ দিয়েছে। এতে বলা হয়, সারা দেশে এডিস মশার বিস্তার ব্যাপকভাবে বেড়েছে। সাম্প্রতিককালে ডেঙ্গু রোগীর আক্রান্তের হার আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। প্রথমে বলা হয়েছে- জ্বরের শুরুতে অবশ্যই নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ডেঙ্গু শনাক্তকরণ পরীক্ষাসহ প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা নিতে হবে। দ্বিতীয়ত, বাসার ভেতরে ও চারপাশে, নির্মাণাধীন ভবন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ ভবনের বিভিন্ন স্থানে জমে থাকা পানি অপসারণ করতে হবে। তৃতীয়ত, দিনে অথবা রাতে ঘুমানোর সময় অবশ্যই মশারি ব্যবহার করতে হবে। চতুর্থত, ডেঙ্গু জ্বর কমে গেলে অবহেলা না করে অবশ্যই পরবর্তী জটিলতা এড়াতে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া। পঞ্চমত, এ বিষয়ে অবহেলা জীবন সংশয়ের কারণ হতে পারে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ডা. ফজলে শামসুল কবির আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, এডিস মশা নিধনে ডিএসসিসির প্রত্যেকটি ওয়ার্ডে কাউন্সিলদের আহ্বায়ক করে কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেখানে আবার টাস্কফোর্স গঠনের দরকার নেই। কারণ টাস্কফোর্স মানেই তো ‘কমিটি’ গঠন।

স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. হেমায়েত আকবর টিপু আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, সারা দেশে এডিস মশা নিধনের বিষয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে বেশ কয়েকটি বৈঠক হয়েছে। এসব বৈঠকে এডিস মশা নিধন নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু মাঠপর্যায়ে মন্ত্রণালয় তো কোনো বাস্তবায়ন সংস্থা নয়, এডিস মশা নিধন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করবে সিটি কর্পোরেশন। তবে ডেঙ্গু মোকাবিলায় জাতীয় পর্যায়ে টাস্কফোর্স গঠনের বিষয়ে, তিনি কিছু জানেন না।

অন্যদিকে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা মকবুল হোসাইন আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, এডিস মশা নিধনে মশকনিধন কর্মীরা নিয়মিত মাঠে কাজ করছেন। আর যাদের নিয়ে টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে তারা জনস্বার্থে জনসচেতনতার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে সিটি কর্পোরেশন ও মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে টাস্কফোর্স গঠনের বিষয়টি নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে বলতে পারবেন।

প্রসঙ্গত, দেশে প্রথম ডেঙ্গু শনাক্ত হয় ১৯৬৫ সালে। তখন এই রোগটি ঢাকা ফিভার নামে পরিচিত ছিল। কিন্তু ২০০০ সালের পর থেকে

রোগটির সংক্রমণ বাড়তে শুরু করে। তবে করোনা মহামারির বছরে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা কমে ছিল। গত বছর থেকে ফের ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়েছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত