মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে আগুন

মিলছে না অনেক প্রশ্নের উত্তর

* হতাহতের ঘটনা নেই * পুড়ে গেছে ৪০০ কোটি টাকার মালামাল

প্রকাশ : ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

আবার সেই আগুন। আগুনের লেলিহান শিখার সঙ্গে কালো ধোঁয়ায় ভোরের আকাশ আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। গত বুধবার ভোর রাতে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে কৃষি মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ব্যবসায়ীদের ঘুম ভেঙে যায়। তারা তড়িগড়ি করে আসতে থাকেন তাদের রুটিরুজির অবলম্বন দোকানের পানে। মার্কেটে ভেতরে প্রবেশ করার মতো অবস্থা না থাকায় বাইরে দাঁড়িয়ে তারা অসহায় দর্শকের মতো বিলাপ করতে থাকেন। সহায়-সম্বল পুড়ে যেতে দেখে অনেকে কান্নায় ভেঙে পড়েন। অনেকে ভাগ্যকে দোষারোপ করতে থাকেন। গতকাল সকাল সাড়ে ৯টার দিকে আগুন যখন পুরোপুরি নিভে যায়, তখন প্রকাশ পেতে থাকে নানা রকম অজানা তথ্য ও নানা অসঙ্গতি। এসব তথ্য আগে জানা থাকলে ব্যবসায়ীরা এমন বিপদের মুখোমুখি হতেন না। মোহাম্মদপুরে কৃষি মার্কেটে ছিল না অগ্নি নির্বাপণের ব্যবস্থা, ছিল না পানির উৎস, মার্কেটটি যে অগ্নি ঝুঁকিপূর্ণ ছিল সেটিও ব্যবসায়ীরা জানতেন না। মার্কেটটির মালিকানা প্রতিষ্ঠান সিটি কপোরেশনের তালিকায় ছিল না অগ্নি ঝুঁকিপূর্ণ। যারা ব্যবসা করবেন, আর যারা দোকান বরাদ্দ দেবেন, তাদের এসব বিয়ষ জানা উচিত ছিল। তবে তারা তা জানেননি। জানার চেষ্টাও করেছেন বলে দৃশ্যত মনে হয় না। ব্যবসা পরিচালনায় এই মার্কেটটি যে অনুপযোগী ছিল, সেটা আগুন লাগার পর মানুষ জানতে পারল। ঘটনা ঘটার পর জেনে তো কোনো লাভ নেই। প্রশ্ন উঠছে মার্কেটটিতে গ্যাসের কোনো কিছু ছিল না, কোনো রাসায়নিক দ্রব্য ছিল না, বিদ্যুৎ ছিল বন্ধ, শর্ট সার্কিট হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও থাকতে পারে, তবে সেটা জোরালো নয়। আবার আগুন লাগার সময়টা নিয়েও নানাজনের নানা মত। তারা বলছেন, রাজধানীতে এর আগে যেসব মার্কেটে অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে, সেই সময়টি ছিল ভোরবেলা। ভোরবেলা আগুন লাগার কারণে মালের ওপর দিয়ে গেলেও যানরক্ষা পেয়েছে। গত বুধবার দিবাগত ভোররাত ৩টা ৪৩ মিনিটে আগুনের সূত্রপাত হয়ে গতকাল সকাল ৯টা ২৫ মিনিটে তা নিয়ন্ত্রণে আসে। ততক্ষণে পুড়ে শেষ হয়ে যায় প্রায় ৪০০ দোকান। ক্ষয়ক্ষতির কোনো বিবরণ তাৎক্ষণিকভাবে জানা না গেলেও ধারণা করা হচ্ছে ৪০০ কোটি টাকার মালামাল পুড়ে গেছে। এই মার্কেটি থেকে তুলনামূলক কমদামে মানুষ কেনাকাটা করতেন বলে আশপাশের এলাকার মানুষ ওই মার্কেটে ছুটে আসতেন। আগুন নেভানোর কাজে পুলিশ, র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব), বিজিবি, সেনা-নৌ-বিমান বাহিনী, এনএসআই ও স্কাউটের ভলান্টিয়ার সদস্যরা অংশ নেন। সহায়তা করেন সাধারণ মানুষও। তবে মহান আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশনস অ্যান্ড ম্যানটেনেন্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. তাজুল ইসলাম বলেছেন, এই মার্কেটে প্রাথমিক ফায়ার ফাইটিংয়ের কোনো ইক্যুইপমেন্টই ছিল না। কোনো ধরনের পানির সোর্স ছিল না। আমরা সব থেকে বেশি বেগ পেয়েছি, পানির সোর্স না থাকার কারণে। এখানে বিভিন্ন ভবনে পানির সোর্স রয়েছে; কিন্তু তা পর্যাপ্ত নয়। খুব দ্রুত আমাদের পানি শেষ হয়ে যায়। আমরা বিশেষ পানিবাহিত গাড়ি এনে এবং অন্যান্য বাহিনীর সহায়তায় আমরা এই কার্যক্রম চালিয়ে যাই। আগুন নেভানোর এত সময় লাগার কারণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আগুন নেভানোর আরেকটি বড় বাধা ছিল মানুষের ভিড়। মানুষের ভিড় নিয়ন্ত্রণ করতে আমাদের পুলিশ, বিজিবি তারা খুবই হিমশিম খেয়েছে। এই ভিড়ের কারণে আমাদের এতো সময় লেগেছে। তিনি বলেন, আগুনের সূত্রপাত আমরা তদন্ত করে জানার চেষ্টা করব। আগুন নিয়ন্ত্রণের কাজে যারা ছিল, তাদের দুই একজন কিছুটা আহত হয়েছেন। এর বাইরে কোনো বড় ধরনের হতাহতের তথ্য নেই। রাজধানীর মোহাম্মদপুরে কৃষি মার্কেটের আগুনে প্রায় ৪০০ দোকান পুড়ে গেছে বলে দাবি করছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, মার্কেট ও কাঁচাবাজারে বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে প্রায় ৭০০ থেকে ৮০০ দোকান ছিল। ফায়ার সার্ভিসের সদরদপ্তরে মিডিয়া সেলের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহজাহান সিকদার জানিয়েছেন, ফায়ার সার্ভিসের ১৭টি ইউনিট কাজ করে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে সকাল ৯টা ২৫ মিনিটে।

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের কৃষি মার্কেটে লাগা আগুনের সূত্রপাত কাঁচা বাজারের প্রবেশ মুখে থাকা হক বেকারি থেকে। এমন দাবি করেছেন কৃষি মার্কেট নতুন কাঁচাবাজার মালিক সমিতির অফিস সহকারী মুশফিকুর রহমান লিটন। তিনি বলেন, রাত তিনটার দিকে নিরাপত্তাকর্মীরা এসে আমাকে জানান হক বেকারি থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে আমি ছুটে গিয়ে দেখি আগুন ধরে গেছে। পরে অফিসে এসে ফায়ার সার্ভিসকে ফোন দেই। এর আধা ঘণ্টা পর ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি আসে, ততক্ষণে আগুন ছড়িয়ে যায়। প্রথমে পানির সংকট থাকায় ফায়ার সার্ভিসকে আগুন নিয়ন্ত্রণে বেগ পেতে হয়েছে। পরে আশপাশের বাড়ি থেকে পানি নেওয়া হয় বলেও জানান লিটন। ফায়ার সার্ভিস জানায়, ভোর ৩টা ৪৩ মিনিটে মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের খবর পায় ফায়ার সার্ভিস। খবর পেয়ে প্রথমে সাতটি ইউনিট ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়। প্রথম ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছায় ভোর ৩টা ৫২ মিনিটে। পরে ধাপে ধাপে ইউনিট বেড়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে যোগ দেয় ফায়ার সার্ভিসের ১৭টি ইউনিট। ফায়ার সার্ভিস মিডিয়া সেলের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহজাহান শিকদার জানান, সকাল ৯টা ২৫ মিনিটে মার্কেটের আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে। রাজধানীতে সিটি করপোরেশন ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেটের যে তালিকা করেছে এর মধ্যে নেই মোহাম্মদপুরের কৃষি মার্কেট। তবে এবার ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর সংশ্লিষ্টরা বলছেন মার্কেটটিতে অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম রেজা বলছেন, যেই কমিটি ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেটের তালিকার করেছে সেসময় এ মার্কেটটি তালিকায় ঢুকেনি। কৃষি মার্কেটের এখন পর্যন্ত ডিএনসিসির বরাদ্দ দেওয়া ৩১৭টি দোকানের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২১৭টি। অবৈধ দোকানগুলো ছিল ফুটপাতে। আর ফায়ার সার্ভিসও বলেছে, ভেতরে পর্যাপ্ত অগ্নি নিরাপত্তাব্যবস্থা ছিল না। ঢাকার জেলা প্রশাসক (ডিসি) আনিসুর রহমান বলেছেন, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমরা অতি দ্রুত ক্ষতিগ্রস্তদের একটি তালিকা করব। তারপর আমরা সরকারের পক্ষ থেকে তাদের মানবিক সহায়তা করার চেষ্টা করব। ফায়ার সার্ভিস কিংবা ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) পক্ষ থেকে কৃষিমার্কেট ব্যবসায়ীদের অগ্নি নিরাপত্তা বাড়াতে বারবার বলা হয়েছে দাবি করলেও ব্যবসায়ীরা বলছেন অন্যকথা। কোনো কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ফায়ার সেফটি বাড়ানো কিংবা মার্কেটটি ঝুঁকিপূর্ণ এমন কোনো নোটিশ ব্যবসায়ীরা পাননি বলে দাবি করেছেন, ঢাকা মহানগর ব্যবসায়ী দোকান মালিক সমিতির সভাপতি আরিফুর রহমান টিপু। তার দাবি, কৃষি মার্কেটে লাগা ভয়াবহ আগুনে ৩০০ থেকে ৩৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। ৪০০ দোকানের মধ্যে পুড়ে গেছে তিন শতাধিক দোকান। এজন্য দোকানের মালিকদের নয়, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদেরকেই যেন ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। প্রত্যেকটি দোকানে সুলভমূল্যে পণ্য বিক্রি হয়, যে কারণে কৃষি মার্কেট খুবই জনপ্রিয়। প্রত্যেকটি সিটি করপোরেশনের মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ভোরে। যখন বৈদ্যুতিক ইউনিট ব্যবহার জিরাতে থাকে। এমন সময় আগুন লাগার ঘটনা অবশ্যই তদন্ত হওয়া উচিত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

ফায়ার সার্ভিসের নোটিশ ও ডিএনসিসি কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা দেওয়ার পরেও ফায়ার সেফটি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। টিনশেড মার্কেট ভেঙে বহুতল মার্কেট করার কথা বলেছে সিটি করপোরেশন। ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, যার যে দোকান, সে যেন সেটি বরাদ্দ পায়। বাইরে থেকে কোনো লোকজন এসে যেন বরাদ্দ না পায়। আগুন লাগলে ক্ষতি তো হয় দোকান ব্যবসায়ীর, দোকান মালিকের নয়। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশনস অ্যান্ড ম্যানটেনেন্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. তাজুল ইসলাম বলেছেন, মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে কোনো ফায়ার সেফটি ছিল না। আগুনের খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা এসে মার্কেটের নিরাপত্তারক্ষীদেরও খুঁজে পাননি। একপর্যায়ে তালা ও গেট ভেঙে ভেতরে ঢুকে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। তাজুল ইসলাম বলেন, রাজধানীর মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে কোনো ফায়ার সেফটি ছিল না। প্রাথমিক ফায়ার ফাইটিংয়ের কোনো ব্যবস্থাই ছিল না। ফুটপাত ও সড়কে দোকান থাকা ও মানুষের কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে সমস্যা হয়েছে। এখানে পানির পর্যাপ্ত ব্যবস্থাও ছিল না। তিনি বলেন, আগুনের খবর পেয়ে ৯ মিনিটের মাথায় আমরা এখানে চলে আসি। রাত ৩টা ৫২ থেকে আমরা এখানে আগুন নির্বাপণের চেষ্টা করি। সকাল ৯টা ২৫ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণ করেছি। ১৭টি ইউনিটে ১৫০ জন ফায়ার ফাইটার কাজ করেছেন। ফায়ার ফাইটারদের সঙ্গে বিজিবি, পুলিশ, র‌্যাব, সেনাবাহিনী-নৌবাহিনীর সদস্যরাও সহযোগিতা করেছেন। তিনি বলেন, এই মার্কেটটিতে বারংবার নোটিশ দেওয়া হয়েছে এবং বিভিন্নভাবে গণসংযোগ করা হয়েছে। কিন্তু সেভাবে তারা সাড়া দেননি। এই মার্কেটটা কিছুটা বঙ্গবাজার টাইপের। এখানে ভেতরে অনেক ছোট ছোট গলি ছিল, যেগুলো পুরোটাই বিভিন্ন মালামালে দিয়ে গাদাগাদি করে রাস্তা বন্ধ ছিল। পুরো মার্কেট টাইট কলাপসিবল গেট দিয়ে আটকানো ছিল। তিনি আরো বলেন, এখানকার নাইট গার্ড যারা ছিলেন তারা বাইরে ছিলেন। তাদের খুঁজেই পাওয়া যায়নি তেমন একটা। ভেতরে ফায়ার ফাইটারদের প্রবেশ করতে বেগ পেতে হয়েছে। তালা ভেঙে এবং কলাপসিবল গেট ভেঙে ভেতরে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করি। তিনি বলেন, এ মার্কেটের বাইরেও বিভিন্নভাবে রাস্তাগুলো দখল করা ছিল। দোকানের সামনে ছোটখাটো দোকান আমাদের কালচার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এগুলোর জন্য আমাদের বেগ পেতে হয়। আমরা আসার পরই আগুনের মাত্রা অনেক বেশি দেখেছি। একটা পর্যায়ে মার্কেটের প্রায় চার ভাগের তিনভাগ সম্পূর্ণ আগুন ধরে যায় এবং আমরা চেষ্টা করি এই মার্কেটের ভেতরে যেন আগুন আবদ্ধ থাকে। ফায়ার ফাইটাররা সর্বাত্মক চেষ্টা করে আগুন একটা জায়গায় সীমাবদ্ধ রাখতে পেরেছেন। রাজধানীর মোহাম্মদপুরে কৃষি মার্কেটের আগুনে প্রায় ৪০০ দোকান পুড়ে গেছে বলে দাবি করছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, মার্কেট ও কাঁচাবাজারে বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে প্রায় ৭০০-৮০০ দোকান ছিল। ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, ঢাকা শহরে যতগুলো ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেট আছে সরকার সেগুলো বন্ধ করে দিক। আগুনে সর্বস্বান্ত হয়ে যাওয়ার পর কেন শুনতে হবে এটা ঝুঁকিপূর্ণ। রাজধানীর মোহাম্মদপুরে কৃষি মার্কেটে রাতে বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ থাকে। বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ থাকার পরও কীভাবে আগুন লাগল- এর কারণ খুঁজছেন ব্যবসায়ীরা।