ডেঙ্গুতে প্রতিদিনই ঘটছে মৃত্যু

স্যালাইন সংকটে আতঙ্ক বাড়ছে

* মুনাফার লোভে অসাধু ব্যবসায়ী। * সরকারকে দায়িত্বশীল হতে হবে : জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ।

প্রকাশ : ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

করোনা মহামারির সময়ে মাস্কের ব্যবহার বাড়ায় ২ টাকার মাস্ক গিয়ে দাঁড়ায় ২০০ থেকে ৩০০ টাকায়। পরে করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে এলে সেই মাস্কের দাম দাঁড়ায় ২ টাকায়। দেশের ভেতর যেকোনো মহামারি কিংবা দুর্যোগ এলেই মানুষের জীবনকে পুঁজি করে ওষুধ থেকে শুরু করে বিভিন্ন পণ্য সামগ্রীর দাম আকশচুম্মি হয়ে যায়। সিন্ডিকেট কিংবা কৃত্রিম সংকট তৈরি করে অধিক মুনাফার আশায় একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী ব্যবসা করেন। বর্তমানে এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গু জ্বরের মানুষের আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে। এসময়ে ফ্লুইড স্যালাইনের চাহিদা বাড়ছে। কিন্তু রাজধানীসহ সারা দেশে ওষুধের দোকানে স্যালাইন সংকটে পড়েছেন রোগীরা। এদিকে গতকাল সারা দেশে ডেঙ্গুতে ১২ জন মারা গেছে। আর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ২ হাজার ১২৯ জন। এ নিয়ে চলতি বছরে ডেঙ্গু মারা গেছে ৭৯০ জন। আক্রান্ত হয়েছে ১ লাখ ৬১ হাজার ৯৬৪ জন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে কোনো মহামারি কিংবা দুর্যোগ এলেই অসাধু ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফার লোভে বাজার সিন্ডিকেট করে থাকেন। এই সিন্ডিকেটের মধ্যে ওষুধ থেকে শুরু করে খাবার দ্রব্য থাকছে। কারণ ওইসব অসাধু ব্যবসায়ীরা জানেন যে, মানুষের জরুরি প্রয়োজনীয় ওষুধ ও খাবার সামগ্রী যখন প্রয়োজন হয়, তখন বেশি টাকা হলেও কিনতে হবে। এই সুযোগে সিন্ডিকেট করে কয়েক দিনের মধ্যেই অধিক মুনাফা করে ব্যবসায়ীরা।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, মহাখালী উত্তর সিটি করপোরেশন হাসপাতালসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগী ভর্তির সংখ্যা বাড়ছে। এতে ডেঙ্গুরোগীর প্রয়োজনীয় স্যালাইনের চাহিদা বেড়েছে কয়েকগুণ। এতে রাজধানীসহ সারাদেশেই স্যালাইনের সংকট তৈরি হয়েছে। এতে বিপাকে পড়েছেন রোগীরা।

জানা গেছে, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়াধীন জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে (আইপিএইচ) স্যালাইন উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। সরকারি হাসপাতালগুলোতে স্বল্পমূল্যে আইভি ফ্লুইড স্যালাইন সরবরাহ করছিল। কিন্তু সরকারি প্রতিষ্ঠানে উৎপাদন বন্ধ থাকায় এর সুবিধা নিচ্ছে সংশ্লিষ্ট কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে ওরিয়ন ফার্মা, পপুলার ফার্মা, বেক্সিমকো ফার্মা, অপসো স্যালাইন, লিব্রা ইনফিউশনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো স্যালাইন উৎপাদন করছে। এরই মধ্যে ওরিয়ন ফার্মা সরকারি হাসপাতালে স্যালাইন সাপ্লাই দিচ্ছে। অন্যদিকে, বেসরকারি হাসপাতালগুলো পপুলার, বেক্সিমকো ফার্মা থেকে কিছু কিছু স্যালাইন পাচ্ছে। অপসোর স্যালাইন, লিব্রার স্যালাইন বাজারে তেমন একটা পাওয়া যাচ্ছে না।

সরেজমিন রাজধানীর মিরপুর ১২, মিরপুর ১১, মিরপুর ১০, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, আগারগাঁও, শনিরআখড়া, যাত্রাবাড়ী ও ঢাকা মেডিকেলের চারপাশে বেশ কয়েকটি ফার্মেসিতে আইভি স্যালাইন খুঁজে পাওয়া যায়নি। অনেকেই স্যালাইন কিনতে এসে ফিরে যাচ্ছেন। একই অবস্থা রাজধানী মুগদা হাসপাতালের চারপাশে থাকা ফার্মেসিগুলোতে। শাহেনুর ফার্মেসিতে স্যালাইন কিনতে এসেছেন সাইদ হোসেন। তিনি বলেন, তার বোন ডেঙ্গু আক্রান্ত। বাসায় থেকেই চিকিৎসা নিচ্ছেন। এখন আগের তুলনায় সুস্থ, তবে শরীর অনেক দুর্বল। খেতে পারছেন না। প্ল্যাটিলেট আগের তুলনায় বাড়ছে। তাই চিকিৎসকের পরামর্শে স্যালাইন দিচ্ছি। আশপাশের ফার্মেসিগুলোতে স্যালাইন পাওয়া যায়নি। পরে এক ফার্মেসির কর্মচারীর পরামর্শে এখানে এসেছি। গতকাল বেলা একটায় রাজধানীর কাঁঠালবাগানের মোজাহিদুল ইসলাম নামে এক ওষুধের দোকানি বলেন, দোকানে স্যালাইন নেই এক সপ্তাহের বেশি। চারটি ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিকে স্যালাইনের কথা বলেছি। কিন্তু তাদের সরবরাহ এখন বন্ধ। রাজধানীর শাহবাগ এলাকার চারটি দোকানে স্যালাইনের সরবরাহ পরিস্থিতি জানার জন্য দোকানিদের সঙ্গে কথা বলা হয়। একটি দোকানের মালিক বলেছেন, তার দোকানে স্যালাইন নেই। একটি দোকানের মালিক বলেছেন, স্যালাইনের সরবরাহ কম। একটি বড় দোকানের পুরোনো এক কর্মচারী বলেছেন, তাদের দোকানে স্যালাইন নেই। সংকট চলছে বেশ কিছুদিন ধরে। শুধু একটি দোকানের মালিক বলেছেন, তার দোকানে স্যালাইন আছে।

বাড্ডার ইবনে সিনা ডায়াগনস্টিক ও কনসালটেশন সেন্টারের পাশে অবস্থিত মইন ফার্মার স্বত্বাধিকারী মো. আবুল মনসুর বলেন, কোম্পানিগুলো সাপ্লাই দিতে পারছে না। চাহিদা থাকলেও জোগান নেই পর্যাপ্ত। ইবনে সিনার ফার্মেসিতে গিয়েও একই চিত্র দেখা যায়। সেখানে কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ইবনে সিনা হাসপাতালে ডেঙ্গুরোগী ভর্তি হলে স্যালাইন ব্যবস্থা করে দিতে হয়। কিন্তু সরবরাহকারী কোম্পানিগুলোর কাছে ৫০০ স্যালাইনের চাহিদা দেওয়া হলে পাওয়া যায় ৫০টি। কোম্পানিগুলো স্যালাইন সাপ্লাই দিতে পারছে না।

চিকিৎসকরা বলছেন, ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ায় শিরায় প্রয়োগের স্যালাইনের (আইভি ফ্লুইড) চাহিদা কয়েকগুণ বেড়েছে। দেখা দিয়েছে সরবরাহ ঘাটতি। এ সুযোগে অতি মুনাফা লোভী কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছে। ছয়-সাত গুণ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১০ গুণ বেশি দামে একই স্যালাইন বিক্রি করছে ফার্মেসিগুলো। পরিস্থিতি সামাল দিতে নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চালিয়েও কোনো রফা করা যাচ্ছে না।

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, ডেঙ্গুর প্রকোপে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় অনেক অসাধু ব্যবসায়ী বেশি দামে স্যালাইন বিক্রি করছেন। তারা কারণ হিসেবে সরবরাহ সংকটকে দায়ী করেন। কিন্তু ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বলছে, যতক্ষণ মজুত আছে ততক্ষণ গায়ে লেখা দামেই বিক্রি করতে হবে। দাম সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য থেকে এক টাকাও বাড়তি নেওয়া যাবে না।

সফিকুজ্জামান বলেন, ডেঙ্গুর প্রকোপকে কাজে লাগিয়ে ওষুধ বিক্রেতারা মজুত করার পাশাপাশি বেশি দামে স্যালাইন বিক্রি করছেন। এ নিয়ে অভিযান-জরিমানা করেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। কথা স্পষ্ট এমআরপি বা স্যালাইনের গায়ে যেটা লেখা আছে সেটা সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য। এর বাইরে এক টাকাও বেশি দামে বিক্রি করা যাবে না। কৃত্রিম সংকটের কথা বলে বাড়তি দাম নেওয়া যাবে না। বেশি দামে স্যালাইন বিক্রি করলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

স্বাস্থ্যসেবা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইভি স্যালাইন শুধু ডেঙ্গুই নয়- সিজার, সার্জারি, ডায়ালাইসিসসহ বিভিন্ন চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়। এই স্যালাইনের সংকটে চিকিৎসাসেবা ব্যাহতসহ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে রোগীরা। প্রতিদিন একজন ডেঙ্গু রোগীর শরীরে এক থেকে দুই লিটার স্যালাইন প্রয়োগ করতে হয়। চাহিদা বাড়ার এই সুযোগটাই নিচ্ছে অসাধু ওষুধ ব্যবসায়ীরা।

ওষুধ প্রশাসন জানিয়েছে, দেশে উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি কারসাজি রোধে বিদেশ থেকে স্যালাইন আনা হচ্ছে। সরকারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ ৭টি ওষুধ কোম্পানির মধ্যে ৬টি কোম্পানি এখন সপ্তাহের ৭ দিনই ৩ শিফটে ২৪ ঘণ্টা উৎপাদনে রয়েছে। এসব কোম্পানি দিনে ১ লাখ ১০ হাজার থেকে ১ লাখ ২০ হাজার ব্যাগ স্যালাইন উৎপাদন করছে। এ ছাড়া আমদানি করা ৭ লাখ ব্যাগ স্যালাইন দ্রুতই দেশে পৌঁছাবে। সবমিলিয়ে দ্রুতই আইভি ফ্লুইডের চাহিদা পূরণ হবে। সংকটকালে মজুত করে স্যালাইনের দাম বাড়ানোর প্রমাণ পেলে ফার্মেসির লাইসেন্স বাতিলসহ, তা বন্ধের নির্দেশনা দেওয়া হবে।

পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকার ৭ লাখ ব্যাগ স্যালাইন আমদানির অনুমতি দিয়েছে বলে জানান ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. নুরুল আলম। দেশীয় কোম্পানিগুলো এখন প্রতিদিন গড়ে ১ লাখ ১০ হাজার থেকে ১ লাখ ২০ হাজার ব্যাগ স্যালাইন উৎপাদন করছে।

দেশের কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ‘ঝোপ বুঝে কোপ মারে’ মন্তব্য করে নুরুল আলম বলেন, কোনো কারণে সামান্য সংকট তৈরি হলে তারা আরও

বেশি কৃত্রিম সংকট তৈরি করে। মানুষকে ভোগান্তিতে ফেলে, দাম বেশি

নেয়। এ জন্য বাজার মনিটরিং করতে আমরা ঢাকায় আটটি টিম করে দিয়েছি। কোথাও যদি কেউ স্যালাইন মজুত করলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

স্যালাইনের এই সংকটের মুহূর্তে রাজধানীর মহাখালীতে অবস্থিত দেশের একমাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠান জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের কারখানা স্যালাইন সরবরাহ করছে না। ৩ বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদন বন্ধ।

ফলে প্রতিষ্ঠানটির স্যালাইন ইউনিটের অন্তত ৬০০ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি নষ্ট হচ্ছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) হেমাটোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সালাউদ্দিন শাহ বলেন, ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তের জলীয় অংশ কমে যায়। এতে রক্তের ঘনত্ব বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি রক্তচাপ কমে যায়। রক্তের তারল্য ঠিক রাখতে ও রক্তচাপ স্থিতিশীল রাখতে রোগীকে স্যালাইন দিতে হয়। একজন রোগীকে দিনে এক থেকে দুই লিটার স্যালাইন দিতে হয়। কোনো কোনো রোগীর এর বেশি প্রয়োজন হতে পারে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারি হাসপাতালে রোগীরা বিনা মূল্যে স্যালাইন পান। বর্তমানে বেসরকারি ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে স্যালাইন কিনে

সরকারি হাসপাতালে সরবরাহ করে। গত বছর সরকারি হাসপাতালে ৬০

লাখ স্যালাইন সরবরাহ করেছিল। এ বছর স্যালাইনের সংখ্যা কোটি ছাড়িয়ে যেতে পারে।

রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শয্যাসংখ্যা ৫০০। গত মাসের কোনো কোনো দিন হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি করা হয় ৬০০-এর বেশি। এ ছাড়া অন্য রোগীও ছিল। রাজধানীর গ্রিন রোডের একটি বেসরকারি হাসপাতালের একজন জ্যেষ্ঠ চিকিৎসক বলেন, বেশ কয়েকজন রোগীর কাছ থেকে জানা যায় যে, তারা দোকানে সাধারণ স্যালাইন পাচ্ছেন না। তখন হাসপাতাল থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, সাধারণ শিরায় দেওয়া স্যালাইন শুধু ডেঙ্গু রোগীদের দেওয়া হবে। অন্য রোগীরা সাধারণ স্যালাইন পাবেন না।

সরকারের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ বলেন, চলতি বছরে প্রতিদিন ডেঙ্গুতে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন এবং মারাও যাচ্ছেন। এখানে হঠাৎ কর ডেঙ্গু রোগী বাড়েনি। যারা স্যালাইন উৎপাদন করে তাদের আগেই সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। ওষুধ কোম্পানিগুলোকে স্যালাইনের উৎপাদন বাড়াতে হবে।

স্যালাইন সংকটের বিষয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং হেলথ অ্যান্ড হোপ স্পেশালাইজড হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. লেলিন চৌধুরী আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, প্রত্যেক বছরেই দেশে কোনো না কোনো মহামারি কিংবা দুর্যোগের মুহূর্তে মানুষকে পুঁঁজি করে অসাধু ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করছেন। অল্প সময়ে কোটি কোটি টাকা মুনাফা করে নিচ্ছেন। অসাধু ব্যবাসয়ীদের বিরুদ্ধে কঠোরব্যবস্থা নিতে হবে। দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকারকে দায়িত্বশীল হতে হবে। সেই কাজটি না হওয়ায় দুর্ভোগ বাড়ছে।