ঢাকা ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৯ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

চট্টগ্রামে মেডিকেল বর্জ্য রিসাইক্লিং করে ব্যবহার

জটিল রোগব্যাধি ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা
চট্টগ্রামে মেডিকেল বর্জ্য রিসাইক্লিং করে ব্যবহার

চট্টগ্রাম নগরীতে কোনো ধরনের নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করেই ‘মেডিকেল বর্জ্য’ অপসারণ করা হচ্ছে। এতে জনস্বাস্থ্যের উপর মারাত্মক হুঁমকি সৃষ্টি হচ্ছে। যেখানে সেখানে মারাত্মক জীবাণুযুক্ত সিরিঞ্জ, ক্যানোলা ও সুইসহ নানা বর্জ্য পড়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। এসব বর্জ্য পুড়িয়ে ফেলার পরিবর্তে বিক্রি করা হচ্ছে ভাঙারির দোকানে। যত্রতত্র মেডিকেল বর্জ্য পড়ে থাকায় উদ্বেগ বেড়েছে লোকজনের মধ্যে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, মেডিকেল সামগ্রী যথাযথভাবে অপসারণ না হলে মারাত্মক রোগব্যাধি ছড়িয়ে পড়তে পারে। বিশেষ করে হেপাটাইটিস বি ও সি এবং এইডস- যক্ষ্মার মতো মারাত্মক রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

জানা গেছে, নগরীর চিকিৎসা বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ‘চট্টগ্রাম সেবা সংস্থা’ নামে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি রয়েছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক)। চুক্তি অনুযায়ী, শহরের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের প্রতিদিনের বর্জ্য সংগ্রহ করা হবে। এরপর তা নির্দিষ্ট ডাম্পিং স্থানে ইনসিনারেটরের মাধ্যমে পুড়িয়ে ফেলবে প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু সংগৃহীত ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্য না পুড়িয়ে বিক্রি করা হচ্ছে ভাঙারির দোকানে। সম্প্রতি পরিবেশ অধিদপ্তর এক অভিযান চালানোর সময় ভাঙারির দোকানে মেডিকেল বর্জ্য খুঁজে পায়। এরপর মেডিকেল বর্জ্য নিয়মবহির্ভূতভাবে ভাঙারির দোকানে বিক্রির সত্যতা পায়। গেল সপ্তাহে রাতের বেলা পরিচালাতি ওই অভিযানে বন্দর থানার ৩৮নং ওয়ার্ড এলাকার আনন্দবাজার টিজি কলোনিতে একটি ভাঙারির দোকান থেকে জব্দ করা হয় ৪৩ বস্তা চিকিৎসা বর্জ্য। পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের ধারণা, ওসব বর্জ্য রিসাইক্লিং কারখানায় সরবরাহ করা হয়। পরবর্তীতে আবারও হাত ঘুরে বাজারে আসতে পারে। যা মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ চিকিৎসা বর্জ্য (ব্যবস্থাপনা ও প্রক্রিয়াজাতকরণ) বিধিমালা, ২০০৮ পরিপন্থি। এ ঘটনায় পরিবেশ অধিদপ্তরের মুহম্মদ আশফাকুর রহমান বাদী হয়ে গেল বৃহস্পতিবার বন্দর থানায় ‘চট্টগ্রাম সেবা সংস্থা’ এর স্বত্বাধিকারী মো. জমির উদ্দিনসহ তিনজনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। অন্য দুই আসামি হচ্ছেন ভাঙারি কারখানার মালিক মো. তৈয়্যব ও কারখানাটির কর্মচারী মো. তানভীর। এর মধ্যে তানভীরকে আটক করে পুলিশের কাছে সোপর্দ করে পরিবেশ অধিধপ্তরের কর্মকর্তারা। পরিবেশ অধিদপ্তরের অভিযানে অংশ নেন সংস্থাটির নগর কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মিয়া মাহমুদুল হক, সিনিয়র কেমিস্ট জান্নাতুল ফেরদৌস, সহকারী পরিচালক হাছান আহম্মেদ ও পরিদর্শক মুহম্মদ আশফাকুর রহমানের সমন্বয়ে একটি টিম।

মিয়া মাহমুদুল হক বলেন, অভিযানে কারখানাটি থেকে ব্যবহৃত সংক্রমিত সিরিঞ্জ, সুঁচ, ক্যানোলা, স্যালাইনের বোতল, নল, সংক্রমিত প্লাস্টিক বর্জ্য, কালো ও হলুদ রঙ্গের পলিথিন জব্দ করা হয়। কারখানাটিতে এসব সংক্রমিত, ঝুঁকিপূর্ণ চিকিৎসা বর্জ্য যততত্র, খোলা ও অনিরাপদ অবস্থায় মজুত ও প্রক্রিয়াজাতকরণরত অবস্থায় দেখা যায়। অভিযানকালে ভাঙারি দোকানের মালিক মো. তৈয়বকে ঘটনাস্থলে পাওয়া

যায়নি। তবে চিকিৎসা-বর্জ্য প্রক্রিয়াজাতকৃত অবস্থায় দোকানের কর্মচারী মো. তানভীরকে হাতে নাতে আটক করে থানা পুলিশের নিকট সোপর্দ করা হয়।

এ কর্মকর্তা বলেন, জব্দকৃত আলামত ও স্থানীয় তদন্তে জানতে পারি, আনন্দবাজারস্থ সিটি করপোরেশনের ডাম্পিং সাইট হতে এসব ঝুঁকিপূর্ণ চিকিৎসা-বর্জ্য সংগ্রহ করে ওই ভাঙারি দোকানে মজুত ও প্রক্রিয়াজাতকরণের কাজ চলত।

তিনি বলেন, কঠিন চিকিৎসা বর্জ্য পরিবেশসম্মত পন্থায় বিনষ্টকরণের জন্য আনন্দবাজার ডাম্পিং সাইটের পাশে জাইকার অর্থায়নে একটি অত্যাধুনিক ইনসিনারেটর প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়েছে। সিটি করপোরেশন বর্তমানে প্ল্যান্টটি পরিচালনা করছে। নগরের হাসপাতালগুলো হতে কঠিন চিকিৎসা-বর্জ্য সংগ্রহ ও ইনসিনারেটর প্ল্যান্টে পরিবহনের কাজটি করে ‘চট্টগ্রাম সেবা সংস্থা’। প্রতিষ্ঠানটি হাসপাতালগুলো থেকে হলুদ ও কালো রঙয়ের পলিথিনে করে চিকিৎসাবর্জ্য সংগ্রহ করে থাকে। তৈয়বের ভাঙারি দোকান থেকে হলুদ ও কালো রঙের এসব পলিথিন জব্দ করা হয়। এতে প্রতীয়মান হয়, ‘চট্টগ্রাম সেবা সংস্থা’ কর্তৃক সংগৃহীত চিকিৎসা বর্জ্য প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে অবৈধ পন্থায় ওই ভাঙারির দোকানদারে বিক্রি করা হয়। অর্থাৎ হাসপাতালগুলো থেকে সংগৃহীত কঠিন চিকিৎসা-বর্জ্য ইনসিনারেট প্ল্যান্টে না দিয়ে অবৈধ পন্থায় ভাঙারির দোকানে বিক্রি করা হয়েছে। স্থানীয় তদন্তেও এর প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া যায়।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০২২ সালের ৩১ মার্চ একই এলাকার অন্য একটি ভাঙারির দোকান থেকে ৩ টন চিকিৎসা বর্জ্য জব্দ করা হয়। ওই সময় চট্টগ্রাম সেবা সংস্থার মালিক এবং ওই ভাঙারি দোকানের মালিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল। এর আগে ২০২১ সালের ৩১ আগস্ট পরিবেশ অধিদপ্তর চিকিৎসা বর্জ্য বিধিমালা লঙ্ঘনের প্রমাণ পেয়ে ওই প্রতিষ্ঠানকে আড়াই লাখ টাকা জরিমানা করে। গত বছরের ১৩ ডিসেম্বর ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআইবি) এর এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, হাসপাতালের দুই ধরনের চিকিৎসা বর্জ্য অবৈধভাবে বাইরে বিক্রি করা হয়। এগুলো হচ্ছে পুনঃব্যবহারযোগ্য বর্জ্য ও পুনঃচক্রায়নযোগ্য বর্জ্য। হাসপাতালের কর্মীদের একাংশ (সিন্ডিকেটের অংশ) পুনঃব্যবহারযোগ্য বর্জ্য যেমন, ব্যবহৃত কাচের বোতল, সিরিঞ্জ, স্যালাইন ব্যাগ ও রাবার-প্লাস্টিক নল নষ্ট না করে পুনঃব্যবহারযোগ্য বর্জ্য সংগ্রহকারীর (সিন্ডিকেটের অংশ) কাছে বিক্রি করে দেয়। পরবর্তীতে এই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পুনঃব্যবহারযোগ্য বর্জ্য সঠিকপ্র্রক্রিয়ায় জীবাণুমুক্ত না করেই পরিষ্কার ও প্যাকেটজাত করে ওষুধের দোকান, বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকের কাছে বিক্রি করে দেয়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত