আ.লীগের প্রভাব খাটিয়ে মহিলা কলেজে রিয়াজের লঙ্কাকাণ্ড

* সাড়ে ৯ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ * ছাত্রী-শিক্ষকদের যৌন হয়রানি

প্রকাশ : ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

আওয়ামী লীগের প্রভাব খাটিয়ে শেরে বাংলা বালিকা মহাবিদ্যালয়ে লঙ্কাকাণ্ড বাধিয়েছেন সংগঠনটির ঢাকা মহানগর দক্ষিণের দপ্তর সম্পাদক রিয়াজ উদ্দিন রিয়াজ। রিয়াজে ক্ষুণ্ণ হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মান।

জানা গেছে, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক পদ পেয়েই বিশেষ এক মন্ত্রীর প্রভাব খাটিয়ে একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সভাপতির পদ বাগিয়ে নেন রিয়াজ। সর্বশেষ ২০২১ সালের ২৯ অক্টোবর হন শেরে বাংলা বালিকা মহাবিদ্যালয়ের গভর্নিং বডির সভাপতি। এর আগে তিনি যাত্রাবাড়ী আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতিও ছিলেন। পাশাপাশি সেন্ট্রাল উয়মেন্স কলেজের গভর্নিং বডির সদস্যের পদ বাগিয়ে নেন। অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে যাত্রাবাড়ী আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সভাপতির পদ ছাড়তে বাধ্য হন রিয়াজ। গেল শুক্রবার বন্ধের দিন শেরে বাংলা বালিকা মহাবিদ্যালয়ের গভর্নিং বডির সভাপতি পদ থেকে পদত্যাগ করেন তিনি। রিয়াজের পদত্যাগের পরপরই আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠে রাজনৈতিক অঙ্গনসহ সামাজিক মাধ্যমে। পদত্যাগের নেপথ্যে কী- এই প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে।

জানা গেছে, যৌন হয়রানি, টাকা আত্মসাৎ, দুর্নীতির অভিযোগের কারণে পদত্যাগ করতে অনেকটা বাধ্যই হয়েছেন রিয়াজ। শেরে বাংলা বালিকা মহাবিদ্যালয়ের সভাপতির দায়িত্ব নেওয়ার পর এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও অনিয়ম ও অনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করেন তিনি। বাধ্য হয়ে শেরে বাংলা বালিকা মহাবিদ্যালয়ের মহিলা শিক্ষকরা তার বিরুদ্ধে স্থানীয় সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী ফিরোজ রশীদের কাছে স্মারকলিপি দেন। স্মারকলিপিতে রিয়াজের অর্থ ও নারী কেলেঙ্কারিরসহ নানা অনিয়মের তথ্য উঠে আসে। সাড়ে ৯ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

স্মারকলিপিতে বলা হয়, রিয়াজ উদ্দিন রিয়াজ গভর্নিং বডির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রতিষ্ঠানে কোনো অডিট হয় না। মন্ত্রণালয় ম্যানেজ করে অডিট হতে দেন না তিনি; যার কারণে প্রতিষ্ঠানের বিপুল অর্থ তছরুপ হয়েছে। এছাড়া একাডেমিক কার্যক্রম নিয়মতান্ত্রিকভাবে পালন হয়নি। বেতন বৈষম্যসহ শিক্ষকদের মানসিক চাপেও রাখতেন তিনি। শিক্ষামন্ত্রীর লোক বলে ভয়-ভীতি প্রদর্শন করতেন। শিক্ষকদের জন্য সিটিং রুম সংকট থাকলেও রিয়াজ ক্ষমতার দাপটে নিজের জন্য অত্যাধুনিক একটি কক্ষ তৈরি করেন নেন। গভীর রাত পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করতেন এবং নারী শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সেখানে বিশেষ প্রয়োজনে সাক্ষাৎ করতে বলতেন। এছাড়া ভর্তি ও নিয়োগ বাণিজ্য করতেন। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের শরীরিকভাবে হেনস্থারও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

জানা গেছে, মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক রিয়াজ একসময় গুলিস্তানে ঝুঁড়িতে করে জুতা বিক্রি করতেন। এরপর উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে অধীনে এসএসসি পাস করে বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। মূলত হোমিওপ্যাথি মেডিকেল কলেজে স্বঘোষিত জিএস পরিচয় দিয়ে ত্রাসের রাজত্ব গড়ে তোলেন তিনি। হোমিওপ্যাথি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়ে টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ এবং ভর্তি বাণিজ্য করতে শুরু করেন। হয়ে উঠেন বিপুল অর্থের মালিক। ছাত্রলীগের সিন্ডিকেট ম্যানেজ করে বাগিয়ে নেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি পদ।

অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, একসময় মাদ্রাসায় পড়ুয়া শিবিরের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত থাকা রিয়াজ ঢাকায় এসে বনে যান আওয়ামী লীগার। বিশেষ করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মণি তার জন্য বড় আশীর্বাদ। শিক্ষামন্ত্রীর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে বলে তার রাজনৈতিক মহলে প্রচারণা আজ তাকে নিয়ে এসেছে এ পর্যায়ে।

রিয়াজ শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মণির ঘনিষ্ঠ এবং আস্থাভাজন- এটি রাজনৈতিক অঙ্গনে ওপেন সিক্রেট বিষয়। এছাড়া ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের শীর্ষ একজন নেতাকে অর্থ দিয়ে ম্যানেজ করে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক পদ বাগিয়ে নেওয়ার ঘটনাও রাজনৈতিক অঙ্গনে চাউর রয়েছে।

শেরে বাংলা বালিকা মহাবিদ্যালয়ের শিক্ষকদের স্মারকলিপির বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা-৬ আসনের এমপি কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, আমার কাছে লিখিত অভিযোগ আসার পর আমি ভুক্তভোগীদের জেলা প্রশাসকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলি। জেলা প্রশাসক এডিসি শিক্ষাকে গভর্নিং বডির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব দেন। তিনি রিয়াজকে পদত্যাগ করিয়ে বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্ব নিয়েছেন। আমিও সাড়ে ৯ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ পেয়েছি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু আহমেদ মন্নাফী বলেন, যার যার অপরাধের জবাব সে সে দেবে। অভিযোগ এলে তার বিরুদ্ধে আমরা সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেব। সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির বলেন, শেরে বাংলা বালিকা মহাবিদ্যালয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্মৃতি বিজড়িত প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানে কোনো ধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ড হলে তা নিন্দনীয়। সামনে জাতীয় নির্বাচন, এই সময়ে এ ধরনের কোনো কাজ কাম্য নয়। লিখিত অভিযোগ এলে তার বিরুদ্ধে অবশ্যই সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক রিয়াজ উদ্দিন রিয়াজ বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে কোনো অভিযোগ থাকলে তা শিক্ষা বোর্ড এবং মন্ত্রণালয় বলতে পারবে। আমি পদত্যাগ করিনি। সময় দিতে পারি না বলে অব্যাহতি চেয়েছি।