খাবারের তালিকা সংকুচিত হচ্ছে

দামের ঊর্ধ্বগতিতে বিপাকে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষ

প্রকাশ : ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

বাজারে কোনো খাবারের দাম আর সস্তা নেই। ডিম ও ডালের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আলু, পেঁয়াজ এবং কাঁচা সবজির দামে ঊর্ধ্বগতির ছোঁয়া লেগেছে। খাদ্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতিতে বিপাকে পড়েছেন নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষ। এতে প্রতিদিনের খাবারের তালিকা সঙ্কুচিত হচ্ছে।

জানা গেছে, গত বছরের তুলনায় চলতি বছরে সারা দেশে প্রায় ১১ লাখ টন আলু বেশি উৎপাদন হয়েছে। বছর ব্যবধানেই প্রায় ২৫ টাকা কেজি দরের আলু বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকার কাছাকাছি। আলুর সঙ্গে পেঁয়াজ, ডিম ও বিভিন্ন ধরনের খাদ্যসামগ্রীর দাম দ্বিগুণ হয়েছে। এভাবে হুট করে পণ্যের দাম দ্বিগুণের পেছনে মজুতদারদের দায়ী করছেন খুচরা ব্যবসায়ীরা। তবে মজুতদাররা দাবি করছেন, আগের তিন মৌসুমে আলু মজুত করে লোকসান গুনতে হয়েছে। এবার কিছুটা ক্ষতি পুষিয়ে নিতে চান। এছাড়াও মুরগি লালন-পালনে ব্যয় বাড়ায় বেড়েছে ডিমের দাম।

রাজধানীর মিরপুর, কারওয়ান বাজার, যাত্রাবাড়ী ও শনির আখড়াসহ কয়েকটি খুচরা বাজার ঘুরে দেখা গেছে, অ্যাস্টেরিক, কার্ডিনাল ও ডায়মন্ড জাতের প্রতি কেজি আলু বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকার কাছাকাছি। মাসখানেক আগেও যা ছিল ২০ টাকা। দেশি জাতের পাকড়ি (লাল গুটি) আলু ওই সময় ৩০ টাকায় পাওয়া যেত। এক মাস পরে এর দাম বেড়ে হয়েছে ৭০ টাকা। দোকানগুলোতে ফার্মের মুরগির ডিম ১৩ টাকা পিস বিক্রি হতে দেখা যায়। এছাড়াও প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ ৮৫-৯০ টাকা এবং ভারতের আমদানি করা পেঁয়াজ প্রতি কেজি ৬৫ থেকে ৭৯ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, আলু শীতকালীন সবজি। উত্তরাঞ্চলে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ এবং দক্ষিণাঞ্চলে নভেম্বর মাসের মধ্য থেকে শেষ সপ্তাহে আলু লাগানো হয়। ফেব্রুয়ারি ও মার্চের দিকে জমি থেকে আলু উত্তোলন করেন কৃষক। এরপর অধিকাংশ প্রান্তিক কৃষকের কাছ থেকে আলু কিনে হিমাগারে মজুত করেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা। বেশি দামের আশায় তারা সীমিতভাবে আলু সরবরাহ করছেন, যা চাহিদার তুলনায় কম। ফলে আলুর দাম বেড়েই চলেছে।

হিমাগারে আলু মজুদে দেখা গেছে, এবার ভাড়াসহ প্রতি বস্তা (৬০ কেজি) অ্যাস্টেরিক, ডায়মন্ড ও কার্ডিনাল আলু হিমাগারে সংরক্ষণে খরচ পড়ছে এক হাজার থেকে ১২০০ টাকা। সেই আলু বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৭৫০ টাকায়। একই পরিমাণ দেশি পাকড়ি জাতের আলু সংরক্ষণে হিমাগারে খরচ পড়ছে দেড় হাজার টাকা, যা বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৩০০ টাকায়। সংরক্ষণের মাত্র চার মাসের ব্যবধানে প্রতি বস্তা আলুতে ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা মুনাফা করছেন ব্যবসায়ীরা।

ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)-এর তথ্য মতে, ২০২১-২২ অর্থবছরে আলু উৎপাদন হয়েছে প্রায় ১ কোটি ১ লাখ ৪৪ হাজার টন। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরে আলু উৎপাদন হয়েছে প্রায় ১ কোটি ১২ লাখ টন। গত বছরের তুলনায় আলু উৎপাদন প্রায় সাড়ে ১০ লাখ টন বেশি হয়েছে।

এ ব্যাপারে সরকারি সংস্থা কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস) বলছে, বিশ্বে প্রায় ৪০টি দেশে আলু মানুষের অন্যতম প্রধান খাদ্য। বর্তমানে বাংলাদেশে আলু হেক্টরপ্রতি গড় ফলন ১১ টন।

আলুর উৎপাদনের সঙ্গে আলুর ব্যবহার বেড়েছে। আলু সবজি হিসাবে খাওয়ার পাশাপাশি ভাতের সঙ্গে ভর্তা হিসাবে অথবা মাছ-মাংসের তরকারির সঙ্গে সবজি হিসাবে আলুর ব্যবহার করে আসছে। এছাড়া আলু ভাজি ও আলুর দম সবার কাছেই উপাদেয় সবজি। বর্তমানে বিরিয়ানিতে আলুর ব্যবহার বাড়ছে। অভিজাত হোটেলগুলোয় সেদ্ধ আলু এবং আলুর চিপস নিয়মিত পরিবেশন করা হচ্ছে। শিশু-কিশোরদের কাছে আলুর চিপস খুবই উপাদেয় খাবার। সেদ্ধ আলু কিংবা আলুর চিপস জনসাধারণের মাঝে এখন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান বলছেন, কৃষকরা মাঠ পর্যায়ে এ মৌসুমে ১০ থেকে ১২ টাকার মধ্যে আলু বিক্রি করেছেন। যা অন্যান্য খরচসহ ব্যবসায়ীরা হিমাগারে ১৮ থেকে ২০ টাকা দামের মধ্যে সংরক্ষণ করেছিলেন। প্রতি কেজি আলুতে হিমাগারে সংরক্ষণের খরচ ৫ টাকা। এরপর সেটি রাজধানীতে পাইকারি ও খুচরা বাজার হয়ে ভোক্তা পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছাতে সর্বোচ্চ ৩৫ থেকে ৩৬ টাকা হতে পারে। কিন্তু বর্তমানে খুচরা বাজারে আলুর দাম ৪৮ থেকে ৫০ টাকা, যা অযৌক্তিক।

কারওয়ান বাজারে সাব্বির হোসেন নামের এক ক্রেতা এক কেজি পেঁয়াজ ৮০ টাকায় ও আলু ৪৫ টাকায় কেনেন। তিনি বলেন, সরকার শুধু দাম নির্ধারণ করলেই হবে না। বাজার মনিটরিংও করতে হবে। কারওয়ান বাজারে পাইকারি আলু বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৪৫ টাকা, দেশি পেঁয়াজ ৭৪ টাকা এবং ভারতীয় পেঁয়াজ ৫৮ টাকায়।

কারওয়ান বাজারের পাইকারি বিক্রেতা ফারুখ হোসেন বলেন, আলু কোল্ডস্টোরেজ থেকে দাম নির্ধারণ করে দিতে হবে। তাহলে আমরা কম দামে কিনতে পারব। কারওয়ান বাজারে যখন ট্রাকে আলু আসে তখন আমরা ৪১-৪২ টাকা কেজি কিনেছি। আমাদের দোকান ভাড়া দিতে হয়, এরপর অনেক সময় পচা ও ছোট আলু থাকে সেটা কম দামে বিক্রি করতে হয়। তাই ৪৫ টাকার নিচে পাইকারি বিক্রি করলে আমাদের লাভ থাকে না।

ব্যবসায়ীরা উল্লেখ করেছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেশি। তবে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতির মতে, স্থানীয় বাজারে অনেক পণ্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় বেশি। এর অর্থ হলো, ব্যবসায়ীরা আন্তর্জাতিক বাজারে বেশি দামের অজুহাতে মানুষের কাছ থেকে বেশি টাকা আদায় করছেন। সরকারের উচিত অবিলম্বে এই বিষয়ে নজর দেওয়া এবং যেসব ব্যবসায়ী সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি অর্থ আদায় করে ভোক্তাদের শোষণের চেষ্টা করছেন তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করা।

ক্যাবের এমন দাবিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় কৃষিপণ্যের উৎপাদন, চাহিদা ও মূল্য পরিস্থিতি পর্যালোচনা শীর্ষক বৈঠকে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি তিন পণ্যের বেঁধে দেওয়া দাম ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, এখন থেকে খুচরা পর্যায়ে প্রতিটি ডিমের দাম হবে সর্বোচ্চ ১২ টাকা, প্রতি কেজি আলু ৩৬ এবং দেশি পেঁয়াজ ৬৫ টাকা। তবে বাজারে বেঁধে দেওয়া নিয়ম মানছেন না ব্যবসায়ীরা। নির্ধারিত দরের চেয়ে অনেক বেশিতে এসব পণ্য বিক্রি হচ্ছে।

খুচরা ব্যবসায়ীদের অনেকেই বলেছেন, তারা সরকারের নির্ধারিত এ দর সম্পর্কে কিছু জানেন না। আবার কেউ কেউ বলেছেন, সরকার যে দরে ডিম, আলু, পেঁয়াজের দর নির্ধারণ করেছে তাতে বিক্রি করা সম্ভব নয়। কারণ, পাইকারিতেই এসব পণ্যের দাম বেশি।

বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব খন্দকার মো. মোহসিন বলেন, প্রত্যেক বছরে জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর এই তিন মাসে সবজির দাম বেশি থাকায় ডিমের দাম কিছুটা বাড়ে। তবে ডিম হাতবদল হওয়ায় খুচরা পর্যায়ে দাম কিছুটা বেশি থাকছে।

বাংলাদেশ কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বলেন, যেসব ব্যবসায়ী আলু সংরক্ষণ করেছেন, তারা দাম বাড়াচ্ছেন। খুচরা বাজারে আলুর দাম ৩৬ টাকা কেজির বেশি হওয়া উচিত নয়। বাজার তদারকিতে সরকারের গাফিলতি আছে। তদারকির নামে সরকারি কর্মকর্তারা ফোন করে আলুর বাজারের তথ্য নিচ্ছেন, সরাসরি বাজারে গিয়ে খোঁজ নেন না। হিমাগারগুলোতে সরাসরি তদারকি না করলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে না।

এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে বহু পণ্যের দাম কমেছে। কিন্তু দেশের বাজের পণ্যের দাম কমেনি। পণ্যের দাম বেঁধে দিলেও অনেক সময়ই সরকারের পক্ষে সারা দেশে তদারকি করা সম্ভব হয় না। সেজন্য দর বেঁধে দিয়েও অনেক সময়ই কোনো লাভ হয় না। এখানে একটা সিন্ডিকেট কাজ করছে। এই সিন্ডিকেট সরকারকে ভাঙতে হবে।