ঢাকা ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৯ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সর্বত্র অপ্রতিরোধ্য নির্বাচনি হাওয়া

সর্বত্র অপ্রতিরোধ্য নির্বাচনি হাওয়া

আগামী বছরের শুরুতে হতে যাচ্ছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন। সংবিধানের আলোকে নির্বাচনি প্রস্তুতি নিতে শুরু করছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। নির্বাচন সামনে রেখে জনগণকে সচেতন করছে সাংবিধানিক এ প্রতিষ্ঠানটি। সুষ্ঠু অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলার কাজটিও করে যাচ্ছে ইসি। প্রশাসন যাতে নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থায় দায়িত্ব পালন করতে পারে, সে লক্ষ্যে কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি। এরই মধ্যে বিতর্কিত বক্তব্য দেয়ায় জামালপুরের জেলা প্রশাসককে সরিয়ে দেয়ার জন্য মন্ত্রী পরিষদ সচিবকে চিঠি দিয়েছে। চিঠির পর নড়েচড়ে বসছে প্রশাসন। জামালপুরের পূর্বের জেলা প্রশাসককে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেখানে নতুন ডিসির নিয়োগ হয়েছে।

এছাড়া গত সোমবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে জেলা প্রশাসনকে সতর্ক করে দিয়েছে। নির্বাচনকালীন সরকারের সময় দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে যাতে কোনো পক্ষপাতমূলক আচরণের বহিঃপ্রকাশ না ঘটে, সেটি স্মরণ রাখতে বলা হয়েছে। নির্বাচন সামনে রেখে ভোট গ্রহণের উপকরণ সংগ্রহ, নির্বাচনি এলাকাও চিহ্নিত করা হয়েছে। আগামী নভেম্বর মাসের প্রথম দিকে চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হবে। আর এ সময়ের মধ্যেই গঠন করা হবে নির্বাচকালীন সরকার। এর পরই ঘোষিত হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল। এসব আনুষ্ঠানিতকার পরপরই শুরু হয়ে যাবে দেশে ভোটের হাওয়া। রাজপথের বিরোধীদল বিএনপি এবং তার মিত্র শরীক দলগুলো অসাংবিধানিক উপায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে এখনো অনড়। দাবি আদায়ে বিভাগীয় সমাবেশ, পদযাত্রা, অবস্থান কর্মসূচি এবং তারুণ্যের সমাবেশ ঘটিয়ে জনগণের সমর্থন আদায় করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে দাবি আদায়ে নিজেদের শক্তি-সামর্থ্যরে যথেষ্ট ঘাটতি থাকায় বিএনপিসহ আওয়ামী লীগবিরোধী কয়েকটি রাজনৈতিক দল বিদেশি শক্তির দিকে ‘চাতক’ পাখির মতো দৃষ্টি রাখছে।

তবে আন্তর্জাতিক অঙ্গন, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনে হস্তক্ষেপ করবে- এমন পরিস্থিতি এখন আর নেই। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এখন শেখ হাসিনাকে কেবল বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনে করছেন না। বিশ্ব নেতৃত্ব প্রদানের ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার বিচক্ষণতাকে বাইডেন অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছেন। ভারতের নয়াদিল্লিতে জি টুয়েন্টি শীর্ষ সম্মেলেনে বিশেষ আমন্ত্রণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যোগদান করার সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আগ্রহী হয়ে শেখ হাসিনার সঙ্গে যে সেলফি তুলেছেন সেটি প্রমাণ করে যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশে নির্বাচনি রাজনীতে কোন প্রকার মতামত চাপিয়ে দেবে না। এছাড়া ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষিক সুনাক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠককালে তার প্রতি যে সম্মান ও শ্রদ্ধা দেখিয়েছেন তা বিরল। এছাড়া ঋষিক সুনাক শেখ হাসিনাকে মডেল হিসেবে মনে করেন। ঋষিক সুনাকের পরিবারও শেখ হাসিনাকে অনুসরণ করেন বলে তিনি নিজেই অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোর সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফর বিশ্ব রাজনীতিতে বাংলাদেশকে অনেক বেশি মর্যাদার আসনে নিয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি চীন ও জাপান বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী। রাশিয়া বাংলাদেশের পরীক্ষিত বন্ধু রাষ্ট্র। এ মাসেই রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাগেই ল্যাভরভ বাংলাদেশে সফর করলেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে- জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের এসব স্থায়ী সদস্য দেশ যখন বাংলাদেশকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে তখন তারা বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ‘নাক গলাবে’ এমনটি ভাবা কল্পনাতীত। এদিকে আওয়ামী লীগবিরোধী মহল মনে করছে, এসব দেশ হয়তো তাদের কাঙ্ক্ষিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনার সরকারকে বাধ্য করবে। তবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের শিষ্টাচার হিসেবে বিদেশি কোনো রাষ্ট্র অন্য কোনো রাষ্ট্রকে সংবিধান ও আইন বহির্ভূত কোনো কাজ করতে ওই রাষ্ট্রের নির্বাচিত সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে বিতর্কিত হতে চাইবে না। এটা পররাষ্ট্র নীতির বিরোধী। সংবিধান ও আইনের প্রতিপালন করতে নৈতিকভাবে সবাই বাধ্য। কোনো দেশ অন্য কোনো দেশের সংবিধান কিংবা প্রচলিত আইনবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ডে হস্তক্ষেপ করলে সেটি বিশ্বাঙ্গনের কোথাও গ্রহণযোগ্য হবে না। বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল পুরস্কারজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে চলমান আইনি প্রক্রিয়া বন্ধ করতে ১০০ নেবোল বিজয়ীসহ দেড় শতাধিক বিশ্ব ব্যক্তিত্ব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চিঠি দেয়ার পর তারা এখন নিশ্চুপ। তারা তাদের দেয়া বিবৃতির প্রতিফলনের ব্যাপারে কোনো খোঁজ খবর নিচ্ছেন না। এসব ব্যক্তিত্বকে ড. ইউনূসের পক্ষে বিবৃতি দেয়ার পেছনে দেশবিরোধী কোনো অপশক্তির মদদ রয়েছে বলে দেশের মানুষ মনে করে। এসব ব্যক্তিত্ব এটা বুঝতে সক্ষম হয়েছে যে, ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন তারই প্রতিষ্ঠানের সাবেক একাধিক কর্মচারী, সরকার নয়। শ্রমিকের নায্য পাওনা বুঝিয়ে না দিয়ে ড. ইউনূস আইনের যে ব্যত্যয় ঘটিয়েছেন, সেটা বিশ্ববাসীকে বোঝানোর পরই হয়তো বিশ্ব নেতারা ড. ইউনূস থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। এখন আর কেউ ড. ইউনূসের পক্ষে কোনো বিবৃতি দিচ্ছেন না।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি আদায়ে অতীতে মতো জ্বালাওপোড়াও কিংবা অবরোধ কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এখন বাংলাদেশে নেই। বাংলাদেশের মানুষ নির্বাচনমুখী এবং তারা আনন্দ ও উৎসমুখর পরিবেশে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়ার সুযোগ হাতছাড়া করতে চায় না। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ এরই মধ্যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে দলীয় প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছে। নির্বাচন প্রক্রিয়ায় কীভাবে দলের নেতাকর্মীরা অংশ নেবেন, সেটি নিয়ে চলছে দলীয় প্রশিক্ষণ। প্রার্থী হওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করে দেশের সর্বত্র পোস্টারিং হচ্ছে। সম্ভাব্য প্রার্থীরা নানা সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে গণসংযোগ করছেন। সেই সঙ্গে কেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছেন ও বিভিন্ন জনের কাছ থেকে পরামর্শ নিচ্ছেন। এদিকে বিএনপি ভেতরে ভেতরে প্রার্থী বছাই শুরু করেছে। সরকারের পক্ষ থেকে ডাক পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে দলটি। রাজনৈতিক পরিস্থতির পরিবর্তন হলে এবং নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণে রাজি হলেই ‘লন্ডনের নির্দেশনা’ মোতাবেক প্রার্থী বাছাই শুরু করবে সংসদের বাইরে থাকা দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই রাজনৈতিক দলটি। বিএনপি আজ ১৪ বছর ক্ষমতার বাইরে। ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদের নির্বাচন বর্জন করলেও ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়। ওই নির্বাচনে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেও মির্জা ফখরুল ‘লন্ডনের নির্দেশনায়’ শপথ নেননি। তবে পরবর্তীতে সংরক্ষিত একটি আসন নিয়ে ছয়জন সংসদ সদস্য সংসদীয় রাজনীতির করার সুযোগ বেশি দিন পাননি। পদত্যাগ করার পর বিএনপি রাজপথের রাজনৈতিক দল হিসেবে নাম লেখায়। বিএনপি এখন একদফার ‘শান্তিপূর্ণ’ আন্দোলন করলেও সহিংসতাকে পরিহার করতে পারেনি। বাস্তব অবস্থায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ জনগণের জীবন ও সম্পদ রক্ষায় রাস্তায় নেমেছে বিএনপির ‘নৈরাজ্য’ মোকাবিলায়। বিএনপির জন্য এখন নতুন করে সমূহবিপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে তৃণমূল বিএনপি। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত এই দলটির প্রথম কাউন্সিল গতকাল হয়ে গেল। বিএনপি সরকারের সাবেক মন্ত্রী প্রয়াত নাজমুল হুদার প্রতিষ্ঠিত দল তৃণমূল বিএনপির প্রথম সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন দলটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অন্তরা সেলিমা হুদা। সম্মেলন উদ্বোধন করলেন ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মেজর (অব.) হাফিজুর রহমান। সম্মেলনে স্বাগত বক্তব্য দেন তৃণমূল বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান কেএ জাহাঙ্গীর, সঞ্চালনা করেন যুগ্ম মহাসচিব আক্কাস আলী খান। দলটিতে গতকাল আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দেন বিএনপি থেকে পদত্যাগ করা সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মুবিন চৌধুরী ও বহিষ্কৃত বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য তৈমূর আলম খন্দকার। ২৭ সদস্যবিশিষ্ট কমিটিতে শমসের মবিন চৌধুরীকে চেয়ারম্যান ও তৈমূর আলম খন্দকারকে মহাসচিব করা হয়।

দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের এই মেরুকরণে যারা বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানে আদর্শের রাজনীতি করেন তারা তৃণমূল বিএনপিতে নিজেদের নাম লিখিয়ে আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেয়ার চিন্তাভাবনা করছেন। তৃণমূল বিএনপি আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে আগামী জাতীয় নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে এবং এই বার্তা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে। সেক্ষেত্রে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন দল বিএনপি ব্যাকেট বন্দি হয়ে পড়বে। বিএনপির দুটি অংশে বিভক্ত হয়ে নিজস্ব বলয়ে রাজনীতি করবে- এটাই স্বাভাবিক। বিএনপির নেতাকর্মীরা এখন তাদের নেতৃত্ব বেছে নেয়ার সুযোগ গ্রহণ করবেন। বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মানবিক উদারতা দেখিয়ে খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত করে তাকে পারিবারিক পরিবেশে বসবাস করার সুযোগ করে দিয়েছেন। আর বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান রাজনীতি না করার মুচলেখা দিয়ে লন্ডনে ‘আয়েশী’ জীবনযাপন করছেন। সেই সঙ্গে বিদেশের মাটিতে বসে দেশের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র করছেন। বিএনপির নেতা- কমীদেরকে সরকারবিরোধী আন্দোলনে মাঠে নামার জন্য জোরজুলম করছেন। দেশের গণতান্ত্রিক ধারাকে এগিয়ে নিতে তৃণমূল বিএনপির নেতৃত্বকে ইতিহাস একদিন সাধুবাদ জানাবে এমনটাই মনে করছেন রাজনৈতিক মহল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ উন্নয়নের ধারায় এগিয়ে যাচ্ছে। আগামী ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করতে স্বল্প, মাঝারি ও দীর্ঘমিয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। আর এই এগিয়ে চলার পথ সুগম করতে দেশে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে আকক্সক্ষা সেটিও পূরণ হবে আগামী জাতীয় নির্বাচনে। বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃতাধীন বিএনপি যদি নির্বাচন বর্জন করে, তাহলে তৃনমূল বিএনপির ব্যানারে বিএনপির নেতারা নির্বাচনে অংশ নেবেন এমন পরিস্থিতি দেশে বিরাজ করছে। রাজনীতি করতে হলে দল প্রয়োজন। আর দলের হয়ে নির্বাচনে অংশ না নিলে জনগণর কাছে পরিচয় দেয়ার কিছুই থাকে না। সে কারণে আজ তৃণমূল বিএনপির মতো একটি দল বাংলাদেশের রাজনীতে সক্রিয় অংশগ্রহণের মধ্যদিয়ে জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিয়ে দেশ পরিচালনায় ক্ষমতার অংশ হয়ে থাকতে চায়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত