ঢাকা ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৯ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ভূমিকম্প-ঝুঁকিপূর্ণ ভবন

ঢাকায় ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা

ঢাকায় ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা

রাজধানীতে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা হলেও ভাঙার উদ্যোগ নেই কোনো সংস্থার। সংস্থাগুলো একে অপরের ওপরে দোষ চাপিয়েই বছরে পর বছর কালক্ষেপণ করছে। এতে ঝুঁকিতে রয়েছেন বহু মানুষ। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) এক সমীক্ষায় ঝুঁকির বিষয়টি উঠে এসেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, রাজধানীতে বহু ভবন শত বছর আগে নির্মাণ করা হয়েছে। এরই মধ্যে বেশকিছু ভবনের স্থায়িত্বকাল শেষ। এরপরও ভবন ভাঙার দায়িত্বে কোনো সংস্থা এগিয়ে আসছে না। আর রাজউক ইচ্ছে করলেও ভবন ভাঙতে পারবে না। কারণ, ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও ব্যক্তিমালিনায় রয়েছে। ফলে একক কোনো সংস্থার পক্ষে ভবন ভাঙার ক্ষমতা নেই। ভবন ভাঙতে খরচের বিষয়টি সম্পৃক্ত, সেটি নিয়েও সংস্থাগুলোর টানাপড়েন দেখা দিয়েছে।

২০১৮ সালে তৎকালীন পূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন রাজধানীতে ৩২১ ভবন ঝুঁকিপূর্ণ বলে জাতীয় সংসদকে জানিয়েছিলেন। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাজউক জানিয়েছিল, ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ১৫৫। ২০১৬ সালের ১৭ মে ফায়ার সার্ভিসের তৎকালীন মহাপরিচালক আলী আহাম্মেদ খান জানান, নগরীতে ১১০ ভবন খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। সর্বশেষ বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্পের মাধ্যমে ঢাকা শহরে সরকারি-আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজ-হাসপাতাল-পুলিশ স্টেশনের ভবনগুলোর ওপর জরিপ চালায়। এতে ৩ হাজার ২৫২ ভবনের ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাসেসমেন্ট করা হয়। এর মধ্যে ১৮৭ ভবন পাওয়া যায়, যেগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ হলেও রেট্রোফিটিংয়ের মাধ্যমে নিরাপদ করা সম্ভব। আর ৪২টি ভবন এতই ঝুঁকিপূর্ণ যে সেগুলোকে অপসারণ করার কথা বলা হয়।

সম্প্রতি রাজউকের সমীক্ষায় বলা হয়েছে, রাজধানীর পাশর্^বর্তী অঞ্চল টাঙ্গাইলের মধুপুরে মাটির নিচে ফল্টলাইন রয়েছে, সেখানে ৬ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকায় ৮ লাখ ৬৫ হাজার ভবন ধসে পড়বে। দিনের এ ভূমিকম্প হলে ২ লাখের বেশি মানুষ মারা যাবেন এবং বহু মানুষ আহত হবেন। ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সমীক্ষাটি করা হয়। রাজউক এ সমীক্ষা করেছে আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্পের আওতায়।

রাজউকের কয়েকজন কর্মকর্তা নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক শর্তে বলেন, টাঙ্গাইল ও সিলেট অঞ্চলে দুটি বিপজ্জনক চ্যুতিরেখা বা ফল্টলাইন রয়েছে। সেখানে ভূমিকম্প হলে ঢাকা ঝুঁকিতে পড়বে। চলতি বছরে ৬ ফেব্রুয়ারি তুরস্ক-সিরিয়া সীমান্তে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পে প্রায় ৫৫ হাজার মারা যায়। সর্বশেষ ৮ সেপ্টেম্বর মরক্কোয় ৬ দশমিক ৮ মাত্রায় ভূমিকম্পে ৩০০’র অধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। একই মাত্রায় ভূমিকম্প ঢাকার আশপাশে হলে লাখ লাখ মানুষ মারা যাবে এবং বিপুল অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়তে হবে।

জানা গেছে, ঢাকা, সিলেট, ময়মনসিংহ ও রংপুরে ১৮৯৭ সালে ৮ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। ওই ভূমিকম্পে দেড় হাজার মানুষ মারা যান। ২০২১ সালে সিলেটে পরপর সাতবার ও চট্টগ্রামে তিনবার মৃদু ভূমিকম্প অনুভূত হয়। গত বছর এবং এ বছরের শুরুতে সিলেট, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে বেশ কয়েকবার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। এসব ভূমিকম্প ভবিষ্যতে বাংলাদেশে বেশি মাত্রার ভূমিকম্পের ঝুঁকির আশঙ্কা তৈরি করে।

রাজউকের আওতাধীন ৪২টি ভবন ঝুঁকিপূর্ণের তালিকায় রয়েছে। এরমধ্যে একটি ভবন ভাঙা হয়েছে, বাকি ৪১টি ভবন ভাঙার কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না রাজউক বা মালিকপক্ষ। কারণ ভবন ভাঙা নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে।

আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্পের কারিগরি কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোডের ভূমিকম্পসংক্রান্ত ম্যাপ অনুযায়ী ৪২টি ভবন খুব ঝুঁকিপূর্ণ। পুরোনো ভবন মজবুত করার খরচ নতুন করে নির্মাণ ব্যয়ের ৪০ শতাংশের বেশি হলে সেটি ভাঙার সুপারিশ করা হয়।

অতিঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকায় রাজধানীতে ২৩টি, গাজীপুরে তিনটি, সাভারে ছয়টি, নারায়ণগঞ্জে আটটি ও কেরানীগঞ্জে একটি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন রয়েছে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি মোহাম্মদ ফজলে রেজা সুমন বলেন, সম্প্রতি নগর উন্নয়ন কমিটির এক বৈঠকে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা প্রকাশের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু অজানা কারণে তা আর প্রকাশ করা হয়নি। এ অবস্থায় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তার দায় রাজউককে নিতে হবে।

রাজধানীর ঝুঁকিপূর্ণ ২৩ ভবনে বিএসএমএমইউর তিনটি ছাড়া অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ ভবন হচ্ছে বাড্ডা আলাতুন্নেছা উচ্চ বিদ্যালয়ের দুটি (শিক্ষক মিলনায়তন ও একাডেমিক ভবন), ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের তিনটি ভবন (মূল ভবন, বিজ্ঞান ভবন ও হল ভবন), দনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের স্বাধীনতা ভবন, মিরপুরের সরকারি বাঙলা কলেজের বিজ্ঞান ভবন (ভবন নম্বর-৩), ডেমরার হায়দার আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাডেমিক ভবন (এই প্রতিষ্ঠানের ঝুঁকিপূর্ণ আরেকটি তিনতলা ভবন ভাঙা হয়েছে), মিরপুরের হাজী আলী হোসেন উচ্চবিদ্যালয়ের চারতলা বিদ্যালয় ভবন, পুরান ঢাকার কবি নজরুল সরকারি কলেজের ১ ও ২ নম্বর ভবন, খিলগাঁও সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের একটি ভবন (সিঙ্গেল ভবন), সায়েদাবাদের কোরাটিটোলা সিএমএস মেমোরিয়াল উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজের একটি ভবন (স্কুল ও কলেজ ভবন), যাত্রাবাড়ীর শহীদ জিয়া বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজের একটি ভবন (সিঙ্গেল ভবন), তেজগাঁও মডেল উচ্চবিদ্যালয়ের একটি ভবন (সিঙ্গেল ভবন), জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি ভবন (সামাজিক ভবন-১ ও কলাভবন) এবং বাড্ডার ছোলমাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল দপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী হেলাল উদ্দিন বলেন, রাজউক থেকে কোন কোন ভবনকে নির্দিষ্ট করে ঝুঁকিপূর্ণ বলা হয়েছে, তা তারা শনাক্ত করতে পারেননি। তাই তারা ভবন চিহ্নিত করে দিতে রাজউককে চিঠি পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাউবি) বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ডক্টর সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, সিলেট ও রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছোট ছোট ভূমিকম্পের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। আর ছোট ছোট ভূমিকম্প হওয়া একটি বড় ভূমিকম্প সৃষ্টির লক্ষণ। আমাদের জরুরি ভিত্তিতে সিলেটসহ দেশের প্রধান শহরগুলোতে ভূমিকম্পের সময়ে কী করতে হবে, তার মহড়া দেওয়া শুরু করতে হবে। ভূমিকম্প মোকাবিলার প্রস্তুতি ও মহড়াকে নিয়মিত চর্চার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। এতে দেশে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কিছুটা হলেও কমানো সম্ভব হবে। বিশেষ করে সিলেট এবং চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে, সেটাই হবে ঢাকার জন্য বড় বিপর্যয়।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশের সিলেট, চট্টগ্রাম এবং ঢাকায় ১৫৪৮, ১৬৪২, ১৬৬৩, ১৭৬২, ১৭৬৫, ১৮১২, ১৮৬৫, ১৮৬৯ সালে ভূমিকম্প হওয়ার ঐতিহাসিক উল্লেখ পাওয়া যায়। এসবের মাত্রা কত ছিল তা জানা যায়নি। তবে ১৮২২ ও ১৮১৮ সালে সিলেট ও শ্রীমঙ্গলে ৭.৫ ও ৭.৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। এতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছিল দেশ।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত