নগর পরিবহনে বিশৃঙ্খলা

বাড়ছে জনদুর্ভোগ নষ্ট হচ্ছে শ্রমঘণ্টা

* যত বেশি যাত্রী তত বেশি আয় * আড়াআড়ি বাস থামিয়ে অসুস্থ প্রতিযোগিতা

প্রকাশ : ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

রাজধানীজুড়ে সড়কের ওপরে গাড়ি পার্কিং ও গণপরিবহন চলাচলে বিশৃঙ্খলায় মানুষের ভোগান্তি যেমন বাড়ছে, তেমনি শ্রমঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। কোনোভাবেই যানজট নিরসন সম্ভব হয়ে ওঠছে না। স্বাভাবিকের তুলনায় বৃষ্টির সময়ে কয়েকগুণ বেশি যানজটের ভোগান্তিতে পড়তে হয় মানুষকে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকায় অসহনীয় যানজটের বড় কারণ দুর্বল পরিবহন ব্যবস্থাপনা। ঢাকার রাস্তা যে পরিমাণ গাড়ি ধারণে সক্ষম, তার চেয়ে ৩০-৪০ শতাংশ বেশি গাড়ি চলে। এছাড়া ঢাকার সব যানজটের প্রায় ৩০ শতাংশের জন্য দায়ী পার্কিং ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা। ঢাকার অসহনীয় যানজট সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনার জন্য সঠিক ট্রাফিক ও পরিবহন ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা দরকার। এছাড়াও পথচারীবান্ধব অবকাঠামো গড়ে তোলা, উন্নত গণপরিবহন প্রবর্তন, গণপরিবহনের জন্য আলাদা লেনের ব্যবস্থা, ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ন্ত্রণ, পার্কিং ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের পাশাপাশি সড়ক ব্যবহারীদেরও মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন ঘটানোর ওপর জোর দেওয়া দরকার।

রাজধানীর গুলিস্তান, মগবাজার, পল্টন, বাংলামোটর, ফার্মগেট, মিরপুরসহ অধিকাংশ এলাকার সড়কে যানজটে মানুষের কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সকাল থেকেই সড়কে যানজট বাড়ায় কার্যত স্থবির হয়ে পড়ে। বেলা বাড়তে থাকার সঙ্গে-সঙ্গে যানজট কিছুটা কমলেও বিকেলে অফিস ফেরত মানুষের চাপে ফের স্থবিরতা দেখা যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সড়কের মাঝপথেই যাত্রী ওঠানামা করানো হচ্ছে। সড়কেও দৌড়ে গিয়ে সড়কের মাঝখানে যাত্রীদের চলন্ত গাড়িতে উঠতে দেখা গেছে। পুরুষ যাত্রীদের পাশাপাশি নারীরাও রয়েছেন বাসে ওঠার এমন প্রতিযোগিতায়।

ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. আদিল মোহাম্মদ খান আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, সড়কে গণপরিবহনে বিশৃঙ্খলা দূর করতে বহু আগে থেকেই নগর বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু কোনো পরামর্শ কাজে আসেনি। যত্রতত্র যাত্রীদের বাসে ওঠানো হচ্ছে। বাস চালকরা নিজেদের মধ্যে পাল্লাপাল্লি করে যানজট বাড়াচ্ছে। এখানে আমাদের সিস্টেমের সমস্যা।

তিনি আরো বলেন, সড়কে হাজার কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে। কিন্তু কাজে আসেনি। কোনো জিনিসই কাজ করবে না, যদি আমরা সিস্টেম পরিবর্তন না করি।

জানা গেছে, ঢাকার বাস পরিচালনা ব্যবস্থা ত্রুটিপূর্ণ। রাজধানীতে প্রায় ছয় হাজার বাস ও মিনিবাস চলাচল করে। এসব বাসের মালিক ২ হাজারের বেশি। এসব বাসের মালিক নির্দিষ্ট টাকার বিনিময়ে পুরো দিনের জন্য চালকদের কাছে বাস ভাড়া দেন। আবার ওয়েবিল ব্যবস্থার মাধ্যমেও বাস ভাড়া দিয়ে থাকেন। দিন শেষে বাসচালক ও হেলপারদেররা বাস-মালিককে টাকা বুঝিয়ে দেন। এই ব্যবস্থায় চালকরা যত্রতত্র, আড়াআড়িভাবে বাস থামিয়ে অন্য চালকদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হন। যত বেশি যাত্রী, তত বেশি আয়। বেপরোয়া চালনায় একদিকে বাসের বাহ্যিক অবয়ব নষ্ট হয়ে রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় বেড়ে যায়, অন্যদিকে যত্রতত্র গাড়ি থামানোয় ভ্রমণ-সময় দীর্ঘায়িত হয়।

গণপরিবহনে বিশৃঙ্খলা দূর করতে এরআগে নির্দিষ্ট দূরত্বে টিকিট কাউন্টার স্থাপন করে যেখান থেকে যাত্রীদের টিকিট সংগ্রহ করে লাইন ধরে বাসে উঠতে হতো। টিকিট ছাড়া যাত্রী পরিবহন ঠেকাতে কোম্পানির লোকেরা যাত্রাপথে যাত্রীদের টিকিট পরীক্ষা করতেন। তখন চালক ও সহকারীদের মনোযোগ থাকত কাউন্টার থেকে যাত্রী নিয়ে গন্তব্যে পৌঁছানোর দিকে। ফলে যত্রতত্র বাস থামানো কমে গিয়ে যানজট পরিস্থিতির বেশ উন্নতি হয়। কিন্তু ফুটপাত দখলমুক্তের নামে এসব কাউন্টার উচ্ছেদ করায় বাসের ভেতরে ভাড়া আদায়ের আগের ব্যবস্থা ফিরে এসেছে। ঢাকায় যাত্রী ওঠানামার স্থান সব সড়কে সুনির্দিষ্ট করা নেই বা থাকলেও তা কার্যকর নেই।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) ২০২১ সালের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অসহনীয় যানজটে রাজধানী ঢাকায় মানুষের ভোগান্তি ও কর্মঘণ্টাই নষ্ট হচ্ছে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জিডিপি এবং মাথাপিছু আয়ও। শুধু ঢাকার যানজটের কারণেই বছরে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২ দশমিক ৯ শতাংশ। যদিও বর্তমানে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে চালু হওয়ায় যানজটের পরিমাণ কিছুটা কমেছে। এতে অবকাঠামোর উন্নয়নের পাশাপাশি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতি বাড়ছে। উত্তরা থেকে নিয়মিত পল্টনে বাসে যাতায়াত করেন শাহানাজ বেগম। তিনি বলছেন, কয়েক বছর আগেও বাসে কিছুটা স্বস্তিতে চলাচল করতে পারলেও এখন সেই বাসই নেই। লক্কড়ঝক্কড় বাস। ঠাসাঠাসি করে বসে অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে চলাচল করি। সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির শিকার হচ্ছে গুলিস্তান, শনিরআখড়া, সাইনবোর্ড ও মাতুয়াইল এলাকার যাত্রীরা। এই রুটে চলাচল করা গণপরিবহনের বিশৃঙ্খলা চরমে। যাত্রীদের জিম্মি করে গণপরিবহন চলাচল করছে। শনিরআখড়া থেকে থেকে গুলশান এক নম্বরে আসেন ব্যাংক কর্মকর্তা তাহমিনা আক্তার। তিনি বলেন, একেক সময় ভাড়া নিয়ে যে আচরণের শিকার হই তা অবিশ্বাস্য। হেলপার যে আচরণ করে যাত্রীদের সঙ্গে এটা সভ্য দেশে হয় কিনা জানি না। কিন্তু কি করব বলেন। মেনে নিয়েই চলতে হবে। ভাড়া আদায়ের বিদ্যমান পদ্ধতিও রাস্তায় বিশৃঙ্খলার জন্য বহুলাংশে দায়ী। কারণ বাস চালক ও হেলপারদের কাছে যাত্রীরা জিম্মি। অনেক সময় নারীদের বাসে তুলতেই চায় না। দরজা বন্ধ করে রাখে। অনেকে ঝুঁকি নিয়েই ওঠেন। ব্যক্তি মালিকানাধীন বাসের পাশাপাশি রাজধানীতে সীমিত সংখ্যক দ্বিতল বাস চলাচল করছে। তবে দ্বিতল বাসের একটি বড় অংশ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অধীনে কর্মচারীদের পরিবহনে ব্যবহৃত হয়। একইসঙ্গে দ্রুত ও সহজে চলাচলের ক্ষেত্রে বহুল প্রচলিত বাহন ফোর-স্ট্রোক ইঞ্জিনচালিত সিএনজি অটোরিকশা। এই যানগুলোর কিলোমিটার ও সময় হিসেবে মিটারে চলার কথা থাকলেও কোনো চালকই সেই নিয়ম মানেন না। ঢাকা শহরের মধ্যবিত্তের বাহন হিসেবে পরিচিত রিকশা। যা অলিগলি থেকে মূল সড়কেও চলছে। মনজিল বাস চালক লিয়াকত সিকদার বলেন, সড়ক পরিবহন আইনে মিনিবাসে ৩১টি আসন থাকার কথা থাকলেও সেটি ৪০টি পর্যন্ত করা হয়। বড় বাসে ৫২টি আসনের পরিবর্তে ৬০টি আসন রয়েছে। এতে যাত্রীরা স্বাচ্ছন্দ্যে বসতে পারেন না। আর এসব আসন হিসাব করে বাস মালিকদের দিন শেষে ভাড়া দিতে হয়। এছাড়াও সড়কে বাস চলাতে গেলে বিভিন্ন ধরনের খরচ রয়েছে। গণপরিবহন শৃঙ্খলায় আনতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস চলতি বছরের মার্চে নগরীর খিলগাঁও এলাকায় ‘খিলগাঁও সামাজিক অনুষ্ঠান কেন্দ্র’-এর নির্মাণ কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন শেষে স্বার্থান্বেষী মহলের সব বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করেই ঢাকার গণপরিবহন ব্যবস্থাপনাকে শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। গণপরিবহন পরিবহন ব্যবস্থার যে নাজুক এবং বিশৃঙ্খলা অবস্থা, এর পেছনে অনেক চক্র এবং স্বার্থান্বেষী মহল রয়েছে। তারা অবশ্যই চাইবে না যে, এটা একটি শৃঙ্খলার মধ্যে আসুক। কিন্তু আমরা দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে চলেছি। তিনি আরো বলেন, যত্রতত্র, যেখানে-সেখানে কাউন্টার এবং সেই কাউন্টার ঘিরে রাস্তার উপর গাড়ি রেখে দেওয়া, যানজট সৃষ্টি করা- এগুলো আর হতে দেওয়া হবে না। বাস রোড রেশনালাইজেশন কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেই কমিটির আওতায় ঢাকা নগর পরিবহন সফলতার সঙ্গে আমরা চালু করেছি।