ঢাকা ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৯ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

জাতিসংঘ অধিবেশনে শেখ হাসিনা

নতুন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ

নতুন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৮তম অধিবেশন এবং অন্যান্য উচ্চ-পর্যায়ের পার্শ্ব ও দ্বিপক্ষীয় অনুষ্ঠানে যোগদান শেষে এখন যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থান করছেন। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৮তম অধিবেশনে যোগ দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৭ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে পৌঁছান।

প্রধানমন্ত্রী ২৯ সেপ্টেম্বর যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডনের উদ্দেশ্যে ওয়াশিংটন ডিসি ত্যাগ করবেন এবং ৩ অক্টোবর পর্যন্ত লন্ডনে অবস্থান করবেন। আগামী ৪ অক্টোবর তার ঢাকায় পৌঁছার কথা রয়েছে। এর আগে প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ভাষণ দেন। তিনি বাংলাদেশের জাতীয় সমস্যর পাশাপশি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংকট নিয়েও বক্তব্য তুলে ধরেন। তিনি এসব সমস্যার সমাধানে উপায় খুঁজে বের করার আহ্বান জানিয়ে নিজস্ব মতামত ও প্রস্তাবনা তুলে ধরেন। বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের সরকার প্রধান হয়ে শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিভিন্ন সংকটের কথা তুলে ধরেন। তিনি বিশেষ করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্বাঙ্গনে অচলাবস্থার সৃষ্টির বিষয়টি তুলে ধরেন। এছাড়া তিনি জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিরূপ প্রভাব নিয়েও আলোচনা করেন। এক্ষেত্রে তিনি বাংলাদেশের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে সংকট সমাধানে নিজস্ব প্রস্তাবনাও তুলে ধরেন। দারিদ্র বিমোচন, নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়টি উপস্থাপন করতে গিয়ে জাতিসংঘে একজন নারী মহাসচিব নিয়োগ করারও দাবি জানান তিনি।

প্রসঙ্গক্রমে প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের শীর্ষ পদসমূহে নারীর দায়িত্ব পালনের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারীকে বাদ দিয়ে কোনো দেশ এগিয়ে যেতে পারে না। শুধু নারীর ক্ষমতায়নই নয়, নারীশিক্ষা অবৈতনিক করার ক্ষেত্রে তার সরকারের গৃহীত উদ্যোগ সম্পর্কে বিশ্বনেতাদের মনোযোগ আকর্ষণ করেন। বিশ্বনেতাদের সামনে তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনের সমস্যা তুলে ধরার পাশাপাশি বাংলদেশে রোহিঙ্গা সংকট প্রসঙ্গটিও উত্থাপন করেন। ফলে দীর্ঘদিনের এই মানবিক সংকটটি সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী জানার সুযোগ পেয়েছে। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যোগদানের ফলে বাংলাদেশ একটা নতুন পরিপ্রেক্ষিত পেয়েছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে শেখ হাসিনা জাতিসংঘের যে নির্দেশনামূলক বক্তব্য দিয়েছেন এবং যে আহ্বান তিনি জানিয়েছেন, সেটি বাস্তবায়নের মধ্যদিয়ে অনেক জটিল সমস্যার সমাধান সম্ভব বলে দেশের রাজনৈতিক মহল মনে করছেন। শেখ হাসিনার এসব বক্তব্য তাকে একজন বিশ্বনেতার মর্যাদা দিয়েছে।

চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বিষয়টি মাথায় রেখে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুদ্ধ ও সংঘাতের পথ পরিহার করে মানবজাতির কল্যাণ ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য সবাইকে একযোগে কাজ করার জন্য বিশ্বনেতাদের প্রতি আহ্বান জানান।

তিনি বলেন, ‘আজ আপনাদের সকলের কাছে, বিশ্বনেতাদের কাছে আমার আবেদন, যুদ্ধ ও সংঘাতের পথ পরিহার করুন এবং আমাদের জনগণ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য স্থায়ী শান্তি, মানবজাতির কল্যাণ এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য সম্মিলিতভাবে কাজ করুন।’

গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে রাশিয়া-ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরু করার পর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এই যুদ্ধের ভয়াবহতা তুলে ধরে তা বন্ধে আন্তর্জাতিক উদ্যোগ গ্রহণ করার আহ্বান জানিয়ে আসছেন প্রধানমন্ত্রী। জাতিসংঘে গিয়েও তিনি এই যুদ্ধের ফলে বিশ্বের সরবরাহ ব্যবস্থায় যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে সেটা তুলে ধরেন।

প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে বলেন, করোনা মহামারি ও জলবায়ু সংকটের প্রভাব এবং বিশ্বব্যাপী খাদ্য, অর্থায়ন এবং জ্বালানি নিরাপত্তার উপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব উন্নয়নশীল দেশগুলোতে উন্নয়ন-লক্ষ্যসমূহ অর্জনে ব্যাপক প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছে। তিনি বলেন, বহুপাক্ষিক কূটনীতিকে জোরদারকরণ, জাতিসংঘের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করার জন্য প্রচেষ্টা ও সাহসী বক্তব্য এবং বৈশ্বিক সংকট উত্তরণে সুদূরপ্রসারী ও বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য বাংলাদেশ সবসময় জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসেকে সমর্থন জানিয়ে আসছে। প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘে তার ভাষণে রোহিঙ্গা সংকট, জলবায়ু পরিবর্তন, খাদ্য সংকট, মানবাধিকার, নারীর ক্ষমতায়ন, স্বাস্থ্যসেবা, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি), সন্ত্রাসবাদ এবং সরকারের অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং অন্যান্য বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক সমস্যার কথা তুলে ধরেন। গত বছরের মতো এই নিয়ে মোট ১৯তম বার শেখ হাসিনা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর প্রদত্ত ভাষণের পদাঙ্ক অনুসরণ করে জাতিসংঘের অধিবেশনে বাংলায় ভাষণ দেন। প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগণের প্রতি বিশ্বনেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। কেন না, এরই মধ্যে তাদের বাস্তুচ্যুতির ৬ বছর পেরিয়ে গেছে। তিনি বলেন, ‘সম্পূর্ণ মানবিক কারণে আমরা অস্থায়ীভাবে তাদের আশ্রয় দিয়েছি। কিন্তু, পরিস্থিতি এখন আমাদের জন্য সত্যিই অসহনীয় হয়ে উঠেছে।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বৈশ্বিক কার্বন নির্গমনের ০.৪৭%-এরও কম অবদান রাখলেও বাংলাদেশ জলবায়ুজনিত ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব আমাদের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য মারাত্মক হুমকি। এর সমাধানের লক্ষ্যে জরুরি, সাহসী এবং উচ্চাভিলাষী সম্মিলিত পদক্ষেপ প্রয়োজন।’ তিনি বলেন, ‘আমরা প্রধান কার্বন নির্গমনকারী দেশগুলোকে উচ্চাভিলাষী এনডিসি গ্রহণ ও বাস্তবায়নের আহ্বান জানাই। উন্নত দেশগুলোকে অবশ্যই ১০০ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে হবে।’ সরকারের ‘বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড’ প্রতিষ্ঠার উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের নিজস্ব সম্পদ থেকে এই তহবিলে এ পর্যন্ত ৪৮০ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করেছি। জলবায়ু অভিযোজন এবং প্রশমনের লক্ষ্যে সমুদ্র উপকূলে বাঁধ, সাইক্লোন শেল্টার, গ্রিন বেল্ট এবং বৃক্ষরোপণ করা হচ্ছে।’ বাংলাদেশ সরকার কক্সবাজারে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাস্তুচ্যুত মানুষের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে বড় আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেখানে ৪ হাজার ৪০৯টি উদ্বাস্তু পরিবারকে পুনর্বাসনের জন্য সব ধরনের সুযোগ-সুবিধাসহ ১৩৯টি বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। পাশাপাশি ভূমিহীন ও গৃহহীন মানুষের জন্য সরকারের যুগান্তকারী উদ্যোগ ‘আশ্রয়ণ’ প্রকল্পের আওতায় এ পর্যন্ত প্রায় ৮ লাখ ৪০ হাজার পরিবারের ৫০ লাখ মানুষকে বিনামূল্যে ঘর দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, তার সরকার ‘বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান-২১০০’ বাস্তবায়ন করছে; যার লক্ষ্য সমন্বিত ব-দ্বীপ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে একটি নিরাপদ, জলবায়ু সহনশীল এবং সমৃদ্ধ ডেল্টা অর্জন। প্রধানমন্ত্রী তার সরকারের ‘মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনা’ গ্রহণ করেছে বলেও উল্লেখ করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন যে ‘ব্ল্যাক সি গ্রেইন ইনিশিয়েটিভ’ অকার্যকর হয় পড়েছে এবং এ ব্যবস্থার দ্রুত পুনরুদ্ধারের জন্য আমি সংশ্লিষ্ট সবাইকে আহ্বান জানাচ্ছি। আমরা নিম্ন আয়ের ১ কোটি মানুষকে সাশ্রয়ী দামে চাল ও অন্যান্য সামগ্রী সরবরাহ করছি। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ এবং দেশের সব অনাবাদী জমিকে চাষের আওতায় আনার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বানের উল্লেখ করেন তিনি। তিনি বলেন, ২০২২ সালে গ্লোবাল ক্রাইসিস রেসপন্স গ্রুপ গঠন এবং এর মাধ্যমে বৈশ্বিক খাদ্য, শক্তি এবং অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখে বিভিন্নমুখী সমাধান প্রদানের জন্য আমি জাতিসংঘ মহাসচিবকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানাই। প্রধানমন্ত্রী বলেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এসডিজি অর্জনের ক্ষেত্রে অর্থায়ন গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয় যে, বিদ্যমান আন্তর্জাতিক আর্থিক অবকাঠামো লক্ষ্যগুলোর সঙ্গে যেমন সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, তেমনি এটি সংকটের সময় উন্নয়নশীল দেশগুলোর আর্থিক চাহিদা মেটাতেও সক্ষম নয়। শেখ হাসিনা বলেন, একটি দায়িত্বশীল রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ মানবাধিকার, আইনের শাসন ও গণতন্ত্র রক্ষা ও প্রচারে পূর্ণ অঙ্গীকারবদ্ধ। তিনি বলেন, ‘এই বছর আমরা সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্রের ৭৫তম বার্ষিকী পালন করছি।’ শেখ হাসিনা বলেন, জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের নির্বাচিত সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ সারা বিশ্বের আপামর জনগণের মানবাধিকার সংরক্ষণে অন্য সদস্যদের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এসডিজি অর্জনে আমরা নারীর প্রতি বৈষম্যের অবসানকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেছি। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নারীর ক্ষমতায়ন এবং লিঙ্গসমতা নিশ্চিতকরণ ও প্রত্যাশা পূরণে বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা নারীশিক্ষাসহ সার্বিক শিক্ষার ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছি। ২০১০ সাল থেকে মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষার্থীর মধ্যে বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ করা হচ্ছে। প্রাথমিক হতে উচ্চশিক্ষা পর্যায় পর্যন্ত প্রায় ২ কোটি ত্রিশ লাখ শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তি, বৃত্তি এবং এককালীন অনুদান দেওয়া হচ্ছে। এদের অর্ধেকেরও বেশি নারী। আমাদের জাতীয় বাজেটের মোট ৩০ শতাংশ নারীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার সরকার সরকারের শীর্ষ থেকে সর্বনিম্ন- সকল স্তরে নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করেছে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে প্রতিটি খাতে ৫০ শতাংশ নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভিশন-২০৪১ এর আওতায় ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বিনির্মাণে তার সরকার বিপুল বিনিয়োগ করেছে এবং এর মাধ্যমে আমরা আমাদের দেশকে এমন একটি উচ্চ আয়ের, দারিদ্র্যমুক্ত, উন্নত দেশে পরিণত করতে চাই, যা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার এবং নিত্যনতুন উদ্ভাবনের পথ উন্মুক্ত করবে। সে উদ্দেশ্য সামনে রেখে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার এবং উদ্ভাবনের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র্য বিমোচন, লিঙ্গসমতা নিশ্চিতকরণ এবং পরিবেশগত ভারসাম্য বজায় রেখে টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে বাংলাদেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নীতির আধুনিকীকরণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের বাস্তব রূপ দিতে আমরা মানুষের কল্যাণে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও আধুনিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় ব্যাপক বিনিয়োগ করেছি। তার দেখানো পথে বাস্তবমুখী নীতিগ্রহণ, সুদূরপ্রসারী চিন্তা ও বিনিয়োগের মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশকে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ হতে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে পেরেছি। আমরা দারিদ্র্যের হার ২০০৬ সালের ৪১.৫ থেকে ২০২২ সালে ১৮.৭ শতাংশে এবং চরম দারিদ্র্যের হার ২৫.১ শতাংশ থেকে ৫.৬ শতাংশে নামিয়ে আনতে পেরেছি। বাংলাদেশে কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আমরা প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবা তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছে দিতে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছি। বাংলাদেশের এই সাফল্য এই সাধারণ পরিষদ দ্বারা স্বীকৃত এবং প্রশংসিত হয়েছে। অনুরূপ আর্থ-সামাজিক অবস্থার অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশসমূহ আমাদের এই মডেল অনুকরণ করতে পারে।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সমুদ্রসীমার শান্তিপূর্ণ সমাধানের পর সুনীল অর্থনীতি বাংলাদেশের উন্নয়নের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। আমরা বিশ্বাস করি, সামুদ্রিক সম্পদের টেকসই ব্যবহারকে কাজে লাগানোর জন্য সমুদ্রের আইন সম্পর্কিত জাতিসংঘ কনভেনশনের বিধানগুলোর কার্যকর বাস্তবায়ন আবশ্যক।’ জাতিসংঘের সাগর সম্পর্কিত আইন অনুযায়ী দেশসমূহের জাতীয় অধিকারভুক্ত এলাকার বাইরে সামুদ্রিক জৈব বৈচিত্র্যের সংরক্ষণ এবং টেকসই ব্যবহারের জন্য ‘বিবিএনজে’ চুক্তি স্বাক্ষর করার কথা উল্লেখ করেন তিনি বলেন, বাংলাদেশ সম্প্রতি তার ‘ইন্দো-প্যাসিফিক আউটলুক’ প্রকাশ করেছে, যেখানে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে অন্তর্ভুক্তিমূলক, টেকসই এবং সহযোগিতার মাধ্যমে সমুদ্রপথ এবং সামুদ্রিক সম্পদের ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। শেখ হাসিনা বলেন, ‘সর্বজনীন ও সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণের প্রতি বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি পূর্ণাঙ্গ ও অবিচল। আমরা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ সব আন্তর্জাতিক নিরস্ত্রীকরণ এবং পারমাণবিক অস্ত্রসহ অন্যান্য অস্ত্রের প্রসারণ বন্ধবিষয়ক চুক্তি স্বাক্ষর করেছি। আমরা অনতিবিলম্বে আন্তর্জাতিক নিরস্ত্রীকরণ এবং অস্ত্রের প্রসারণ বন্ধবিষয়ক চুক্তিগুলোর পূর্ণ বাস্তবায়ন চাই।’ তিনি বলেন, ‘জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে আমাদের অবদান বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তার প্রতি আমাদের অঙ্গীকারেরই বহিঃপ্রকাশ। অদ্যাবধি ১ লাখ ৮৮ হাজার বাংলাদেশি নারী ও পুরুষ ৪০টি দেশে ৫৫টি শান্তিরক্ষা মিশনে দায়িত্ব পালন করেছেন। বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা তাদের পেশাগত দক্ষতা এবং কাজের জন্য সমাদৃত।’ শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাংলাদেশ ২০২৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে অন্তর্ভুক্ত হবে। আমি বিশ্বাস করি যে, বর্তমান বৈশ্বিক সংকটসমূহ আমাদের উন্নয়নের অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারবে না। তবুও উন্নয়ন সহযোগী এবং উন্নত দেশসমূহকে আমাদের এ যাত্রায় তাদের সহযোগিতা অব্যাহত রাখার অনুরোধ জানাচ্ছি, যা স্বল্পোন্নত দেশ হতে উত্তরণের চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবিলায় আমাদের জন্য সহায়ক হবে। স্বল্পোন্নত দেশসমূহের জন্য প্রযোজ্য বিশেষ সুবিধাসমূহ আমাদের প্রয়োজনীয় ব্যাপ্তিকাল মোতাবেক প্রদান করার জন্য আমি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।’ তিনি বলেন, ‘এ বছরের মার্চ মাসে কাতারের দোহায় অনুষ্ঠিত এলডিসি-৫ সম্মেলনে স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের জন্য অপেক্ষমান দেশগুলোকে সহযোগিতা অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে। আমি জাতিসংঘ এবং উন্নয়ন সহযোগীদের দোহা কর্মসূচির সম্পূর্ণ ও কার্যকর বাস্তবায়নের আহ্বান জানাচ্ছি।’ তিনি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে সংক্ষিপ্ত আকারে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সমস্যার কথা তুলে ধরলেও পার্শ্ব বৈঠকগুলোতে বিস্তারিত উপস্থাপন করার সুযোগ পেয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগদানের পাশাপাশি বিভিন্ন সরকার ও রাষ্ট্র প্রধানের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন এবং এ সব বৈঠকে বাংলাদেশের চিন্তা-চেতনার কথা তুলে ধরেন। বিশ্বনেতারাও বাংলাদেশ সম্পর্কে অবহিত হন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধি দল ২২ সেপ্টেম্বর ৭৮তম জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের (ইউএনজিএ) যোগ দিতে ও সাধারণ বিতর্ক পর্বে ভাষণ দিতে নিউইয়র্ক পৌঁছান। এই সফরকালে বিভিন্ন আঙ্গিকে প্রধানমন্ত্রী অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও স্বাস্থ্য খাতে সাফল্যসহ বাংলাদেশের অবিশ্বাস্য উন্নয়ন তুলে ধরেন। এর পাশাপাশি বৈশ্বিক শান্তি, নিরাপত্তা, নিরাপদ অভিভাসন, রোহিঙ্গা সংকট ও জলবায়ু ন্যায্যতাও তার ভাষণে স্থান পায়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আমন্ত্রণে এক অনুষ্ঠানে যোগ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানেও প্রেসিডেন্ট বাইডেন শেখ হাসিনার সঙ্গে সেলফি তোলেন। এর আগে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে জি টুয়েন্টি শীর্ষ সম্মেলনে জো বাইডেন শেখ হাসিনার সঙ্গে সেলফি তোলেন। এই দুই সেলফিতে পাল্টে গেছে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের হিসাব-নিকাশ। মার্কিন প্রেসিডেন্টের সংবধনা অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা অনেক বিশ্বনেতার সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন।

প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের সক্রিয় অংশগ্রহণ, বহুপক্ষীয় ফোরামে বাংলাদেশের অবস্থানকে শক্তিশালী এবং বাংলাদেশের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রকে আরো প্রসারিত করে। প্রধানমন্ত্রী ‘এসডিজি সামিট ২০২৩’, ‘খাদ্য চিন্তা- এসডিজিগুলো ত্বরান্বিত করতে খাদ্য সরবরাহ চেইন উদ্ভাবন সহযোগিতা’ শীর্ষক সম্মেলন, ‘টুওয়ার্ডস এ ফেয়ার ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্সিয়াল আর্কিটেকচার’ শীর্ষক একটি উচ্চ পর্যায়ের গোলটেবিল বৈঠক এবং উন্নয়নের জন্য অর্থায়নের (এফএফডি) ওপর উচ্চপর্যায়ের বিতর্কে যোগ দেন। এসব অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে নিজস্ব আঙ্গিকে কিছু প্রস্তাবনাও উপস্থাপন করেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর জাতিসংঘের প্রধানের আমন্ত্রণে ‘ক্লাইমেট এ্যাম্বিশন সামিট’ শীর্ষক একটি উচ্চ-পর্যায়ের আলোচনা এবং ‘হাই-লেভেল ব্রেকফাস্ট সামিট অন ক্লাইমেট মবিলিটি’সহ কয়েকটি সম্মেলনে যোগ দেন। প্রধানমন্ত্রী জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকি দূর করতে বিশ্বনেতাদের কাছে তার পরামর্শ এবং জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তার সরকারের পদক্ষেপ তুলে ধরেন। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবর্তনকে বাংলাদেশের জন্য ১ নম্বর অগ্রাধিকার বিষয়টি তুলে ধরতে ‘হাই-লেভেল সাইড ইভেন্ট অন রোহিঙ্গা ক্রাইসিস’ শীর্ষক সাইডলাইন ইভেন্টের আয়োজন করা হয়। ‘কমিউনিটি ক্লিনিকের শেখ হাসিনা উদ্যোগ : মানসিক স্বাস্থ্য ও প্রতিবন্ধীসহ সর্বজনীন স্বাস্থ্য কভারেজ অর্জনে উদ্ভাবনী পদ্ধতি’, ‘মহামারি প্রতিরোধ, প্রস্তুতি ও প্রতিক্রিয়া’, সর্বজনীন স্বাস্থ্য কভারেজ সম্পর্কিত উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী যোগ দেন। এসব বৈঠকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী কোভিড-১৯ মহামারির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এবং বাংলাদেশে সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে তার সরকারের ব্যাপক সাফল্য তুলে ধরেন। নারীর ক্ষমতায়ন এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে বাংলাদেশ বিশ্বে রোল মডেল হিসেবে সমাদৃত হয়েছে। এই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন। এছাড়া সফরকালে জাতিসংঘের মহাসচিব, জাতিসংঘের শরণার্থী-বিষয়ক হাইকমিশনার, জাতিসংঘ মহাসচিবের গণহত্যা-বিষয়ক উপদেষ্টা, নবনির্বাচিত ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন (আইওএম) মহাপরিচালক, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক এবং পরমাণু শক্তি সংস্থার মহাপরিচালকের সঙ্গেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

‘জলবায়ু ন্যায্যতা প্রদান : ত্বরান্বিত উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং অভিযোজন ও সবার জন্য প্রাথমিক সতর্কবার্তা বাস্তবায়ন’ শীর্ষক ‘জলবায়ু উচ্চাকাঙ্ক্ষা’ শীর্ষ সম্মেলনের উচ্চ স্তরের বিষয়ভিত্তিক অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আসন্ন সংকট এড়াতে বিশ্বের প্রধান অর্থনীতির দেশগুলোর জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে সততার সঙ্গে কাজ করতে হবে। তিনি বলেন, ‘আমরা আশা করি বিশ্বের প্রধান অর্থনীতির দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তন এবং আসন্ন সংকট এড়াতে তাদের ন্যায্য অংশীদারিত্বের বিষয়ে সৎ থাকবে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্য বাংলাদেশ একটি সমন্বিত বহু-বিপত্তি প্রাথমিক সতর্কীকরণ পদ্ধতির সর্বশেষ জাতীয় পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে পাঁচটি প্রস্তাব তুলে ধরে মহামারি প্রতিরোধের অংশ হিসেবে একটি বৈশ্বিক সহযোগিতা কাঠামো গড়ে তোলার আহ্বান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘কোভিড-১৯ মহামারি আমাদের সবার জন্য একটি টার্নিং পয়েন্ট। আমরা স্বীকার করেছি যে সবাই নিরাপদ না হওয়া পর্যন্ত আমরা কেউই নিরাপদ নই।’ অন্য প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, লিঙ্গ সমতা একটি বিকল্প নয় বরং একটি ন্যায্য ও ন্যায়সম্মত বিশ্ব অর্জনের জন্য অপরিহার্য। এ সময় তিনি বলেন, তার সরকার মেয়েদের শিক্ষা ও নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে। মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি ও বিনামূল্যে বই দেওয়ার পাশাপাশি দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত মেয়েদের শিক্ষা অবৈতনিক করা হয়েছে। প্রাথমিক স্তরের ৬০ শতাংশ স্কুল শিক্ষক মহিলা এবং দেশের তৈরি পোশাক শিল্পে ৪০ লাখেরও বেশি নারী কর্মরত রয়েছেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের নারীরা সর্বোচ্চ আদালতের বিচারক, রাষ্ট্রদূত, বেসামরিক প্রশাসনের উচ্চপদে আসীন, সশস্ত্র বাহিনী, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে, সরকারের শীর্ষ থেকে সর্বনিম্ন স্তর পর্যন্ত সব স্তরে নারীদের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। নিউইয়র্কে অবস্থানকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ব্রাউন ইউনিভার্সিটি বিশেষ সম্মাননায় ভূষিত করে। জনগণের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে কমিউনিটি ক্লিনিক মডেল তৈরির জন্য জাতিসংঘ স্বীকৃতির পরিপ্রেক্ষিতে তাকে এই বিশেষ সম্মাননায় ভূষিত করা হয়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে দেয়া প্রশংসাপত্রে বলা হয়েছে, “জাতিসংঘ কর্তৃক ‘শেখ হাসিনা উদ্যোগ’র সাম্প্রতিক স্বীকৃতির জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন।” এতে আরো বলা হয়, ‘কমিউনিটি-ভিত্তিক প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার একটি সফল মডেল : প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, নারীর ক্ষমতায়ন, এবং কমিউনিটি সম্পৃক্ততা উন্নয়নের মাধ্যমে সর্বজনীন স্বাস্থ্য পরিধির জন্য একটি অংশগ্রহণমূলক এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক পদ্ধতি।’ পৃথক অনুষ্ঠানে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে উঠতে আর্থিক ব্যবস্থার পুনর্গঠন চান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থা পুনর্গঠনের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে এ লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী পাঁচ দফা প্রস্তাব পেশ করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের দারিদ্র্যের হার ৪১.৯ শতাংশ থেকে ১৮.৭ শতাংশে এবং চরম দারিদ্র্যের মাত্রা ২৫.৫ শতাংশ থেকে ৫.৬ শতাংশে নামিয়ে এনেছি।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার সরকার মেয়েদের শিক্ষা ও নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে। তিনি উল্লেখ করেন, মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি ও বিনামূল্যে বই দেওয়ার পাশাপাশি দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত মেয়েদের শিক্ষা অবৈতনিক করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারা নিশ্চিত করেছেন যে প্রাথমিক স্তরের ৬০ শতাংশ স্কুল শিক্ষক নারী এবং দেশের তৈরি পোশাক শিল্পে ৪০ লাখেরও বেশি নারী কর্মরত রয়েছেন। জিডিপিতে নারীর অবদান ৩৪ শতাংশে পৌঁছেছে- উল্লেখ করে অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন নারীকে তাদের পরিবার এবং সমাজ উভয় ক্ষেত্রেই সিদ্ধান্ত গ্রহণে আরো বেশি ভূমিকা রাখতে সক্ষম করেছে বলে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, তার সরকার কোভিড-১৯ মহামারি, ইউক্রেন যুদ্ধ এবং জলবায়ু সংকট থেকে উদ্ভূত সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ‘সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ’ বিষয়ে এসডিজি ৩-সহ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাসমূহ (এসডিজি) বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তিনি বলেছেন, ‘আমরা কোভিড-১৯ মহামারি, ইউক্রেন যুদ্ধ এবং জলবায়ু সংকট থেকে উদ্ভূত চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও এসডিজি-৩’র অন্তর্ভুক্ত এসডিজিগুলো কার্যকরে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ’। বৈঠককালে মা, নবজাতক ও শিশু স্বাস্থ্যের জন্য অংশীদারিত্বের চেয়ার হেলেন ক্লার্ক শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে স্বাস্থ্য খাতে সার্বিক উন্নয়নের প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, ‘সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করে মা ও শিশুমৃত্যুর হার কমানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটি বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা সংকটের একটি টেকসই সমাধান নিশ্চিত করতে নিরাপত্তা পরিষদ ও সাধারণ পরিষদের প্রস্তাব বাস্তবায়নের পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের নিজ মাতৃভূমি মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনে তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা আরো বহুগুন বাড়াতে বৈশ্বিক সম্প্রদায় বিশেষ করে আসিয়ান সদস্য দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানান। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে বাংলাদেশ, কানাডা, গাম্বিয়া, মালয়েশিয়া, তুরস্ক, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘ সদর দপ্তরে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে ‘তারা কি আমাদের ভুলে গেছে?’ শীর্ষক উচ্চ পর্যায়ের এক ইভেন্ট আয়োজন করে। সেখানে প্রধামন্ত্রী তার বক্তব্যে তিনটি প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, গত ছয় বছর ধরে মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের মর্মান্তিক বিতাড়নের ঘটনা দেখে আসা বিশ্বকে রোহিঙ্গা সংখ্যালঘুদের স্থায়ী দুর্ভোগের কথা আবারও স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, গত ৬ বছরে একজন বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাও মিয়ানমারে তাদের বাড়িতে ফিরে যেতে পারেনি। ­­­­প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী ও স্কলারদের উদ্দেশে বলেন, ‘উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। আমরা এখন বিশ্বের ৩৫তম বৃহৎ অর্থনৈতিক শক্তি। ২০৩৭ সালের মধ্যে আমরা ২০তম হব। পাশাপাশি ২০২৬ সাল নাগাদ আমরা একটি উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে পরিণত হব। ২০৪১ সালের মধ্যে আমরা সমৃদ্ধ ও স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনের প্রত্যাশা করছি।’ মার্কিন ভিসা নীতি প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, যে দেশ ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে তারা উভয় পক্ষ থেকে বা নিরপেক্ষভাবে বিষয়টি বিবেচনা করবে। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, ‘কে নিষেধাজ্ঞা দেবে বা দেবে না, তা নিয়ে ভয়ের কিছু নেই। যারা নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছেন তাদের দেশের নির্বাচন নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।’ শেখ হাসিনা এই সফরকালে বলেন, সরকার শুধু মেগা প্রকল্পই তৈরি করেনি, উন্নয়নকে তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই সফরের মধ্যদিয়ে বাংলাদেশকে বিশ্ব নতুন আঙ্গিকে অনুধাবন করার এবং বাংলাদেশের উন্নয়ন সম্পর্কে বিশ্বনেতাদের অবহিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা আবারও একজন বিশ্বনেতার মতো তার নির্দেশনামূল বক্তব্য প্রদানের পাশাপাশি নিজস্ব প্রস্তাবনা উপস্থাপন করায় বিশ্বনেতাদের কাছে বাংলাদেশ অধিকতর মর্যদার আসন পেয়েছে- এমনটি মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত