বিসিএস (তথ্য-সাধারণ) সজল মিয়া (ছদ্ম নাম) ১৫তম ব্যাচের কর্মকর্তা। তার সঙ্গে প্রশাসন ক্যাডারে যারা যোগ দিয়েছেন তাদের মধ্যে অনেকেই পদোন্নতি পেয়ে সচিব, অতিরিক্ত সচিব কিংবা যুগ্ম সচিব হয়েছেন। কিন্তু সজল মিয়া এখনও উপ-সচিব পদেই রয়ে গেছেন। তার সঙ্গে তথ্য ক্যাডারে যোগ দেওয়া বাকি সাতজনের ভাগ্যের অবস্থা প্রায় একই রকম। তথ্য ক্যাডারের মতো ২৪টি ক্যাডারের কর্মকর্তারা বরাবরই বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
জানা গেছে, বিসিএসের ১৫তম ব্যাচের মতোই ১৭তম ব্যাচের আরেক কর্মকর্তা পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হওয়ায় দুঃখ প্রকাশ করেন। অথচ তাদের জুনিয়র ২২ ব্যাচের কর্মকর্তারা যুগ্ম-সচিব পদে পদোন্নতি পেয়েছেন। সরকারি কর্মকর্তাদের ২৬টি ক্যাডারের মধ্যে ‘প্রশাসন ক্যাডার’ ছাড়া বাকি ২৫টি ক্যাডারের কর্মকর্তাই পদোন্নতির ক্ষেত্রে কম-বেশি বৈষম্যের অভিযোগ মিলছে। ২০১৮ সালে অর্থনৈতিক (ইকোনমিক) ক্যাডার বিলুপ্ত হয়ে প্রশাসন ক্যাডারে একীভূত হয়েছে।
সম্প্রতি প্রশাসনে যুগ্ম সচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব পদে ১১৪ জন এবং উপ-সচিব থেকে যুগ্ম সচিব ২২১ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয় সরকার। অতিরিক্ত সচিব পদে নিয়মিত বিসিএস ব্যাচ হিসেবে ১৭তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দেয়া হয়। যুগ্ম সচিব পদে ২২তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের বিবেচ্য রাখায় হয়। এত সংখ্যক কর্মকর্তা পদোন্নতির পরও বঞ্চিত হওযার অভিযোগ রয়েছে।
উপসচিব, যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব ও সচিব পদে পদোন্নতি বিধিমালা ২০০২ এ বলা হয়েছে, যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে প্রশাসন ক্যাডারের ৭০ শতাংশ এবং অন্যান্য ক্যাডারের ৩০ শতাংশ বিবেচনায় নিতে হবে। মূল্যায়ন নম্বরের অন্তত ৮৫ নম্বর থাকতে হবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের। যুগ্ম সচিব পদে ৩ বছরসহ ২০ বছরের চাকরির অভিজ্ঞতা বা যুগ্ম সচিব পদে কমপক্ষে ২ বছরের চাকরিসহ ২২ বছরের অভিজ্ঞতা থাকলে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে পদোন্নতির জন্য বিবেচিত হন। অন্যদিকে উপসচিব থেকে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতির জন্য প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের ১৫ বছরের চাকরিসহ ফিডার পদে ৫ বছর এবং অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের ২০ বছরের চাকরিসহ ফিডার পদে ৩ বছরের চাকরি প্রয়োজন।
সম্প্রতি অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। সেখানে অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের বঞ্চিত করা হয়েছে। পদোন্নতি দেওয়া হলেও দু’একজনকে দেওয়া হচ্ছে। এভাবে আমাদের ওপর এক ধরনের বৈষম্য করা হচ্ছে। পদোন্নতি বঞ্চিতদের অভিযোগ, এতো দিন ধরে দক্ষতা, যোগ্যতা, দায়িত্বপরায়ণতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করেও পদোন্নতি বঞ্চিত হওয়ায় তারা পারিবারিক, সামাজিক ও দাপ্তরিকভাবে বিব্রতকর পরিস্থিতির শিকার হচ্ছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শর্তে আলোকিত বাংলাদেশকে এক কর্মকর্তা বলেন, ‘কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সভাপতি দায়িত্বে ছিলেন বিসিএস লাইভস্টক ১৮তম ব্যাচের এক কর্মকর্তা। ২০২৭ সালে অবসরে যাবেন; কিন্তু এখনও উপ-সচিবের দায়িত্ব রয়েছেন। প্রশাসন ক্যাডারে যুগ্ম-সচিব পদে যারা পদোন্নতি পেয়েছেন অনেকেই তার জুনিয়র। এই বৈষম্যটা কি কারণে?’
তিনি আরো বলেন, ‘প্রশাসন ক্যাডার থেকে যদি ১০০ জনের পদোন্নতি দেওয়া হয়, অন্যান্য ক্যাডার থেকে ৩০ জনকে নিতে হবে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব ফয়েজ আহম্মদ থাকাবস্থায় পদোন্নতির বৈষম্য কম ছিল, বর্তমানে বৈষম্য বেড়েছে।’
প্রশাসনে বিসিএস ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদোন্নতি বৈষম্য দূর হচ্ছে না। পদোন্নতিতে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের অগ্রাধিকার দেওয়ায় ক্ষোভ বাড়ছে অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্যে। সম্প্রতি অতিরিক্ত সচিব এবং যুগ্ম-সচিব পদে পদোন্নতিতেও অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের বঞ্চিত করায় এ ক্ষোভ আরো বেড়েছে। বঞ্চিত কর্মকর্তারা বলছেন, নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্য নিয়ে পদোন্নতিতে বৈষম্য সৃষ্টি করা হচ্ছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, কর্মকর্তাদের পদোন্নতি ক্ষেত্রে কয়েক ধাপে যাচাই-বাছাই করা হয়। সেই যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ায় কোনো কর্মকর্তা কবে, কোথায় এবং কোনো আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত তা দেখা হয়। এছাড়াও চাকরিজীবনে কোথায় কোথায় পদায়ন হয়েছে, এসব বিবেচনায় রাখা হয়। পদোন্নতি বঞ্চিতদের অনেকের হয়তো প্রতিবেদন খারাপ, অনেকের বিভাগীয় মোকদ্দমা রয়েছে। যখন সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনা করেন তখন এসব তথ্য গোপন রাখেন অথবা ইচ্ছে করেই বলেন না।
সর্বশেষ গত বছরের নভেম্বরে ১৭৫ জন উপসচিবকে পদোন্নতি দিয়ে যুগ্ম সচিব করা হয়েছিল। প্রশাসনে যুগ্ম সচিবের পদ ৫০২টি। এই পদে এখন কর্মরত ৭২৫ জন। নতুন পদোন্নতির পর যুগ্ম সচিবের সংখ্যা দাঁড়াল ৯৪৬ এ। অন্যদিকে বর্তমানে অতিরিক্ত সচিবের নিয়মিত পদ আছে ২১২টি। এর সঙ্গে সমপর্যায়ের বিভিন্ন দপ্তরে প্রেষণে (নির্ধারিত পদের বাইরে অন্যান্য দপ্তর বা সংস্থায় নিয়োগ) থাকা পদ আছে আরো প্রায় ১২৫টির মতো। সব মিলিয়ে অতিরিক্ত সচিবের পদ দাঁড়ায় ৩৩৭টিতে। পদোন্নতির আগপর্যন্ত কর্মরত অতিরিক্ত সচিব ছিলেন ৩১২ জন। এখন নতুন পদোন্নতি পাওয়া অতিরিক্ত সচিবদের নিয়ে এই সংখ্যাটি দাঁড়িয়েছে ৪২৬। অর্থাৎ পদের চেয়ে এখন এই পদে কর্মকর্তা বেশি হয়েছেন।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রশাসন ক্যাডারে কর্মকর্তা নিয়মিত পদোন্নতি পেলেও অন্যান্য ক্যাডারদের পদোন্নতি আটকে আছে। এতে দীর্ঘজট তৈরি হয়েছে। অনেক কর্মকর্তার রিপোর্ট ভালো। তার পরও রাজনৈতিক বিবেচনায় পদোন্নতি দেয়া হয় না।
সচিবালয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন দপ্তর-সংস্থায় কাজ করছেন পদোন্নতি বঞ্চিরা। তাদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা কাজ করছে। সরকারের এমন সিদ্ধান্ত ইতিবাচক হিসেবে দেখছে না জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, শিক্ষা জীবনে প্রতিটিতে প্রথমশ্রেণি; কিন্তু জেলার কোটার মারপ্যাঁচে আজকে তথ্য ক্যাডারে নিয়োগ পেয়েছি। কিন্তু চাকরিজীবনে এসে হতাশায় পড়েছি। নিজের কাজটা আমি নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছি। তারপরও কিসের ভিত্তিতে পদোন্নতি বঞ্চিত করা হলো? যাদের বঞ্চিত করা হচ্ছে- তাদের মানসিক অবস্থা কী একবারও ভেবে দেখবে না জনপ্রশাসন? জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব ফিরোজ মিয়া আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, ‘কোনো ক্যাডারে বৈষম্য থাকা উচিত নয়। দক্ষতারভিত্তিতে পদোন্নতি দেওয়া উচিত। কিন্তু বর্তমানে রাজনৈতিক বিবেচনায় পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে, যা আগে কখনই দেখা যায়নি।’
তিনি আরো বলেন, ‘রাজনৈতিক বিবেচনায় যোগ্য কর্মকর্তাদের পদোন্নতি আটকে রাখলে সরকার ক্ষতির মুখে পড়বে। একইসঙ্গে প্রশাসন থেকে শুরু করে মাঠপর্যায়ে কর্মকর্তাদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির আশঙ্কা থাকবে। জনস্বাস্থ্য রক্ষা করতে পারবে না। সুতরাং যোগ্য ও দক্ষতার ভিত্তিতে পদোন্নতি দেওয়া উচিত বলে মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ।’
তথ্য (প্রফেশনাল) ক্যাডারের এক কর্মকর্তা বলেন, আমাদের বিভাগীয় পদোন্নতিতেও জটিলতা রয়েছে। এই জটিলতার নেপথ্যে রয়েছেন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারাই। কারণ প্রতিটি ক্যাডারের বিভাগীয় পদোন্নতি কমিটিতে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা রয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন ও সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ্? উদ্দিন চৌধুরী মোবাইলে ফোন করা হলে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।