ঢাকা ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৯ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারের বাস্তবায়ন

পারমাণবিক বিদ্যুৎ যুগে বাংলাদেশ

পারমাণবিক বিদ্যুৎ যুগে বাংলাদেশ

বিদ্যুতের চাহিদা দিনে দিনে বাড়ছে। এই চাহিদা পূরণে আগেভাগে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে সরকার। সেজন্য দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের দিকে এগিয়ে যায়। বর্তমানে সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে রূপ নিয়েছে। জানা গেছে, গতকাল শুক্রবার কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থায় দেশের সবচেয়ে আলোচিত ও বড় প্রকল্প পাবনার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি ইউরেনিয়ামের প্রথম চালান রূপপুরে পৌঁছেছে। সড়কপথে ইউরেনিয়ামের চালান সরবরাহে ঢাকা-পাবনা মহাসড়কে যানবাহন চলাচলে শিথিল করা হয়েছিল।

ইউরেনিয়ামের প্রথম চালান রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প এলাকায় প্রবেশ করে বলে নিশ্চিত করেন পাবনার পুলিশ সুপার আকবর আলী মুনসী। এর আগে গতকাল ভোরে ঢাকা থেকে সড়কপথে রওনা হয় ইউরেনিয়াম বহনকারী গাড়িবহর। পথে গাজীপুরে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিলে কিছুক্ষণ থেমে থাকে। পরে সেখান থেকে ৭টার দিকে গাড়িবহর পাবনার দিকে রওনা দেয়।

এদিকে ইউরেনিয়াম নিয়ে আসার জন্য সড়কপথে ব্যাপক নিরাপত্তা বেষ্টনী জোরদার করা হয়। ঢাকা থেকে রূপপুর পর্যন্ত সড়কে ফাঁকে ফাঁকে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন ছিল। সড়কের গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলোতে পুলিশের তল্লাশি চৌকি বসানো হয়। পাবনা-ঢাকা মহাসড়কে যানবাহন চলাচল সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ রাখা হয়। এর আগে পাবনার পুলিশ সুপার আকবর আলী মুনসী জানান, ঢাকা থেকে সড়কপথে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি ইউরেনিয়াম আসবে। যেহেতু পাবনা-ঢাকা রুটে অনেক সময় যানজটের সৃষ্টি হয়। এজন্য যানজট নিয়ন্ত্রণে ও নিরাপত্তার স্বার্থে গতকাল শুক্রবার ভোর ৫টা থেকে সাময়িক সময়ের জন্য বাস চলাচল বন্ধ রাখতে বলা হয়। তবে আরিচা-কাজিরহাট হয়ে বিকল্প ব্যবস্থায় যান চলাচল করে।

গত বৃহস্পতিবার বিকালে রাশিয়া থেকে ঢাকায় শাহজালাল বিমানবন্দরে আসে ইউরেনিয়ামের প্রথম চালান। গতকাল রূপপুরে ইউরেনিয়াম এসে পৌঁছালেও রূপপুর প্রকল্পের কর্তৃপক্ষের কাছে আগামী ৫ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে এই ইউরেনিয়াম জ্বালানি হস্তান্তর করবেন রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় পরমাণু শক্তি কর্পোরেশনের মহাপরিচালক রোসাটম আলেক্সি লিখাচেভ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে বিদ্যুৎ অপরিহার্য। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের প্রথমেই প্রয়োজন পর্যাপ্ত এবং নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ সরবরাহ। দেশের সব মানুষের কাছে এবং বিভিন্ন অর্থনৈতিক সেক্টরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া বর্তমান সরকারের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পটি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সব বাধ্যবাধকতা বিবেচনায় নিয়ে এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করে এগিয়েছে। এ ক্ষেত্রে মানবসম্পদ উন্নয়ন থেকে শুরু করে রিঅ্যাক্টরের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, পরিবেশের ভারসাম্য সংরক্ষণ এবং আনুষঙ্গিক বিষয়াদি নিয়ে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে, তা দেশের মানুষের স্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। এছাড়াও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র উপলক্ষ্যে আর্থ-সামাজিক অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে পাবনায়। এখানে বিভিন্ন ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে উঠেছে।

এর আগে চলতি বছরের ১৪ জুলাই পাবনার রূপপুরে নির্মাণাধীন পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য পারমাণবিক জ্বালানি আমদানি, পরিবহন ও সংরক্ষণের অনুমোদন পায় বাংলাদেশ ও রাশিয়ার দুটি প্রতিষ্ঠান। এদিকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় পাবনার একটি রিসোর্টে আয়োজিত অনুষ্ঠানে জ্বালানি আমদানি, পরিবহণ ও সংরক্ষণের জন্য আলাদা লাইসেন্স দেওয়া হয়।

আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) নির্দেশনা অনুযায়ী শর্ত পূরণ করায় বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (বিএইআরএ) বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনকে জ্বালানি আমদানি ও সংরক্ষণের লাইসেন্স দিয়েছে। অপরদিকে জ্বালানি পরিবহণের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে রাশিয়ার একটি প্রতিষ্ঠানকে।

বিএইআরএর নিউক্লিয়ার রেগুলেটরি স্ট্রাকচার উন্নয়ন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক সত্যজিৎ ঘোষ বলেন, এই অনুমোদন বাংলাদেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মাইলফলক। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ পারমাণবিক জ্বালানি আমদানির সক্ষমতা পেল।

সত্যজিৎ ঘোষ আরো বলেন, পরমাণবিক জ্বালানি ব্যবহারে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার সুনির্দিষ্ট নীতিমালা আছে। সেই নীতিমালা অনুযায়ী বাংলাদেশে পারমাণবিক জ্বালানি আমদানি, পরিবহণ ও সংরক্ষণের জন্য রূপপুর প্রকল্প বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে বিএইআরএর কাছ থেকে লাইসেন্স নিতে হয়। এক বছর ধরে প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণের পর দুটি প্রতিষ্ঠানকে এই লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। বিএইআরএর চেয়ারম্যান মোজাম্মেল হোসেনের সভাপতিত্বে ১৪ জুলাইয়ের ওই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান। তিনি বলেন, ‘পারমাণবিক জ্বালানি আমদানি, পরিবহণ ও সংরক্ষণের লাইসেন্স প্রদানের মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের সক্ষমতা প্রমাণ করতে পেরেছি। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের শুরু থেকেই বাংলাদেশ আইএইএর গাইডলাইন অনুসরণে কাজ করে যাচ্ছে। তারা আমাদের পরামর্শ দিয়ে এবং আমাদের ভুল সংশোধন করে প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে ভূমিকা রেখেছে।’

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক শৌকত আকবর বলেন, ‘জ্বালানি আমদানি ও পরিবহণের ক্ষেত্রে আইএইএ-এর প্রজ্ঞাপন লাগে। রুশ ফেডারেশনের যে রপ্তানি নীতি, তার আলোকে অনুমতি লাগে। তার জন্য নিয়ন্ত্রণ অবকাঠামো, সাংগঠনিক অবকাঠামো, দক্ষতা ও জনবল তৈরি করতে হয়। সব শর্ত পূরণ করেই আমরা সংরক্ষণ, আমদানি ও পরিবহণের জন্য লাইসেন্স পেয়েছি।’

রূপপুরে নির্মাণাধীন পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পটি দেশের ইতিহাসে এককভাবে সবচেয়ে বড় অবকাঠামো। রাশিয়ার কারিগরি ও আর্থিক সহায়তায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হচ্ছে। প্রকল্পের প্রথম ইউনিট চালু হওয়ার কথা রয়েছে ২০২৪ সালে। আর পরিকল্পনা অনুযায়ী দ্বিতীয় ইউনিট চালু হবে ২০২৫ সালে। দুই ইউনিট চালু হলে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট করে মোট ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে।

উল্লেখ্য, ১৯৯৭ সালের ১৬ অক্টোবর তৎকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করা হয়। সেই হিসেবে ২০০৯ সালে সরকার ভিশন-২০২১ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রদান করে। দেশের সবচেয়ে আলোচিত ও বড় প্রকল্প পাবনার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প। এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে খরচ প্রায় ১ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকার দিয়েছে ২২ হাজার ৫২ কোটি ৯১ লাখ ২৭ হাজার টাকা। রাশিয়া থেকে ঋণ সহায়তা পেয়েছে ৯১ হাজার ৪০ কোটি টাকা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০২৪ সালের প্রথম দিকে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করবে সে দেশের প্রথম পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র রূপপুর। ২০২৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে দ্বিতীয় ইউনিট চালু হতে পারে। দুটি ইউনিটে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে।

এদিকে সিরাজগঞ্জ থেকে আমাদের স্টাফ রিপোর্টার জানান, সিরাজগঞ্জে মহাসড়কপথে বিশেষ নিরাপত্তায় ইউরেনিয়ামের প্রথম চালান পাবনার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে নেয়া হয়েছে। এতে ঢাকা-পাবনা মহাসড়কে ৩ ঘণ্টা সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ ছিল। এ চালান হাটিকুমরুল গোলচত্বর পার হওয়ার পর ফের মহাসড়কে যান চলাচল শুরু হয়। হাটিকুমরুল হাইওয়ে থানার ওসি বদরুল কবির এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি সাংবাদিকদের জানান, গতকাল শুক্রবার সকালে এই চালানটি ঢাকা থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু হয়ে এবং দুপুরের দিকে রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প এলাকায় পৌঁছেছে। এর আগে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়-রাশিয়া থেকে দেশে পৌঁছায় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিটের জন্য ইউরেনিয়ামের প্রথম চালান। ৪-৫ দিনের মধ্যেই ওই প্রকল্পে এ জ্বালানি আনুষ্ঠানিকভাবে কর্তৃপক্ষের নিকট হস্তান্তর করা হবে। পুলিশ সুপার আরিফুর রহমান মণ্ডল বিপিএম (বার), পিপিএম (বার) সাংবাদিকদের বলেন, ঢাকা থেকে মহাসড়ক পথে পাবনার রূপপুরে ইউরেনিয়ামের প্রথম চালান যাওয়ার সময় এই বিশেষ নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে এবং এ চালানটি মহাসড়ক পার হওয়ার পরে মহাসড়কে পুনরায় যানবহন চলাচল শুরু করে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত