আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবসের ভাবনা

এক কালের সম্পদ এখন কেন বোঝা!

প্রকাশ : ০১ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  শামীম সিদ্দিকী

আজ দেশে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস। এই দিবসটি আসলে আমাদের দেশের প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া প্রবীণদের নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। দুই ঈদেও গণমাধ্যমের তৎপরতা দেখা যায় প্রবীণদের নিয়ে। বৃদ্ধদের জীবনের করুণ কাহিনী তুলে ধরে প্রচারিত প্রতিবেদন দেখে বা পড়ে মানুষ আবেগ আপ্লত হয়ে পড়ে। মনে মনে ওই বৃদ্ধদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করে। তাদের সন্তানদের প্রতি ঘৃণা পোষণ করে। মনে মনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন তারা বড় হলে বৃদ্ধা পিতামাতাকে কোনো প্রকার অযত্নে রাখবে না। কিন্তু সময়ে সঙ্গে সঙ্গে কেন যেন সব ওলটপালট হয়ে যায়। নিছক স্বার্থের কারণে এক কালের আদরের সন্তান বৃদ্ধ পিতা-মাতার ওপর রুষ্ঠ হন। তাদের স্বাভাবিক ভরণ-পোষণটুকু তারা বহন করতে চান না। কে বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে দেখাশোনা করবে, কে তাদের চিকিৎসা করাবে, আর কে মৃত্যুর পর তাদের দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করবে সেটি নিয়েও চলে দর কষাকষি। যে পিতা-মাতা তাদের সন্তানদের কল্যাণে জীবনের সব কিছু ত্যাগ করলেন, জীবনের সব সঞ্চয় অকাতরে খরচ করলেন, সেই পিতা-মাতা বৃদ্ধ বয়সে এসে সন্তানের নিষ্ঠুর আচরণের শিকার হয়ে নীরবে নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলেন। বৃদ্ধ বয়সে যখন আয় রুজি করার মতো কোন সুযোগ থাকে না তখনই বেশি প্রয়োজন হয় অর্থের। বৃদ্ধ বয়সে একটু উন্নত মানের খাবার খেতে মন চায়, অথচ সেই সুযোগ আর থাকে না। একজন সন্তানকে লেখাপড়া কিংবা তাদের জীবনযাপনে পিতামাতা ত্যাগ স্বীকার করেন এই ভেবে যে তিনি যখন আর্থিক ও শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে যাবেন তখন যেন তার সন্তানরা তার জীবনযাপনের সব খরচ বহন করে। তবে প্রতিনিয়ত গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয় বৃদ্ধ পিতামাতাকে অবহেলা ও তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করার খবর। এসব মনোবেদনার খবর পড়ে মানুষ আবেগাপ্লত হলেও করার কিছু থাকে না। বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে রাস্তার ধারে কিংবা কোনো স্টেশনে ফেলা রাখা কিংবা কোনো চলন্ত যানবাহনে তুলে দিয়ে নিজেকে ‘দায়মুক্ত’ ভাবেন এমন সন্তানের অভাব আমাদের সমাজে নেই। অভাবের কারণে বৃদ্ধ পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ না করার মন মানসিকতা কেউ কেউ পোষণ করলেও অনেক বিত্তবান সন্তানও পিতা-মাতাকে অবহেলা করেন। তার চিকিৎসা কিংবা খাবারের ব্যবস্থা করতেও দ্বিধাবোধ করেন। যেসব পিতা-মাতা সন্তানের এ সব অত্যাচার ও নিপীড়ন সহ্য করতে পারেন তারা নীরবে নিঃশব্দে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেন। আর যাদের মধ্যে কিছুটা হলেও আত্ম সম্মানবোধ আছে তারা একাকীত্ব জীবন বেছে নেন। তারা চলে যান বৃদ্ধাশ্রমে কিংবা দূরের অন্য কোথাও যেখানে তিনি পরিচয় গোপন রেখে ‘পাগল কিংবা উম্মাদের’ মতো জীবনযাপন করেন।

বৃদ্ধাশ্রম জীবনের শেষ সময়ের আবাসস্থল। বৃদ্ধাবস্থায় পরিবার বা আত্মীয়স্বজনের আশ্রয় ছাড়া সরকারি-বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় লালিত-পালিত হওয়ার স্থানকে বৃদ্ধাশ্রম বলে। যৌবনের উচ্ছলতা হারিয়ে জীবনের পড়ন্ত বেলায় তারা নিজেরাই অচল। জরাজীর্ণ বার্ধক্যে আক্রান্ত হয়ে চরম অসহায়ত্ব বরণ করে দুর্ভাগ্যজনকভাবে বৃদ্ধাশ্রম নামের কারাগারে তারা স্থান করে নেন। একসময় যাদের ছিল বর্ণাঢ্য জীবন, বৃদ্ধ বয়সে এসে নিজ সন্তানদের অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার হয়ে তারা পরিবার ও সন্তান থেকেও যেন ‘সন্তানহারা এতিম।’

বৃদ্ধের সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে তাদের প্রতি অবহেলার মাত্রা বেড়ে চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, যার ফলে সূচিত হয়েছে বৃদ্ধাশ্রম নামের কলঙ্কজনক অধ্যায়। ছোট বেলায় যে বাবা-মা ছিলেন সন্তানের সবচেয়ে বেশি আপন, যাদের ছাড়া সন্তান কিছুই করতে পারত না, যারা নিজেদের আরাম হারাম করে তাদের মানুষ করেছেন, নিজের সব দুঃখ-কষ্ট বুকে চেপে রেখেছেন সন্তানের হাসিমাখা মুখ দেখার জন্য। আর সেই বাবা মা বৃদ্ধ বয়সে অনাহারে ও বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করবে সেটা সভ্য সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়। যারা নিজেদের সবকিছু বিসর্জন দিয়েছেন সন্তানকে মানুষ করার জন্য আজ তারা বড়ই অসহায়। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় পৃথিবীর প্রথম বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল প্রাচীন চীনে। ঘরছাড়া অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্রের এই উদ্যোগ ছিল শান রাজবংশের। খ্রিষ্টপূর্ব ২২০০ শতকে পরিবার থেকে বিতাড়িত বৃদ্ধদের জন্য আলাদা এই আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি করে ইতিহাসে আলাদা জায়গা দখল করে নিয়েছে শান রাজবংশ। পৃথিবীর প্রথম প্রতিষ্ঠিত সেই বৃদ্ধাশ্রমে ছিল বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের আরাম-আয়েশের সব রকম ব্যবস্থা। ছিল খাদ্য ও বিনোদন ব্যবস্থা। কিন্তু এখন বিষয়টি এমন হয়েছে যে, একবার বাবা-মাকে বৃদ্ধনিবাসে পাঠাতে পারলেই যেন সবকিছু থেকে দায়মুক্তি ঘটে। মূলত অসহায় ও গরিব বৃদ্ধদের প্রতি করুণাবোধ থেকেই হয়ত বৃদ্ধাশ্রমের সৃষ্টি। সন্তানরা উচ্চশিক্ষার লক্ষ্যে বিদেশে পড়তে গিয়ে দেশে ফিরে না আসায় অসহায় হয়ে স্বেচ্ছায় বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় নিয়ে থাকেন অনেকে। জীবনের অর্জিত সম্পদ সন্তানদের উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণে ব্যয় করেন। সন্তানরা বিদেশে গিয়ে আর বাবা-মায়ের খবর রাখেন না। অভিমানি পিতা-মাতাও সন্তানদের বিরক্ত করেন না। কেউ স্বামীকে হারিয়ে কেউ বা স্ত্রীকে হারিয়ে বৃদ্ধনিবাসে আশ্রয় নেন। আবার অনেকে নিজ ঘরের মধ্যে বৃদ্ধাশ্রমের পরিবেশে লালিত পালিত হন। অন্যদিকে বৃদ্ধদের জরাগ্রস্ত, অসহায় ও কমহীন হয়ে চিকিৎসা ব্যয় নির্বাহ করার জন্য অন্যের ওপর নির্ভর করতে হয়। বাড়িতে সঙ্গ দেওয়ার মতো কেউ না থাকায় একাকিত্ব ঘোচাতে অনেকে স্থান করে নেন বৃদ্ধাশ্রমে। তাছাড়া নিরাপত্তার অভাবেও অনেকে এই পথ বেছে নেন। অনেকে শেষ বয়সে স্মৃতিশক্তি হারিয়ে অবুঝ বালকের মতো ঘুরে বেড়ায় পথে-প্রান্তরে। নেই তার সঠিক পরিচয়। পরিবারের সন্তানদের বা পুত্রবধূদের সাথে অস্বাভাবিক অমিলের কারণে যেমন অনেকেই স্বেচ্ছায় আশ্রয় নেন বৃদ্ধাশ্রমে। আবার অনেকের ঠাঁই হয়েছে অনিচ্ছায়। যদিও সন্তান চায় সপরিবারে শান্তিতে বসবাস করতে। কিন্তু পুত্রবধূরা চায় সুখী সংসার নামের ক্ষুদ্র পরিবার গঠন করতে। পুত্র হার মেনে যায় তার স্ত্রীর কাছে। অনেক সময় পিতা-মাতাও বৃদ্ধ বয়সের কারণে অস্বাভাবিক আচরণ করে। ফলে চরম বাদানুবাদের পরিসমাপ্তি ঘটে বৃদ্ধাশ্রমে বৃদ্ধের ঠাঁই করে দিয়ে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তার অবস্থান গড়তে হয় বৃদ্ধাশ্রম নামক কারাগারে। হৃদয়ের সকল ভালোবাসা উজাড় করে দিয়ে যে পিতা-মাতা ভালো সন্তান হিসেবে গড়ে তুলতে তিলতিল করে সর্বস্ব বিকিয়ে দিয়েছেন তারাই আজ বৃদ্ধ বয়সে নিষ্ঠুর নিয়তির শিকার। সংসারের বোঝা মনে করে অনেক সন্তান পিতামাতাকে কোনো অজানা গন্তব্যের গাড়িতে তুলে দেন। অথবা কোনো লোকালয়ে ফেলে রেখে আসে। সেখান থেকে কোনো মানবতাবাদী হয়তো তাকে হাসপাতাল কিংবা স্থানীয় প্রশাসনের হাতে তুলে দেন। বৃদ্ধ, অচল, অসহায় পিতা-মাতার পাশে সামান্য সময় দেয়ার যেন কেউ নেই। বড় বড় আসবাবপত্রের ঠাঁই হলেও বৃদ্ধ পিতা-মাতার সামান্য জায়গা হয় না মস্তবড় ফ্ল্যাটে। তাদের জন্য যেন বাসাটা খুবই সংকীর্ণ। তখন ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় বৃদ্ধাশ্রম ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দারা সন্তানদের সুনাম রক্ষায় তাদের পরিচয় গোপন রাখেন। বৃদ্ধাশ্রমে আছে অনেক কিছুই, তবু যেন কিছ্ইু নেই সেখানে। সবার ভেতরে শুধু হাহাকার পরিবারের সদস্যদের একনজর দেখার জন্য। কেউ কেউ কাঁদতে কাঁদতে হয়ে গেছে বাকরুব্ধ। বৃদ্ধাশ্রমকে নিজের বাড়িঘর হিসেবে ধরে নিয়েছেন। সন্তানের কথা মনে করে অজান্তে দুই চোখ ভরে যায় লোনা পানিতে।

দেশের প্রবীণ মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। প্রবীণ মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বিশেষ উদ্যোগ নেওয়ার কথা বহু বছর ধরে বলে আসছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে এই বয়সের মানুষের সমস্যা মোকাবিলায় দেশে প্রস্তুতি নেই। ‘জনশুমারি ও গৃহ গণনা ২০২২’এর প্রাথমিক প্রতিবেদন বলছে- দেশে ৬০ বছরের বেশি বয়সি মানুষের সংখ্যা ১ কোটি ৫৩ লাখ ২৬ হাজার ৭১৯। তারা মোট জনসংখ্যার ৯ দশমিক ২৮ শতাংশ। ২০১১ সালের জনশুমারিতে এ হার ছিল ৭ দশমিক ৪৭ শতাংশ। দেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রবীণ মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। জনশুমারি বলেছে, দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কম। অন্যদিকে প্রবীণ জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বেশি। জাতিসংঘের জনসংখ্যা উন্নয়ন তহবিলের প্রাক্কলন বলেছে, ২০২৫-২৬ সালে প্রবীণের সংখ্যা হবে ২ কোটি। ২০৫০ সালে ওই সংখ্যা হবে সাড়ে ৪ কোটি, যা তখনকার জনসংখ্যার ২১ শতাংশ হবে। ‘বার্ধক্য মোকাবিলায় আমাদের কোনো প্রস্তুতি নেই। প্রবীণেরা দীর্ঘমেয়াদি বার্ধক্যজনিত রোগে ভোগেন। তাদের জন্য বিশেষায়িত চিকিৎসা ও সেবা দরকার। দেশে তা নেই।’ আজ যাদের বয়স তুলনামূলকভাবে কম। তাদেরও যে কোনো একদিন অসহায় বৃদ্ধদের মতো জীবনযাপন করতে হবে না- এমনটা ভাবার কোনো সুযোগ নেই। সমাজের এই প্রবীণ জনগোষ্ঠী এককালে সম্পদ ছিল কিন্তু আজ তারা পরিবার, সমাজ এমনটি রাষ্ট্রের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। এই পরিস্থিতি কারো কাম্য হতে পারে না।