জানুয়ারিতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন

গুজবে ভাসছে দেশ কে রুখবে অপপ্রচার

প্রকাশ : ০২ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  শামীম সিদ্দিকী

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নানা গুজব ও অপপ্রচার প্রতিদিনই ডালপালা গজাচ্ছে। এই গুজবের পরিসর দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে বিদেশেও। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে না পেরে চিহ্নিত কুচক্রীমহল দেশের বাইরের শক্তির ওপর ভরসা করছে। বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক ভিত্তিহীন সংবাদ তৈরি করে তা ফেসবুক ও ইউটিউবে ছেড়ে দিয়ে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলছে।

বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় সংসদ নিবাচনের দাবি থেকে সরে এসে এখন নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে রাজপথে আন্দোলন করছে। নির্বাচিত সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের যে প্রক্রিয়া সারা দুনিয়ায় বিদ্যমান, তারা সেটি মেনে নিতে পারছে না। অথচ একটি নির্বাচিত সরকারের কাছে একটি নির্বাচিত সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর করবে- এমন সাংবিধানিক বিধি যা বিশ্বের প্রতিটি গণতান্ত্রিক দেশ পালন করে আসছে।

দাবি আদায়ে বিএনপি এখন যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি শক্তিশালী দেশের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপে বিএনপি আবার ক্ষমতায় যাওয়ার যে স্বপ্ন দেখছে, সেটি ভ্রান্ত এবং একটি অলীক কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়। বাংলাদেশে যে কোনো সাধারণ বিষয়ে বিএনপি যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের কামনা করে; এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রধান এই দলটির দেউনিয়াপনা ছাড়া আর কিছু নয়। তারা এজন্য বাংলাদেশের একমাত্র নোবেলবিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ব্যবহার করেও অবশেষে ব্যর্থ হয়েছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে তার প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের মামলা করার ক্ষেত্রে সরকারের সায় আছে- এমনটি বুঝিয়ে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে দেড় শতাধিক বরেণ্য ব্যক্তির চিঠি আনা হয়েছে। বিষয়টি একান্ত ব্যক্তিগত, আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক হওয়ায় এটি নিয়ে ওইসব স্বনামধন্য ব্যক্তি আর বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে পরবর্তী পদক্ষেপ আশা করেননি। এ ক্ষেত্রেও বিএনপির যড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে বলেই প্রতীয়মান হয়। তবে বিএনপি বসে থাকার দল নয়। যুক্তরাষ্ট্রে লবিং করে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটা অস্পষ্ট ভিসানীতি কার্যকর করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। ভিসানীতি কার্যত ‘সফল’ হলেও তারাই এর কবলে পড়বে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। কেন না মার্কিন ভিসানীতির প্রথম বক্তব্যটি হচ্ছে- কোনো গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়ায় কোনো রাজনৈতিক দলের কোনো নেতা বাধা দিলে তিনি এবং তার পরিবারের সদস্যরা মার্কিন ভিসা নীতির আওতায় আসবেন।

ভিসানীতি নিয়ে আওয়ামী লীগবিরোধী মহল নানা রকম বিভ্রান্তিমূলক তথ্য পরিবেশন করছে। প্রথমত, ভিসানীতিকে তারা ‘অবরোধ’র পর্যায় নিয়ে গেছে। কয়েক দিন যাওয়ার পর তারা এখন রটিয়ে বেড়াচ্ছে- বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ‘অর্থনৈতিক’ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। ভিসানীতি নিয়ে অস্পষ্টতা থাকায় মানুষ অনেকটা ধোঁয়াশার মধ্যে পড়েছে। ভিসার জন্য আবেদন করলে সেটি নাকচ হলেই কেবল মাত্র বাংলাদেশের মার্কিন দূতাবাস জানিয়ে দেবে যে এসব কারণে আপনাকে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা দেয়া যাচ্ছে না। তবে বাস্তবতা হচ্ছে আমাদের দেশে এই গুজবটি অতি বেশি পরিপক্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের কোন কোন নাগরিকের নাম মার্কিন ভিসানীতির তালিকায় আছে, সেটি আওয়ামী লীগবিরোধী চক্রের ফেসবুক খুঁজলে পাওয়া যাবে।

এখন পরিচিত কারো সঙ্গে দেখা হলে ঠাট্টা মসকারা করে বলছেন- ভাই তালিকায় আছেন নাকি? না থাকলে ভালো। মার্কিন ভিসানীতি কার্যকর হওয়ার পর বিএনপির নেতাকর্মী এমনকি সাধারণ সমর্থকদের উচ্ছ্বাস যেন আর ধরে না। ভিসানীতির হাল-হকিকত পর্যালোচনা করে যখন মনে স্বস্তি আসল না, তখন গুজব ছড়াল অস্ট্রেলিয়াও বাংলাদেশে বিরুদ্ধে ভিসানীতি গ্রহণ করেছে এবং দেশটিতে বাংলাদেশি নাগরিকদের প্রবেশ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

খোঁজখবর নেয়ার পর যখন দেখা গেল, খবরটি গুজব ও অপপ্রচার তখন শুরু হল ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিয়ে নানা বিভ্রান্তিকর তথ্য পরিবেশন। ইউরোপীয় ইউনিয়নে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ-সংক্রান্ত একটি বিল উত্থাপন করা হয়েছে এমন গুজব ছড়ানো হলো। মার্কিন ভিসা নীতির অনেক বিষয় ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসও জানেন না বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। পিটার হাস একটি টেলিভিশন চ্যানেলে এক অনুষ্ঠানে গিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশের সাংবাদিকরাও মার্কিন ভিসানীতির আওতায় আসবেন। পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর তার এই বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে। একই অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, তিনি ও তার দূতাবাসের কর্মীরা বাংলাদেশে নিরাপত্তা বোধ করছেন না। তিনি এই বক্তব্যটি দিয়ে একটি ‘শব্দ বোমা’র বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন। কেন না, সরকারবিরোধীরা পিটার হাসের এই মন্তব্যকে সার্বজনিন রূপ দিয়ে বাংলাদেশকে কূটনৈতিকদের জন্য নিরাপদ নয়- এমনটি প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে। পিটার হাসের এ ধরনের মন্তব্যের পর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে কোনো জোরাল ভূমিকা না থাকায় পিটার হাসের বক্তব্যটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এছাড়া তিনি হুটহাট করে কোনো অফিস পরিদর্শনে গেলে সেটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অবহিত করা প্রয়োজন। এ বিষয়টিও তাকে বিনয়ের সঙ্গে বুঝিয়ে বলা দরকার হয়ে পড়েছে। অন্যথায় দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে এবং গুজব সৃষ্টিকারীরা আরো উৎসাহ বোধ করবে।

আগামী বছরের জানুয়ারি মাসের প্রথম দিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনের বছর আসলেই বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে একটি গোষ্ঠী কুৎসা, অপপ্রচার ও গুজরেবর রাজনীতিতে মেতে উঠে। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে স্মরণাতীত কাল থেকে এই ধরনের অপপ্রচার চলছে। তবে নির্বাচনের বছর এ ধরনের অপতৎপরতা বেড়ে যায়। বিগত দিনের জাতীয় নির্বাচনের আগে কুৎসা রটনা করা হয়েছে যে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে দেশ ভারত হয়ে যাবে। বাংলাদেশের এক দশমাংশ ভূ-খণ্ড ভারতের কবজায় চলে যাবে। ভারতের কাছে দেশ বিক্রি হয়ে যাবে। এই দেশে মসজিদে আজানের পরিবর্তে উলুধ্বনি শোনা যাবে, এমননি নানা কল্প কাহিনি আওয়ামী লীগবিরোধীরা প্রচার করেছে। এবার তারা শেখ হাসিনা সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রযুক্তিগত ডিভাইজ ব্যবহার করে সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে নেমেছে।

আওয়ামী লীগ শুধু দেশীয় শক্রর মুখোমুখি হয়নি, বিদেশি শক্তিও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নানা সময়ে সোচ্চার হয়েছে। বাংলাদেশ সম্পর্কে এর আগেও কোনো কোনো কূটনীতিক নানা ধরনের মন্তব্য করেছেন। সেটা কূটনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত ছিল কি না? সে বিষয়টি স্পষ্ট না হওয়ায় আগামী নির্বাচন নিয়ে অন্যান্য কূটনৈতিকরাও অনুরূপ মন্তব্য করতে পারেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। দেশে ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে গত বছরের নভেম্বর মাসে ঢাকায় নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি কূটনৈতিক সুলভ নয় এমন একটি বিতর্কিত বক্তব্য দেন। তিনি ঢাকার একটি হোটেলে আয়োজিত ‘মিট দ্য অ্যাম্বাসেডর’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে বলেন, তিনি ‘ব্যালট বাক্স ভর্তি’ করার ঘটনা সম্পর্কে শুনেছেন এবং আগের রাতে কিছু পুলিশ ব্যালট বাক্সে ভর্তি করে দিয়েছে, যা তিনি অন্য কোনো দেশে কখনো শোনেননি। তিনি বলেন, ‘ব্যালট বাক্সে ভরাট করার পুনরাবৃত্তি করা উচিত নয়’। জাতীয় নির্বাচন আসলেই শেখ হাসিনার সরকার বিরোধীরা ২০১৮ সালের নির্বাচন সম্পর্কে জাপানি রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যটির উদ্ধৃতি দিয়ে শুরু করে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কিংবা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তাদের এসব মন্তব্য সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়ানো হয়নি। বাংলাদেশ নিয়ে বিদেশি অতিথিরা আগেও বিরূপ মন্তব্য করেছেন। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল নিক্সন প্রশাসনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের বক্তব্যটি। তিনি বাংলাদেশকে ‘বাংলাদেশ তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। ১৯৭৪ সালের ৩০ অক্টোবর হেনরি কিসিঞ্জার একটি সরকারি সফরে এসে একথা বলেছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশে এটাই ছিল কোনো মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রথম সফর। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র এ সংগ্রামের বিরোধিতা করেছিল।

আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানোর আরেকটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে আর্বিভূত হয়েছে বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলের ‘টক-শো’। আওয়ামী লীগের হাত ধরে এমপি হওয়া বিএনপির নেতা এবং ছাত্রলীগের এককালের সভাপতি যিনি এখন বিএনপি নেতা তাদের দুইজনের ব্যস্ততা বেড়ে গেছে। এমন কোনো রাত নেই যে, তারা কোনো না কোনো টেলিভিশনের টকশোতে হাজির হচ্ছেন না। তারা এমন এমন অদ্ভূত অ™ূ¢ত বক্তব্য উপস্থাপন করেন, যা কেউ কোনো দিন শুনেনি। আবার টকশো’র বাহিরেও সামাজিক মাধ্যমে মনগড়া বক্তব্য দিয়ে ভিডিও প্রকাশ করে। বিএনপির ঘরোনার এই দুই আলোচককে বিএনপির তথ্য ও গবেষণা সেল থেকে নিয়মিত সরকার ও আওয়ামী লীগবিরোধী তথ্য সরবরাহ করা হয়। এসব তথ্য অতিরঞ্জিত, অসত্য এবং বস্তুনিষ্ঠ নয়। অথচ তারা অবলীলায় এসব তথ্য প্রমাণ উপস্থাপন করে দর্শকদের বিভ্রান্তি করছেন। বিএনপির নেতারা অত্যন্ত সাবলীল ভাষায় এসব মিথ্যা তথ্য দিয়ে প্রতিপক্ষ আলোচক আওয়ামী লীগ নেতাদের ঘায়েল করছেন। অনেক সময় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের আলোচকদের তথ্য ঘাটতিতে থাকায় প্রতিপক্ষ বিএনপি আলোচকদের মিথ্যাচার সত্য বলেই প্রতীয়মান হয়। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার আগেই এ ধরনের গুজব ও অপ্রচার বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে আওয়ামী লীগকে এর মাশুল দিতে হবে।

আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় যেমন এদেশীয় আল বদর, আল শামস ও জামায়াতে ইসলামী রাজাকাররা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল, ঠিক তেমনি এ দেশের এক শ্রেণির মানুষ ভদ্রবেশে প্রাণপ্রিয় এই দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার কাজে জড়িয়ে পড়েছে। তারা সকাল হলে অপেক্ষায় থাকে বাংলাদেশ যেন বহির্বিশ্বের নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পড়ে। তবে এটা মনে রাখা উচিত বাংলাদেশ আমাদের অহংকার, বাংলাদেশ আমাদের গৌরব। সব কিছুর ঊর্ধ্বে বাংলাদেশ আমাদের প্রিয় জন্মভূমি। পথ হারাবে না বাংলাদেশ।