৭ অক্টোবর তৃতীয় টার্মিনাল উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী

বিশ্বমানের অত্যাধুনিক বিমান টার্মিনালের যুগে বাংলাদেশ

প্রকাশ : ০৩ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

বাংলাদেশ বিশ্বমানের বিমান টার্মিনালের গৌরব অর্জন করতে যাচ্ছে। আগামী ৭ অক্টোবর হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের আংশিক উদ্বোধন করা হবে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের বিমান যোগাযোগব্যবস্থায় আরো এক ধাপ এগিয়ে যাবে। এ টার্মিনালে থাকছে বিশ্বমানের অত্যাধুনিক সব ব্যবস্থা। টার্মিনালটি চালু হওয়ার পর বিমানবন্দরে বাড়বে যাত্রীর সংখ্যা, বাড়বে উড়োজাহাজ। বিমানবন্দরটিতে থাকছে অত্যাধুনিক অগ্নি-নির্বাপকব্যবস্থা। আমদানি ও রপ্তানির জন্য থাকছে আলাদা কার্গো কমপ্লেক্স। যাত্রীদের জন্য রয়েছে মেট্রোরেলের সুবিধা। সেই সঙ্গে থাকছে ৩৭টি বিমান পার্কিংয়ের ব্যবস্থা। আগামী ৭ অক্টোবর স্বপ্নের এই মহা প্রকল্পটি উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

দেশের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ অলিগলির রাস্তা, মহাসড়ক, রেলপথ থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যোগাযোগের ক্ষেত্র প্রসারণ করেছে। হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের আংশিকের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। দেশের অন্যতম এই মেগাপ্রকল্পের কাজের অগ্রগতি ৯০ শতাংশ, যা প্রত্যাশার চেয়ে বেশি। এটি নির্মাণ সম্পন্ন হলে যাত্রীসেবার মানে আমূল পরিবর্তন আসবে বলে মনে করছে বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)।

জানা গেছে, টার্মিনালের অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জা এবং বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি স্থাপনের কাজ শেষ হয়েছে। দৃশ্যমান হয়েছে দৃষ্টিনন্দন টার্মিনাল ভবন। হজরত শাহজালাল বিমানবন্দরে এখন প্রতিদিন ৩০টির বেশি বিমান সংস্থার ১২০-১৩০টি বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণ করে। প্রতিদিন এসব বিমানের ১৯ থেকে ২১ হাজার যাত্রী বিমানবন্দরের দুটি টার্মিনাল (টার্মিনাল ১ ও ২) ব্যবহার করেন। বর্তমানে বছরে প্রায় ৮০ লাখ যাত্রীর সেবা দেওয়ার সুযোগ আছে। তৃতীয় টার্মিনাল চালু হলে আরো ১ কোটি ২০ লাখ যাত্রীকে সেবা দেওয়া সম্ভব হবে বলে কর্তৃপক্ষ দাবি করছে। এছাড়াও আমদানি ও রপ্তানির জন্য থাকছে আলাদা কার্গো কমপ্লেক্স। থাকবে ১১৫টি চেক-ইন কাউন্টার। নতুন টার্মিনালটিতে ৩৭টি বিমান পাকিং ধারণক্ষমতা সম্পন্ন একটি পার্কিং এপ্রোন থাকবে।

গতকাল সোমবার তৃতীয় টার্মিনালের প্রস্তুতির সর্বশেষ অবস্থা জানাতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সিভিল অ্যাভিয়েশন চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মফিদুর রহমান বলেন, ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্মাণাধীন তৃতীয় টার্মিনালের কাজ প্রায় ৯০ শতাংশ শেষ হয়েছে। আগামী ৭ অক্টোবর এর আংশিক উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে এখানে যাত্রী চলাচলে সময় লাগবে আরো ১ বছর।

সিভিল অ্যাভিয়েশনের চেয়ারম্যান বলেন, এরই মধ্যে রানওয়ের সঙ্গেও সংযোগ দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে অটোমেটিক রোবোটিক সমৃদ্ধ কার্গো টার্মিনাল করা হয়েছে। পাশাপাশি যাতায়াত সহজ করতে মাল্টিপল ট্রান্সপোর্টের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ ছাড়া হজ ক্যাম্প থেকে সরাসরি টানেল নির্মাণে সেনাবাহিনীকে কাজ দেওয়া হয়েছে। সফট ওপেনিংয়ের পর বাকি ১০ শতাংশ কাজের মধ্যে সব ইন্টেরিয়র কাজ। এখানে ১ হাজার ২৩০টি গাড়ি একসঙ্গে পার্কিং করতে পারবে। এ টার্মিনাল নির্মাণ শেষে বেশি পরিমাণ বিমান যাতায়াত শুরু হলে বিমানের ভাড়া কমে আসবে। এতে দেশের অ্যাভিয়েশন খাতের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে। সরকারের বড় একটি অর্জন হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল।

মফিদুর রহমান আরো বলেন, আমাদের লক্ষ্য ছিল ৯০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন করে আংশিক উদ্বোধনে যাওয়া। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী আমাদের ৮৯ বা প্রায় ৯০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে।

বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) তথ্য অনুযায়ী, হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এখন প্রতিদিন ১২০-১৩০টি বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণ করে। ১৯ থেকে ২১ হাজার যাত্রী প্রতিদিন বিমানবন্দরের দুটি টার্মিনাল (টার্মিনাল ১ ও ২) ব্যবহার করেন। এখানে বর্তমানে বছরে প্রায় ৮০ লাখ যাত্রীর সেবা দেয়ার সুযোগ আছে। ২১ হাজার ৩৯৯ কোটি টাকা ব্যয়ে তৃতীয় টার্মিনালের নির্মাণ শুরু হয় ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে। তিন তলা এ টার্মিনালের আয়তন ২ লাখ ৩০ হাজার বর্গমিটার। এতে ১১৫টি চেক-ইন কাউন্টার, ৬৪টি ডিপার্চার ও ৬৪টি অ্যারাইভাল ইমিগ্রেশন ডেস্ক, ২৭টি ব্যাগেজ স্ক্যানিং মেশিন, ৪০টি স্ক্যানিং মেশিন, ১২টি বোর্ডিং ব্রিজ, ১১টি বডি স্ক্যানার ও ১৬টি ক্যারোসেল থাকবে।

২০১৭ সালে তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণের প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়। নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ২১ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাপানি সহযোগিতা সংস্থা জাইকা ঋণ হিসেবে দিচ্ছে ১৬ হাজার ১৪১ কোটি টাকা। আর বাকি টাকা দিচ্ছে বাংলাদেশ সরকার। এই নির্মাণকাজ করছে জাপানের মিতসুবিশি ও ফুজিতা এবং দক্ষিণ কোরিয়ার স্যামসাং। পরিকল্পনা অনুসারে, এ প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে ২০২৪ সালের এপ্রিলে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিমানবন্দর পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ কাজের একটি অংশ গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং। বিমানবন্দরে উড়োজাহাজ অবতরণের পর পথ দেখিয়ে পার্কিং ব্যবস্থা নেওয়া, দরজায় সিঁড়ি লাগানো, যাত্রীদের মালপত্র ওঠানো-নামানো, উড়োজাহাজের ভেতর পরিষ্কার করা, চেকইন কাউন্টারে সেবার মতো কাজ গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের অন্তর্ভুক্ত। দেশের সব বিমানবন্দরে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের কাজ বর্তমানে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস করছে। বিমানের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সেবার মান নিয়ে অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু শাহজালাল বিমানবন্দর তৃতীয় টার্মিনালের বিষয়ে যাত্রীদের সেই অভিযোগের কোনো সুযোগ থাকছে না।

দেশের প্রধান বিমানবন্দর শাহজালালে বর্তমানে দুটি টার্মিনাল রয়েছে। এই দুটি টার্মিনাল ১ লাখ বর্গমিটার জায়গার ওপর। তৃতীয় টার্মিনালটি ওই দুটি টার্মিনালের চেয়ে দ্বিগুণ। ২ লাখ ৩০ হাজার বর্গমিটার এলাকা। প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, তৃতীয় টার্মিনালে মোট ৩৭টি অ্যাপ্রোন পার্কিং থাকবে। অর্থাৎ একসঙ্গে ৩৭টি উড়োজাহাজ পার্ক করা যাবে। শাহজালাল বিমানবন্দরে বর্তমানে চারটি ট্যাক্সিওয়ে আছে। নতুন করে আরো দুটি হাই স্পিড ট্যাক্সিওয়ে যোগ হচ্ছে। রানওয়েতে উড়োজাহাজকে যাতে বেশি সময় থাকতে না হয়, সে জন্য নতুন দুটি ট্যাক্সিওয়ে তৈরি করা হচ্ছে। এ ছাড়া পণ্য আমদানি ও রপ্তানির জন্য দুটি ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। আরো থাকবে গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য তিনতলা ভবন। থার্ড টার্মিনাল ভবনের সঙ্গে ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গপথ ও উড়ালসেতু নির্মাণ করা হবে, যার মাধ্যমে মেট্রোরেল ও ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সংযোগব্যবস্থা থাকবে। এতে থাকবে আন্তর্জাতিক মানের অত্যাধুনিক অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা।

প্রকল্পের অগ্রগতি আশাব্যঞ্জক জানিয়ে বেসামরিক বিমান পরিবহন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী বলেন, তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণে জড়িত জাপানি এবং কোরিয়ান যে প্রকৌশলীরা ছিলেন, তারা কোভিড শুরুর পর নিজ দেশে ফিরতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমরা তাদের আশ্বস্ত করি, যত সহযোগিতা প্রয়োজন, তাদের তা দেয়া হবে- চিকিৎসা থেকে শুরু করে সবকিছুই। এ কারণে তারা আর ফিরে যাননি। এই কাজ এক দিনের জন্যও বন্ধ হয়নি। এতে আমরা প্রত্যাশার চেয়েও অনেক দূর অগ্রসর হয়েছি। এখন কাজে অগ্রগতিও দৃশ্যমান।

প্রসঙ্গত, বিদেশগামী যাত্রীদের জন্য টার্মিনালে ১৫টি সেলফ সার্ভিস কাউন্টারসহ ১১৫টি চেক-ইনকাউন্টার এবং ১০টি স্বয়ংক্রিয় পাসপোর্ট নিয়ন্ত্রণ কাউন্টারসহ ৬৬টি ডিপার্চার ইমিগ্রেশন কাউন্টার থাকবে। বিশ্বমানের টার্মিনালটিতে ১ হাজার ৪৪টি গাড়ি রাখার সক্ষমতাসহ বহুতল গাড়ি পার্কিংও তৈরি করা হয়েছে।