ঢাকা ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৯ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

রাজনীতিতে ‘অক্টোবর’ আতঙ্ক

সরকার পতনের হুমকির জবাবে উন্নয়ন সমাবেশ

সরকার পতনের হুমকির জবাবে উন্নয়ন সমাবেশ

চলতি অক্টোবর মাসে সরকার পতনের একদফার ডাক দিয়েছে রাজপথের বিরোধীদল বিএনপি। এ মাসেই যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভিসানীতির বাইরে আরো একটি বিধি-নিষেধ আরোপ করবে বলে ঢাকাস্থ মার্কিন কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছে। তবে সেই ঘোষণা আসতে না আসতে বিএনপি শক্ত করে ‘কোমর’ বেঁধেছে। তারা ভাবছে এবার হয়তো সরকারের পতন ঘটানো যাবে। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি কার্যকর হওয়ার পর এখন পর্যন্ত কোনো বাংলাদেশি নাগরিকের ভিসা বাতিল হয়েছে বলে শোনা যায়নি। ভিসানীতি কার্যকর করে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে বাংলাদেশের মানুষকে আতঙ্কিত করতে চেয়েছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের মানুষ সেভাবে ‘ভয়’ পায়নি। যেসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ভিসানীতির আওতায় আনা হবে বলে আগাম খবর ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল তাদের মধ্যেও কেউ আতঙ্কিত হয়নি। বরং তারা জানিয়ে দিয়েছেন, মার্কিন ভিসানীতি তারা ‘পরোয়া’ করে না। ভিসানীতি কার্যকর হওয়ার পরবর্তী পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের মানুষ কার্যত বিচলিত হয়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভয়েজ অব আমেরিকার সঙ্গে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেই দিয়েছেন তার সরকার ও দেশের জনগণ মার্কিন ভিসানীতিতে ভীত নয়। যুক্তরাষ্ট্র যা খুশি করতে চায় করুক। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এমন দৃঢ় বক্তব্যে দেশের মানুষ ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য উচ্চ যেথা শির’ এই মনোবলে উজ্জীবিত হয়েছে। ভিসা নীতি ও মার্কিন ‘অজ্ঞাত’ নীতির ওপর ভর করে চলতি মাসেই বিএনপি সরকার পতনের ডাক দিয়ে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করার পরের দিন থেকেই বিএনপি আওয়ামী লীগ সরকার পতনের ডাক দিয়ে আন্দোলন-কমসূচি পালন করে আসছে। ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন বানচাল করতে বিএনপির ডাকা ‘অবরোধ’ কমসূচির আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি এখনো ঘটানো হয়নি। বিভিন্ন টেলিভিশনের টক শো শো অনুষ্ঠানে এ ব্যাপারে বিএনপির নেতাদের প্রশ্ন করা হলে তারা বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছেন। ‘অবরোধ’ কর্মসূচি অব্যাহত থাকার মধ্যে বিএনপি আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আন্দোলনে মাঠে নেমেছে। এরই মধ্যে তারা সভা-সমাবেশ, মহাসমাবেশ ‘১০ ডিসেম্বর’ এর সমাবেশ, ‘তারেক জিয়ার দেশে ফিরে এসে দলের নেতৃত্ব দেয়ার’ এবং তারেক জিয়ার নির্দেশে রাষ্ট্রীয় কাঠামো পরিচালিত হবে এমন আগাম ঘোষণা দিয়ে এখন লুকোচুরি খেলছে। আগামী মাসে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে এই অক্টোবর মাসে চূড়ান্ত আন্দোলনের ডাক দিয়েছে বিএনপি। তবে সরকার পতনের আন্দোলনে কী কী অনুষঙ্গের দরকার হয় তার সন্ধান রাজপথের এই দলটি এখনো পায়নি। কল্পনা জগতে বিচরণ করেও একটি নির্বাচিত সরকারের পতন ঘটানোর স্বপ্ন দেখা সম্ভব নয়- এটাই কঠিন বাস্তবতা। চলতি মাসের মধ্যে সরকার পতন না হলে এবং আগামী বছরের জানুয়ারি মাসের শুরুর দিকে জাতীয় নির্বাচনের তারিখ ঘোষিত হলে বিএনপির আর কোনো কিছুই করার থাকবে না। তখন গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করার অপরাধে ‘পেয়ারে’ যুক্তরাষ্টের ভিসানীতির আওতায় পড়ে বিএনপির নেতারা হাবুডুবু খাবেন। তারা কিংবা তাদের পরিবারের কোনো সদস্য কোনো দিন আর যুক্তরাষ্ট্র যেতে পারবেন না। সে কারণে অক্টোবর মাস বিএনপির অস্তিত্ব রক্ষার মাস। এই মাসটি পেরিয়ে গেলে বিএনপি হারিয়ে যাবে- এমন আশঙ্কাও বিএনপির রয়েছে। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ যখন জাতীয় নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে, ঠিক তখনই রাজপথের বিরোধী দল বিএনপি চেষ্টা করছে একটি নির্দলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবি মানতে সরকারকে বাধ্য করার। বিএনপি সূত্র বলেছে, দাবি আদায়ে আগামী দিনের আন্দোলন আরো জোরদার করা হবে। তবে সেটি কখন, সেটাও পরিষ্কার নয়। বিএনপি তাদের আন্দোলনের গতি বাড়াতে চলতি মাসে লাগাতার সমাবেশ ও রোডমার্চের ঘোষণা দিয়েছে। তবে ‘মুখ চেনা’ কর্মসূচি দিয়ে সরকারের পতন ঘটানো গেলে আওয়ামী লীগ অনেক আগেই ক্ষমতাচ্যুত হতো।

সূত্র জানায়, আগামী মাসে সম্ভব্য নির্বাচনি তফসিল ঘোষণার আগেই বর্তমান সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকার গঠনের দাবি আদায়ের মধ্যদিয়ে বিএনপি তাদের আন্দোলনের লক্ষ্য অর্জন করতে চায়। আগামী বছরের জানুয়ারির প্রথম দিকে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়ার সুযোগ না পেলে সরকারের পতন নয় বরং জনগণের মাঝে বিএনপিরই পতন ঘটবে। বিএনপির নেতারা জানিয়েছেন, সেপ্টেম্বরের পালিত কর্মসূচির অর্জনের সঙ্গে অক্টোবরের পালিত কর্মসূচির অর্জনের সমন্বয়ের মধ্যদিয়ে সরকারের পতনে সহায়ক হবে। তারা বলেছেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্বে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটবে। বিএনপি নেতারা বলেছেন, নির্দলীয় নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের জন্য জনগণকে আন্দোলনে নামাতে পর্যায়ক্রমে কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। এসব কমসূচির মধ্যে রয়েছে সমাবেশ, রোডমার্চ এমনকি হরতালও। সব অঞ্চলেই রোডমার্চ করার নীতিগত সিদ্ধান্তও নিয়েছে বিএনপি। বিএনপির তিনটি ফ্রন্ট ও সহযোগী সংগঠন এরই মধ্যে রাজধানী ও দেশের উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় রোডমার্চ করেছে। যেখানে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ঘোষণা করেছেন, সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত না করা পর্যন্ত রোডমার্চ চলবে। তিনি বলেছেন, এই কর্মসূচিগুলো থেকে আমরা জনগণকে সচেতন করার লক্ষ্যে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে চাই। ঢাকা মহানগর ও এর আশেপাশের এলাকায় নতুন করে বিএনপি কর্মসূচি পালন করবে বিএনপি, যা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা না হওয়া পর্যন্ত চলবে। বিএনপি গত ১২ জুলাই সরকার পতনে ‘এক দফা’ আন্দোলন শুরু করে। তারা ঢাকার প্রবেশপথগুলোতে অবস্থান কর্মসূচিসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে। বিএনপি নেতারা বলেছেন, তারা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করতে চান। কিন্তু সরকার তাদের দাবি না মানলে অক্টোবর মাসে বিরতিহীন কঠোর কর্মসূচিতে যাবেন তারা। লক্ষ্য অর্জন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। অক্টোবর মাসে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নতুন নিষেধাজ্ঞা আসছে বলে এরই মধ্যে গুজব ছড়িয়ে পড়েছে। আর তাতেই ‘বাস্পয়ীত’ হয়েছেন বিএনপির নেতাকর্মী ও তাদের সমর্থকরা। তবে ইতোপূর্বের সমাবেশ ও রোডমার্চের অর্জন দৃশ্যমান না হওয়ায় অক্টোবরে বিএনপির সরকার পতনের আন্দোলন মোকাবিলায় আওয়ামী লীগ কী কৌশল গ্রহণ করবে, তা নিয়ে চলছে দলীয় পর্যায়ে আলোচনা। এই সরকারের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন মহাপ্রকল্প অক্টোবর মাসেই উদ্বোধন করা হচ্ছে। উদ্বোধন উপলক্ষ্যে আয়োজিত উন্নয়ন সমাবেশের মাধ্যমে বিএনপির অপতৎপরতার জবাব দিতে প্রস্তুত হচ্ছে আওয়ামী লীগ।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সভাপতিত্বে ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণ শাখা ও ঢাকার আশপাশের জেলা শাখা এবং সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোর সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা। ওই বৈঠকে ওবায়দুল কাদের জানিয়েছেন, ৭ অক্টোবর ‘ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এটি উদযাপন করতে সুধী সমাবেশের আয়োজন করা হবে। আগামী ১০ অক্টোবর পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত রেল চলাচলের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী। এ উপলক্ষ্যে পদ্মা সেতুর মাওয়া প্রান্তে সুধী সমাবেশ করা হবে।’ মেট্রোরেলের আগারগাঁও থেকে মতিঝিল অংশ ২৩ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করবেন জানিয়ে তিনি বলেছেন, ‘এ উপলক্ষ্যেও মতিঝিলের শাপলা চত্বরে সুধী সমাবেশ করা হবে। অক্টোবরের ২৮ তারিখে উদ্বোধন করা হবে দক্ষিণ এশিয়ায় নদীর তলদেশে প্রথম ‘বঙ্গবন্ধু টানেল’। সেখানেও সমাবেশের আয়োজন করা হবে। ওবায়দুল কাদের বলেছেন, অক্টোবর মাস হবে মহাপ্রকল্প উদ্বোধনের মাস। আর উন্নয়ন সমাবেশের মাধ্যমে বিএনপির সরকার পতনের ডাক প্রতিহত করার মাস।

গতকালও ঢাকার আশুলিয়ায় সমাবেশ করেছে আওয়ামী লীগ। আগামী ১৮ অক্টোবর শেখ রাসেলের জন্মদিন উদযাপন করা হবে।’ ঢাকা ও এর আশপাশের জেলায়ও সমাবেশের আয়োজন করা হবে। ‘মহিলা আওয়ামী লীগ ও যুব মহিলা লীগসহ তিন সংগঠনের উদ্যেগে মহাসমাবেশ আয়োজনের কথা রয়েছে আলোচিত এই অক্টোবর মাসে। পেশাজীবীদের নিয়ে হবে আরেকটি সমাবেশ। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বিএনপি অক্টোবর মাসজুড়ে রাজপথে থাকবে। আওয়ামী লীগও বিএনপির নৈরাজ্য প্রতিহত করতে মাঠে থাকবে। সরকার পতনের ডাক দিয়ে তা রক্ষা করার মতো রাজনৈতিক সক্ষমতা বিএনপির নেই। কেবল রাজনৈতিক হুংকার দিয়ে রাজপথের আন্দোলনে সফল হওয়া যায় না। সবচেয়ে বেশি দরকার হয় জনগণের সম্পৃক্ততা। বিএনপি কেবল খালেদা জিয়া আর তারেক জিয়ার বাইরে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটে- এমন কোনো কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামেনি। ফলে জনগণের দোরগোড়ায় যেতে পারেনি দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা এই দলটি। আর সে কারণে অক্টোবর আতঙ্ক ছড়িয়ে বিএনপি সরকারের পতনের স্বপ্নপূরণ করতে পারবে না। এই হুংকারটিও রাজধানীর গোলাপবাগের গরুর হাটের সমাবেশের মতো হারিয়ে যাবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত