ঢাকা ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

পরমাণু জ্বালানি হস্তান্তর অনুষ্ঠানে হাসিনা-পুতিন

পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারকারী দেশের তালিকায় বাংলাদেশ

* নিউক্লিয়ার ক্লাবের ৩৩তম সদস্য হলো দেশ * জিডিপিতে রাখবে ২ শতাংশ অবদান
পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারকারী দেশের তালিকায় বাংলাদেশ

বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতোই রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুতের যুগে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যয়বহুল প্রকল্পের জ্বালানি আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার ‘ফ্রেশ নিউক্লিয়ার ফুয়েল’ বা ইউরেনিয়াম হস্তান্তর অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আলী হোসেন। এছাড়া শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) ডিজি রাফায়েল মারিয়ানো গ্রসি, রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় পারমাণবিক শক্তি করপোরেশন রোসাটমের মহাপরিচালক অ্যালেক্সিই লিখাচেভ। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন পাবনা-৪ আসনের সংসদ সদস্য আলহাজ নুরুজ্জামান বিশ্বাস, সিরাজগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য ডা. হাবিবে মিল্লাত, ঈশ্বরদী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. নায়েব আলী বিশ্বাস ও পৌরসভার মেয়র ইছাহক আলী মালিথাসহ বিভিন্ন স্তরের মানুষ।

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, আওয়ামী লীগ একটানা ১৪ বছরের বেশি সময়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় রয়েছে। এই সময়ে দেশের আর্থিক ভিত্তি মজবুত, অবকাঠামো উন্নয়ন থেকে শুরু করে ডিজিটালাইজেশনের কাজ এগিয়েছে। একই সঙ্গে পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, রেলপথ সম্প্রসারণ ও মেট্রোরেলসহ বড় বড় মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। তবে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র শুধু মেগা প্রকল্পই নয়, এই প্রকল্প বাস্তবায়ন উন্নয়নশীল বাংলাদেশকে পারমাণবিক দেশের মার্যাদায় বিশ্ব দরবারে তুলে ধরেছে। জানা গেছে, ১৯৬১ সালে পাবনার ঈশ্বরদী থানার রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হলেও পরে তা বন্ধ হয়ে যায়। তবে স্বাধীনতার পরপরই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ শুরু করতে ফ্রান্স ও রাশিয়ার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করায় সেটি বাস্তবায়ন করে যেতে পারনেনি তিনি। বঙ্গবন্ধু সেটি করে যেতে না পারলেও তারই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ঐতিহাসিক এই কমিশনিংয়ের মধ্যদিয়ে বিশ্বের ৩৩তম ইউরেনিয়াম জ্বালানির যুগে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। আর এতেই খুলেছে জ্বালানির নতুন দ্বার। এটি বাণিজ্যিক উৎপাদনের পর জিডিপিতে ২ শতাংশ অবদান রাখবে।

ইউরেনিয়াম হস্তান্তর অনুষ্ঠানকে ঘিরে উৎসবের সাজে সাজে ঈশ্বরদীর রূপপুর এলাকা। পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের সড়ক ও প্রকল্প এলাকায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের ছবি সংবলিত ব্যানার, ফেস্টুনসহ বিভিন্ন রঙের পতাকা শোভা পায়। সবমিলিয়ে রূপপুর প্রকল্প এলাকা যেন উৎসবের নগরীতে পরিণত হয়। ঐতিহাসিক এই মুহূর্তের সাক্ষী হতে প্রকল্পের শ্রমিক থেকে শুরু করে সবাই উন্মুখ হয়ে ছিলেন।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের শ্রমিক নাসির উদ্দিন বলেন, ২ বছর ধরে এখানে কাজ করছি। বিশাল একটি কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এটি বাস্তবায়নে দেশের জ্বালানি খাতে বেশ ভূমিকা রাখবে।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান কবিতার ভাষায় বলেন, ‘পিতা চেয়েছিল পরমাণু যুগ শুরু হোক রূপপুরে, পিতার চাওয়া হয়েছে পূরণ কন্যার হাত ধরে। রূপপুর আজ রূপ পেয়েছে অর্জন অশেষ; এই না হলে শেখের বেটি সাবাস, সাবাস বাংলাদেশ।’

প্রকল্পের গ্রিনসিটি এলাকার বেশ কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা জানান, এ অর্জনে নিজেদের গর্বের অংশীদার মনে করেন তারা। তারা বলেন, ‘এটি আমাদের জন্য কত আনন্দ ও গর্বের, তা বলে বোঝাতে পারব না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নানা চ্যালেঞ্জের মুখে প্রকল্পটি বাস্তবে রূপ দিয়েছেন।’

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র দেশের জিডিপিতে ২ শতাংশ অবদান রাখবে জানিয়ে ইয়াফেস ওসমান বলেন, সাধারণত নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণে ১২ থেকে ১৫ বছর সময় লাগে। সে হিসাবে মাত্র ৭ থেকে ৮ বছরের মধ্যে নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট নির্মাণ একটি মাইলফলক। এসবই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মাধ্যমে সম্ভব হয়েছে।

গ্র্যাজুয়েশন অনুষ্ঠানের পর আগামী বছরের সেপ্টেম্বরে পরীক্ষামূলকভাবে রূপপুর পারমাণবিক বিদুৎকেন্দ্রের বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে। প্রকল্প পরিচালক ড. মো. শৌকত আকবর বলেন, ‘আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করছি। সবার যথাযথ কর্মপরিকল্পনা যদি ঠিক থাকে তাহলে আশা করছি আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে জাতীয় গ্রিডে সংযোগ দিতে পারবো। এটা আমাদের টাইম লাইন। আমরা একা নয়, সবাই যদি আমরা যার যার দায়িত্ব পালন করি তাহলে আগামী বছরের সেপ্টেম্বরের মধ্যে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ দিতে পারব। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পুরোপুরি উৎপাদনে গেলে প্রতিদিন জাতীয় গ্রিডে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যুক্ত হবে।’

প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পটিতে ৭ হাজার পেশাদারসহ ৩০ হাজার দেশি-বিদেশি কর্মী কাজ করছেন। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মাধ্যমে পারমাণবিক ক্লাবে প্রবেশ বাংলাদেশকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে সক্ষম হবে। কারণ, এটি কার্বন নিঃসরণ হ্রাস লক্ষ্যমাত্রা পূরণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবে। একই সময়ে এটি ফ্ল্যাশের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ কমিয়ে দেবে। আরএনপিপি প্রতিদিন ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং কার্বন নিঃসরণ কমানোর বৈশ্বিক উদ্যোগ নিশ্চিত করবে। রাশিয়ান ঠিকাদার হিসেবে রোসাটম, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে। বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিটি ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার দুটি ইউনিট নিয়ে গঠিত। মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরমাণু শক্তি কমিশন আরএনপিপি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। রাশিয়ান ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি অ্যাটমস্টোএক্সপোর্ট প্রকল্পের অধীনে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াটের দুটি ইউনিট নির্মাণ করছে। পারমাণবিক জ্বালানি রোসাটমের সহযোগী কোম্পানি টিভিইএল ফুয়েল তৈরি করছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তাদের কাছ থেকে পারমাণবিক জ্বালানি ক্রয় করে।

ওয়ার্ল্ড নিউক্লিয়ার অ্যাসোসিয়েশনের ওয়েবসাইট অনুসারে, পরমাণু শক্তি ব্যবহারকারী দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে- যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ফ্রান্স, রাশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, কানাডা, ইউক্রেন, জার্মানি, জাপান, স্পেন, সুইডেন, বেলজিয়াম, যুক্তরাজ্য, ভারত, চেক প্রজাতন্ত্র, ফিনল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, বুলগেরিয়া, পাকিস্তান, হাঙ্গেরি, স্লোভাকিয়া, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা, মেক্সিকো, রোমানিয়া, আর্জেন্টিনা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বেলারুশ, স্লোভেনিয়া, নেদারল্যান্ডস, ইরান ও আর্মেনিয়া। এবার যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ।

বর্তমানে পৃথিবীর ৩০টি দেশে ৪৪৯টি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। সেগুলো থেকে উৎপন্ন বিদ্যুতের পরিমাণ মোট উৎপন্ন হওয়া বিদ্যুতের প্রায় ১২ শতাংশ। ১৪টি দেশে আরও ৬৫টি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন রয়েছে। ২০২৫ সাল নাগাদ ২৭টি দেশে আরো ১৭৩টি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের প্রক্রিয়া চলছে। জানা গেছে, প্রথম ইউনিট (১২০০ মেগাওয়াট) চালু জন্য ৭৫ টন ইউরেনিয়াম প্রয়োজন। একবার জ্বালানি দেওয়ার পর ১৮ মাস নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। এরপর এক-তৃতীয়াংশ ইউরেনিয়াম অর্থাৎ ২৫ টন তুলে সেখানে নতুন করে লোড দিতে হবে। এরপর আবার ১৮ মাস চলবে। এভাবে ১৮ মাস পরপর আংশিক জ্বালানি পরিবর্তন করতে হবে। ১ কেজি ইউরেনিয়াম প্রায় ১০০ টন কয়লার সমান তাপ উৎপাদনে সক্ষম। আর একই পরিমাণ তাপ তেলে উৎপাদন করতে হলে ৬০ টন ডিজেল প্রয়োজন হবে। যে কারণে এটি সহজে পরিবহণযোগ্য বিবেচনা করা হয়। এই জ্বালানি একবার লোড করে নিরবচ্ছিন্নভাবে ১৮ মাস বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। একই পরিমাণ বিদ্যুৎ অন্য জ্বালানিতে পেতে হলে অনবরত সরবরাহ অব্যাহত রাখতে হয়।

প্রকল্পের বিবরণ অনুযায়ী সরকার আশা করছে রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে ও দ্বিতীয় ইউনিটটি ২০২৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে চালু হবে। প্রকল্পটিতে ৭ হাজার পেশাদারসহ ৩০ হাজার কর্মী কাজ করছেন। প্রকল্পটি ৬০ থেকে ৮০ বছর ধরে কাজ করবে বলে আশা করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহার : ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প বাস্তবায়নের অঙ্গীকার ছিল। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়লাভের পর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় এসে ‘রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে অপরিহার্য কার্যাবলী সম্পাদন’ শীর্ষক উদ্যোগ নেয়। ২০০৯ সালের ১৩ মে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন এবং রাশান ফেডারেশনের স্টেট অ্যাটমিক এনার্জি করপোরেশনের (রোসাটোম) মধ্যে ‘পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার’ বিষয়ক একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়। এর এক বছর পর তারা একটি ‘ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তি’ সই করেন। একই বছরের ১০ নভেম্বর জাতীয় সংসদে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। ২০১২ সালের ১৯ জুন জাতীয় সংসদে বাংলাদেশ পারমাণবিক শক্তি নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১২ পাস হয়। ২০১৬ সালের ২১ জুন রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সাইট লাইসেন্স দেয় বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন প্রকল্প বাস্তবায়ন বিষয়ে রাশান ফেডারেশন ও বাংলাদেশ পক্ষের সমন্বয়ে গঠিত জয়েন্ট কোঅর্ডিনেটিং কমিটির (জেসিসি) একটি সভা ওই বছরের ২২ জুন ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন প্রকল্প সংশ্লিষ্ট জ্বালানি সরবরাহ, জ্বালানির ব্যবস্থাপনা, অপারেশন ও মেনটেইন্যান্স সংক্রান্ত চুক্তির বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ নানা সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ২০১৭ সালের ৩ জুলাই রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করেন আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার মহাপরিচালক ইউকিয়া আমানো। তিনি এ কেন্দ্র স্থাপনে সব আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করায় সন্তোষ প্রকাশ করেন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত