ঢাকা ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

জাতীয় নির্বাচনের আগে কঠিন পরীক্ষায় ইসি

বিতর্কে জড়াচ্ছেন সিইসি ‘সুযোগ’ খুঁজছে বিএনপি

বিতর্কে জড়াচ্ছেন সিইসি ‘সুযোগ’ খুঁজছে বিএনপি

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হাতেগোনা তিন মাস বাকি। আগামী জানুয়ারি মাসের প্রথম দিকেই ভোট হবে দেশে। নির্বাচনের আগের এই সময়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে নির্বাচন কমিশনের জন্য। ভোটের আগে নির্বাচন পরিচালনাকারী সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশনকে অত্যন্ত বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে হয়। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে দৃঢ়তার পরিচয় দিতে না পারলে পদে পদে বিড়ম্বনা সৃষ্টি হতে পারে।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের যে কোনো ধরনের ‘অপ্রচলিত’ বক্তব্যকে সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করতে পারে রাজপথের সরকারবিরোধী দল বিএনপি। এই দলটি এখন পর্যন্ত বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্তে অটল রয়েছে। সে কারণে বিএনপি নতুন অজুহাত হিসেবে সিইসির কোনো ‘বিতর্কিত’ বক্তব্যকে পুঁজি করতে পারে। ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া জাতীয় নির্বাচন ২০১৪ সাল এবং ২০১৮ সালের মতো হবে না বলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো মনে করছে।

সংবিধান অনুসারে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনেই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তবে বিএনপির নেতৃতাধীন কিছু দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে এত দিন আন্দোলন করলেও এখন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে। তবে সর্বশেষ তারা নির্বাচনে অংশ নিতে খালেদা জিয়ার মুক্তির শর্তটি জুড়ে দিয়েছে। রাজনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচন কমিশন বিশেষ করে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়ালের ভূমিকার ওপর সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হচ্ছে। সরকারের অভিপ্রায় ও প্রতিশ্রুতি মোতাবেক একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানে সিইসি কী ধরণের ‘ক্যারিসম্যাটিক’ ভূমিকা পালন করবে, সেদিকে তাকিয়ে রয়েছেন দেশের জনগণ, সেই সঙ্গে দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকরা। সিইসির প্রতিটি বক্তব্য ও পদক্ষেপ নির্বাচন পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অংশীজনরা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। তাই সিইসিকে ভেবে-চিন্তে সতর্কতার সঙ্গে কথাবার্তা ও পদক্ষেপ নিতে হবে। বিতর্কের ঊর্ধ্বে থেকে তাকে দায়িত্ব পালন করতে হবে। সিইসির যে কোনো বিতর্কিত বক্তব্যকে ‘পুঁজি’ করে দেশে বিশৃংখলা করতে পারে বিএনপি এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করতে উঠেপড়ে লাগবে দলটি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আইনি বাধ্যবাধকতায় খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান নির্বাচনের বাইরে থাকছেন। তবে জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য ‘তলে তলে’ প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন দলটির নেতাকর্মীরা। এজ্য দলটির নেতাদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব তীব্র আকার নিয়েছে। খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হওয়ায় জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির হয়ে তাদের অংশ নেয়ার সুযোগ নেই। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিগত দুটি জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থী বাছাই করতে গিয়ে তারেক রহমানের সঙ্গে যে বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়েছিলেন, এবারও তিনি সেই পথে হাঁটবে না বলে দলের অভ্যন্তরের সূত্রগুলো জানিয়েছে। ‘দলের অফিস পল্টনে, প্রার্থী বাছাই লন্ডনে, এমনি স্লোগান অতীতে বিএনপির নেতাকর্মীদের দিতে দেখা গেছে। একেকটি আসনে একাধিক প্রার্থী দেয়ায় বিদ্রোহী প্রার্থীদের কারণে বিএনপি ২০১৮ সালের নির্বাচনে ধরাশায়ী হয়েছে। ২০১৪ সালে নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নিয়ে সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। সেই দুর্বল কাঠামো শক্ত করতে গিয়ে ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়েও সফল হয়নি। মাত্র ছয়টি আসনে বিজয়ী হওয়ার পরও শপথ নিতে গড়িমসি করায় দলটির সমালোচনার সম্মুখীন হয়। একপর্যায়ে তারা পদত্যাগ করে রাজপথে সরকারবিরোধী দলের খাতায় নাম লেখায়। বঙ্গবন্ধুকন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়ন কর্মকাণ্ড এবং বিশ্ব নেতৃত্বসুলভ ভাবমূর্তির কারণে মানুষ আগামীতেও আওয়ামী লীগকে বেছে নেবে- এমন সম্ভাবনা আন্তর্জাতিক বিভিন্ন জনমত জরিপে ফুটে উঠেছে। বিএনপি প্রকৃত অর্থে আওয়ামী লীগের এমন অবস্থান মনেপ্রাণে গ্রহণ করতে পারছে না। আর সে কারণে আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিলেও শেষ পর্যন্ত বিএনপি নির্বাচনি লড়াইয়ে থাকবে কি না, তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে।

বিএনপির দলীয় সূত্রে জানা গেছে, সিইসির বিতর্কিত এবং বেফাস বক্তব্য পুঁজি করে বিএনপি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জনের উপায় খুঁজছে।

এরই মধ্যে সিইসি অনেকগুলো প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে সমালোচিত হয়েছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুঃখ প্রকাশ করে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করেছেন। সচেতন মহল মনে করে, সিইসিকে অত্যন্ত পরিমিত কথাবার্তা বলতে হবে। সবশেষ তিনি বিতর্কিত বক্তব্য দিয়েছেন গত ৪ অক্টোবর রাজধানীর নির্বাচন ভবনে ‘অবাধ ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রার্থী ও পোলিং এজেন্টদের ভূমিকা’ শীর্ষক কর্মশালায়। তিনি সেখানে বলেছেন, ‘পোলিং এজেন্টদের তালিকা নির্বাচন কমিশনকে দেওয়ার পর তাদের গ্রেপ্তার করা হলে বুঝব সেটি বিশেষ উদ্দেশে করা হয়েছে। সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা আশা করব গ্রেপ্তার করা যাবে না। আমরা বারবার সরকারকে এটা জানাব, যদি তাদের গ্রেপ্তার করতে হয়, দুই মাস আগেই করেন। আর যদি করতে হয়, তো নির্বাচনের পরে। নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করা উচিত হবে না।’

তবে বাস্তবতা হচ্ছে, নির্বাচনি তফসিল ঘোষণার পর ভোটগ্রহণের আগের রাতে পোলিং এজেন্টদের নামের তালিকা চূড়ান্ত করা হয়। সেই ক্ষেত্রে নির্বাচনের দুই মাসে আগে কিংবা নির্বাচনের পর পোলিং এজেন্ট গ্রেপ্তার করার আহ্বানের মধ্যদিয়ে সিইসি কী বুঝাতে চেয়েছেন, তা বোধগম্য নয়। কোনো লোক যদি পোলিং এজেন্ট হিসেবে নাম লিপিবদ্ধ করার পর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত হন কিংবা রাষ্ট্রদ্রোহী বা নাশকতার কোনো মামলার আসামি হন তাহলে কি তাকে তাৎক্ষণিকভাবে গ্রেপ্তার করা যাবে না। পোলিং এজেন্টদের নাম সাধারণত ভোটগ্রহণের ১ ঘণ্টা আগে নির্বাচন পরিচালনা কর্মকর্তাদের হাতে তুলে দেয়া হয়। পোলিং এজেন্ট হিসেবে যারা দায়িত্ব পালন করেন, তারা তো রাজনৈতিক দলের সুনির্দিষ্ট কোনো নেতাকর্মী নন। এটা তো কোনো স্থায়ী পদ নয়।

পোলিং এজেন্ট প্রসঙ্গে প্রধান নির্বাচন কমিশনার আরো বলেন, ‘আপনারা প্রায় বলেন এজেন্টদের নামতে দেবে না, কারণ পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করে ফেলবে। তাদের শক্তিশালী কর্তৃপক্ষ মারধর করতে পারে, নানা কারণ থাকতে পারে। এই বক্তব্য শুনেছি যে সাধারণত ভোটের দিন সকাল পর্যন্ত পোলিং এজেন্টদের নামটা খুবই গোপন রাখা হয়। যাতে তারা নিরাপদে ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হতে পারেন। এটা আমাদের মাথায় আছে। অনেক সময় দেখি ১০০ জনের জায়গায় ১৫০ জন পোলিং এজেন্টের নাম দেয়। পরে যদি আমরা দেখি ভোটের আগে ১৫০ জন গ্রেপ্তার হয়ে গেছেন। তখন আমাদের একটা নেগেটিভ ইমপ্রেশন নিতে হবে কেন তারা এক মাস আগে গ্রেপ্তার হলেন না, কেন তারা দুই মাস আগে গ্রেপ্তার হলেন না। ভোটের আগের দিন সবাই উধাও হয়ে গেল কেন?’। পোলিং এজেন্ট সম্পর্কে তিনি আরো বলেন, ‘আমরা সৎভাবে ভোট করতে চাচ্ছি। কোনো দলের পক্ষে পক্ষপাতিত্ব করতে আমরা দায়িত্ব গ্রহণ করিনি। সেজন্য একটা তালিকা যদি আগে দেওয়া হয়, এরপর থেকে যদি পটাপট গ্রেপ্তার হতে থাকে। দেখা গেল ১০ জন বাকি আছে ১৪০ জনই গ্রেপ্তার হয়ে গেল। একটা বিষয় মিন করে যে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে বিশেষ একটা উদ্দেশ্যে। তবে আমরা আশা করব, এই ক্ষেত্র কখনোই হবে না। আমরা সরকারকে এটা জানাব, যদি তাদের গ্রেপ্তার করতে হয়, দুই মাস আগেই সবাইকে গ্রেপ্তার করে ফেলেন। আর যদি না করেন, তবে নির্বাচনের পর গ্রেপ্তার করে ফেলেন। নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করা ঠিক হবে না। এতে আমরা কলঙ্কিত হব বলে মনে করি। পোলিং এজেন্ট না থাকলে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। একজন শক্তিশালী প্রার্থী দুর্বল পোলিং এজেন্টদের বের করে দেন।’ পোলিং এজেন্টের সম্পর্কে সিইসি বাস্তবতার নিরীক্ষে বক্তব্য দিলে এই ধরনের সমালোচনার ঊর্ধ্বে উঠতে পারতেন।

একই অনুষ্ঠানে তিনি অন্য প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমাদের দেশে যদি ১ শতাংশ ভোট পড়ে, ৯৯ শতাংশ না পড়ে লিগ্যালি দ্যট ইজ রাইট (আইনগতভাবে এটা সঠিক)। কোশ্চেইন অব লেজিটিমেসি মে অ্যারাইজ। বাট দ্য কোশ্চেইন অব লিগ্যালিটি উইল নট অ্যারাইজ। সো দেয়ার ইজ এ কনফ্লিক্ট বিটুইন লিগ্যালিটি অ্যান্ড লেজিটিমেসি। আমরা লেজিটিমেসি নিয়ে মাথা ঘামাব না। আমরা দেখব ভোটটা অবাধ, নিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ হয়েছে কি না। এক-শতাংশ লোক মাত্র ভোট দিয়েছে। তারপরও যদি দেখি ভোটার যারা এসেছিলেন, তাদেরকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়নি, ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়েছে এবং তারা নির্বিঘ্নে, স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন।’ বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচনে কি কখনো এক-শতাংশ ভোট পড়েছে- এমন কোনো পরিসংখ্যান নির্বাচন কমিশনের কাছে নেই। তা হলে তিনি কেন ১ শতাংশ ভোটে বিষয়টি উপস্থাপন করলেন। প্রধানমন্ত্রী গত শুক্রবারও এক সংবাদ সম্মেলনে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানে তার অঙ্গিকার পুনর্ব্যক্ত করেন। সেখানে সিইসির এমন বক্তব্য সমীচিন হয়নি বলে মনে করছেন নির্বাচন নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠন।

কাজী হাবিবুল আউয়াল আরো বলেছেন, ‘আমাদের নির্বাচনি কালচারের একটা বিষয় হচ্ছে কারচুপি। এটা কোথায় হয়, কীভাবে হয়, এই বিষয়ে আমরা কিন্তু অভিজ্ঞ ব্যক্তি নই। এটা ভোটকেন্দ্রের ভেতরে হতে পারে বাইরে হতে পারে। ভোটকেন্দ্রের ভেতরে একজন ইলেকশন এজেন্ট থাকে, পোলিং এজেন্ট থাকে। প্রিজাইডিং অফিসার যে কোনো পক্ষের হতে পারেন। ভোটকেন্দ্রে পোলিং এজেন্টরা যদি শক্ত অবস্থান করে তাহলে নির্বাচনে কারচুপি করা খুবই ডিফিকাল্ট। কারণ, সেখানে পোলিং এজেন্টেকে সেই শিক্ষা দেওয়া হয়েছে যে ভোটার শুধু সেই ভোট দেবে। একজন পোলিং নিজেও দুষ্ট হতে পারেন- এটা উভয় সংকট। জেনুইন ক্যান্ডিডেট যদি বলিষ্ঠ সাহসী ও উপযুক্ত পোলিং এজেন্ট নিয়োগ দিতে পারেন, তাহলে ওই কারচুপি রোধে সহায়ক হবে।’ নির্বাচনে ভোটগ্রহণের ক্ষেত্রে ভোটকেন্দ্রে কি হয় সেটা তিনি ঢাকায় বসে সিসি ক্যামেরায় পর্যবেক্ষন করলেও বাস্তবতা ভিন্ন। নির্বাচনে কারচুপি হয় এ প্রসঙ্গটি তিনি এনে ভোটার ও প্রাথীদের অনেকটা বিভ্রান্ত করেছেন। বর্তমান সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে কারচুপি হতে পারে এমন আশঙ্কা তিনি কীভাবে করলেন সেট বোধগম্য নয়। তিনি আরো বলেন ‘এজেন্টকে বের করে দেওয়ার একটা সংস্কৃতি ও অভিযোগ- সত্য মিথ্যা আমি জানি না। আমি কাউকে বের করে দিতে দেখিনি, কিন্তু ব্যাপকভাবে পারসেপশন হয়। একটা পারসেপশন হচ্ছে শক্তিশালী প্রার্থী দুর্বল প্রার্থীর এজেন্টদের বের করে দেয়। যদি সত্যি সত্যি বের করে দেয় তবে কেন্দ্রের ভেতরে ভোট প্রভাবিত হবে। কাজেই সেদিকে আমরা চিহ্নিত করতে চেয়েছিলাম’, যোগ করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। পোলিং এজেন্ট বের করে দেয়ার অভিযোগ বিএনপি সব সময় করে আসছে। আর সিইসির বক্তব্যে সেই অভিযোগেরই প্রতিফলন ঘটল। অন্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বর্তমান ইসির ওপর ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে বিতর্কের চাপ পড়েছে। তাই কমিশনের দায়িত্ব বেড়েছে।’

এই দুটি নির্বাচন কীভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে, সেদিকে না গিয়ে ২০২৪ সালের নির্বাচন কীভাবে উৎসবমুখর হতে পারে, সে ব্যাপারে তিনি অভিজ্ঞতা গ্রহণ করলে আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে মানুষের মধ্যে উৎসাহ বাড়ত। সাংবিধানিক একটি পদে বসে তিনি ওই দুটি নির্বাচন নিয়ে ব্যক্তিগত পর্যায়ে মূল্যায়ন করে আগামী নির্বাচনের জন্য সতর্ক হতে পারতেন। তবে বক্তৃতা কিংবা বিবৃতির মাধ্যমে এই ধরনের মন্তব্য করা সমীচীন হয়নি বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। একই অনুষ্ঠানে সিইসি বলেন, ‘আগামী নির্বাচন নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু করতে সব ধরনের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছে ইসি।’

তিনি আরো বলেন, ‘অভিযোগ করা হচ্ছে, এই ইসি নির্বাচন সুষ্ঠু করতে পারবে না। তাই আমরা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করে তার জবাব দেব। তবে মিডিয়া কিংবা সামাজিকভাবে অপপ্রচার না হয়, সেটা কঠোরভাবে দেখব।’

ভোট কেন্দ্রে যা ঘটে, গণমাধ্যম তা তুলে ধরে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও সে ব্যাপারে নিজস্ব মতামত তুলে ধরা হয়। গণমাধ্যমের ব্যাপারে নির্বাচন কী ধরনের ব্যবস্থা নিতে পারে, সেটাও বোধগম্য নয়।

নির্বাচন ভবনের সম্মেলন কক্ষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের সভাপতিত্বে ওই কর্মশালায় বক্তব্য দেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার, নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ও গণমাধ্যম ব্যক্তিসহ বিশিষ্টজনরা। ভার্চুয়াল মাধ্যমে ৬৪ জেলায় নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়ের মাধ্যমের রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিরা এই কর্মশালায় অংশ নেন। ভোটকেন্দ্রে পোলিং এজেন্ট নিশ্চিত করা ও তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনে জোর দেন বক্তারা। একই সঙ্গে নির্বাচন কর্মকর্তাদের নিরপেক্ষ দায়িত্ব পালনেরও তাগিদ দেন তারা।

বর্তমান সিইসি এর আগেও নানা অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্য দিয়ে সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছেন। তার সবচেয়ে আলোচিত উক্তি হচ্ছে ‘তিনি কি ইন্তেকাল করেছেন’ এই মন্তব্যের জন্য সিইসি যথেষ্ট বিতর্কিত হয়েছেন। পরে অবশ্য তিনি তার এই বক্তব্যের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন। তবে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের পক্ষ থেকে তখন বলা হয়েছিল, সিইসির বক্তব্য ‘বিকৃত ও ভুলভাবে’ ব্যাখ্যা করে ‘অসত্য’ সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে। গত ১২ জুন বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোটের দিন একটি কেন্দ্রে ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম ঘুষিতে আহত হওয়ার পর ঢাকায় নির্বাচন কমিশনে এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানান সিইসি। বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়, সিইসি গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে জানতে চান- ‘উনি (ফয়জুল করীম) কি ইন্তেকাল করেছেন?

প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের ‘তলোয়ারের বিপরীতে রাইফেল বা তলোয়ার নিয়ে দাঁড়ানো’ বক্তব্যেও বিতর্কের সৃষ্টি হয়। তার এ বক্তব্যের পর ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) জানায় নির্বাচন কমিশনের মতো একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান প্রধানের এ ধরনের বক্তব্য সহিংসতাকে উসকে দেওয়ার শামিল। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের অংশ হিসেবে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গে সংলাপে সিইসি বলেছিলেন, ‘সব দল সহযোগিতা না করলে আমরা সেখানে ব্যর্থ হয়ে যাব। আপনাদের সমন্বিত প্রয়াস থাকবে, কেউ যদি তলোয়ার নিয়ে দাঁড়ায়, আপনাকে রাইফেল বা আরেকটি তলোয়ার নিয়ে দাঁড়াতে হবে। আপনি যদি দৌড় দেন, তাহলে আমি কী করব?’

প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের দেয়া একটি বক্তব্যে অসন্তোষ প্রকাশ করে রাশিয়া। সিইসি হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর প্রথম সংবাদ সম্মেলনে রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধরত ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার প্রশংসা করেন কাজী হাবিবুল আউয়াল। জেলেনস্কিকে নিয়ে সিইসির বক্তব্যে বিষ্ময় প্রকাশ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনানুষ্ঠানিক বার্তা পাঠান ঢাকাস্থ রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আলেকজান্ডার ভি মান্টিটস্কি। সিইসির বক্তব্যকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের অবস্থান হিসেবে বিবেচনায় নেয় রুশ দূতাবাস। জাতীয় নির্বাচনের আগে সিইসিকে যে কোনো জনসংযোগ কার্যক্রমে তাকে অত্যন্ত বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে হবে। তার এমন কোনো বক্তব্য দেয়া উচিত হবে না, যা আওয়ামী লীগ বিরোধী পক্ষ অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।

বিএনপি আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশ না নিলেও এই দলটির নেতাদের নিয়ে গড়ে উঠা তৃণমূল বিএনপি নির্বাচন আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন পরিপূর্ণভাবে অংশগ্রহণমূলক, অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানের জন্য ইসি প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ, ভোটার তালিকা প্রণনয়, পর্যবেক্ষক বাছাই এবং সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের নিয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে। বিদেশি পর্যটকদেরও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। নির্বাচনকালীন সরকার গঠন প্রক্রিয়া নিয়েও আলোচনা চলছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথে আর কোনো প্রতিবন্ধকতা না থাকায় বিএনপি ভোট বর্জনের অজুহাত খুঁজছে। প্রতিটি রাজনৈতিক দলের আদর্শ হওয়া উচিত নির্বাচনে অংশ নিয়ে নির্বাচিত হয়ে জনগণের সেবা করা। বিএনপি সেই পথে নেই তারা নতুন অজুহাতের পথে হাঁটছে। তারা অজুহাত হিসেবে আগামীতে সিইসির কোনো বিতর্কিত বক্তব্যকে পুঁজি করে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও বিএনপির বিরুদ্ধে নির্বাচন বানচালের যড়যন্ত্র করার অভিযোগ এনেছেন। নির্বাচনি বিধি অনুসারে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে ইসি আত্মপ্রত্যয়ী। তবে বিএনপি যথা সময়ে নির্বাচন যাতে না হয় সেজন্য ‘চোরাগলির’ পথ খুঁজছে। বিএনপি যাতে তাদের সেই কূটকৌশল বাস্তবায়ন করতে না পারে, সেজন্য ইসিকে হতে হবে অধিকতর দায়িত্বশীল, সংবেদনশীল ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। এমন কোনো বক্তব্য দেয়া যাবে না, যাতে করে বিএনপি সেটিকে পুঁজি করে নির্বাচন বর্জনে ডাক দেয়ার সুযোগ পায়। তবে আওয়ামী লীগের নেতারা এক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত কৌশল ভূমিকায় রয়েছেন। তারা প্রতিনিয়ত বিএনপিকে নির্বাচনে অংশ নিয়ে জনমত যাচাই করার আহ্বান জানাচ্ছেন। আওয়ামী লীগের নেতাদের বক্তব্যের মধ্যদিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো বেফাস বক্তব্য দেয়া হয়নি। দৃশ্যত মনে হচ্ছে আওয়ামী লীগ নেতারা বিএনপির প্রতি সংবেদনশীল। সে কারণে তারা বিএনপিকে নির্বাচনে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন। নির্বাচনি বছরে সেটাই হওয়া উচিত রাজনৈতিক সংস্কৃতি।

নির্বাচন,নির্বাচন কমিশন,বিতর্ক
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত