আওয়ামী লীগ বিএনপি ও জাপার সঙ্গে বৈঠক

সুষ্ঠু নির্বাচনের তাগিদ মার্কিন প্রাক নির্বাচন পর্যবেক্ষক প্রতিনিধি দলের

প্রকাশ : ১০ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  আরিফুল ইসলাম

আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বাংলাদেশ সফররত যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-নির্বাচন পর্যবেক্ষক প্রতিনিধি দল গতকাল আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং জাতীয় পার্টির (জাপা) সঙ্গে আলাদা করে বৈঠক করেছে। বৈঠকে প্রতিনিধি দল আগামী সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করার তাগিদ দিয়েছে। তবে বৈঠকে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নিজ নিজ অবস্থান ও দাবিতে অটল রয়েছে।

দুপুরে রাজধানীর বনানীর শেরাটন হোটেলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক নির্বাচন পর্যবেক্ষক প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক করে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। বৈঠক শেষে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, মার্কিন প্রতিনিধি দল সমঝেতা ও সহাবস্থানের সুযোগ আছে কি না, জানতে চেয়েছেন। জবাবে আমরা বলেছি, সে সুযোগ বিএনপি রাখেনি। তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ চায়, মৃত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আনতে চায়, নির্বাচন কমিশন বাতিল এবং সংসদের বিলুপ্তি চায়। এসব করা সম্ভব নয়।

কাদের বলেন, মার্কিন প্রতিনিধি দলকে আমরা আমাদের অবস্থান পরিষ্কার করেছি। গণতন্ত্রের চ্যালেঞ্জ নিয়ে কথা হয়েছে। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে জাতির কাছে প্রধানমন্ত্রীর যে অঙ্গীকার, তা আমরা মার্কিন প্রতিনিধিদের জানিয়েছি। মার্কিন প্রতিনিধি দল কোনো বিষয়ে মধ্যস্থতা করতে আসেনি, সেটি জানিয়েছে উল্লেখ করে ওবায়দুল কাদের বলেন, আমরাও বলেছি, আমরা একটি অবাধ-নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে জাতির কাছে অঙ্গীকারাবদ্ধ। আমরা সেভাবেই কাজ করছি। তাদের কথাবার্তা পজিটিভ মনে হয়েছে। তারা কোনো পক্ষ নিয়ে এসেছে, এমন মনে হয়নি।

মার্কিন প্রতিনিধিদের কাছে বিএনপি যেসব অভিযোগ করেছে তার জবাব দেওয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, আইনের ভুল ব্যাখ্যা দিয়েছে বিএনপি। মার্কিন প্রতিনিধি দল বিএনপির দাবি নিয়ে কোনো কথা বলেনি। তারা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন বাংলাদেশে দেখতে চায়। কোনো সহিংসতার আশঙ্কা আছে কি না জানতে চেয়েছে। আমরাও বলেছি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করতে জনগণের কাছে অঙ্গীকার করেছেন। সে লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।

এর আগে সকালে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক কার্যালয়ে মার্কিন প্রাক-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল বিএনপির সঙ্গে বৈঠক করে। বৈঠক শেষে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। দেশে নির্বাচন পরিস্থিতির কোনো উন্নয়ন হয়নি, বরং আরো অবনতি হয়েছে, এ বিষয়টি আমরা প্রতিনিধি দলকে জানিয়েছি।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও দলের আন্তর্জাতিকবিষয়ক কমিটির প্রধান আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, দেশের মানুষ যেভাবে একটা সুষ্ঠু নির্বাচন চায়, তেমনি সারা বিশ্বও একটা সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। দেশের নির্বাচনের কোনো পরিবেশ নেই, যেটা এরই মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলেছে। তারা বলেছেন নির্বাচনে পর্যবেক্ষক দল পাঠাবে না। এখন মার্কিন এই প্রতিনিধিদল একই বিষয় নিয়ে কাজ করতে এসেছে।

আমির খসরু বলেন, আমরা স্বাভাবিকভাবে বিএনপির পক্ষ থেকে বলেছি শেখ হাসিনার অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। এটার (নির্বাচন পরিস্থিতি) তো কোনো উন্নয়ন হয়নি, বরং আরো অবনতি হয়েছে। গত কয়েকটি নির্বাচনে তারা ভোটাধিকার হরণ করেছে। আবারও তারা ভোটচুরি প্রকল্পে কাজ করে যাচ্ছে। এগুলো থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় একদফা দাবি। এই দাবি প্রতিষ্ঠা করে দেশের জনগণ তার জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করবে।

মার্কিন নির্বাচনি প্রতিনিধিদল কোনো কিছু ব্যাপারে বিশেষভাবে জানতে চেয়েছে কি না, এমন প্রশ্নে আমির খসরু বলেন, সব কিছুর ব্যাপারেই জানতে চেয়েছেন তারা।

এদিকে বিকালে রাজধানীর গুলশানে হোটেল ওয়েস্টিনে জাতীয় পার্টির প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক নির্বাচন পর্যবেক্ষক প্রতিনিধি দল। বৈঠক শেষে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের বলেন, আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে এখনো অনিশ্চয়তা আছে। সব দলের অংশগ্রহণে এ নির্বাচন না হলে দেশে সহিংসতার আশঙ্কা রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি দলের বিষয়ে তিনি বলেন, ওনারা বলছেন, ইনক্লুসিভ নির্বাচন হলে ভালো হয়। শেষ পর্যন্ত সবার অংশগ্রহণে যেন নির্বাচন সুন্দরভাবে আয়োজন করা যায়, এ বিষয়গুলো নিয়ে তারা আমাদের কাছে মতামত জানতে চেয়েছেন। আমরা তাদের বিস্তারিতভাবে বলার চেষ্টা করেছি। এর আগে আমাদের দেশে নির্বাচনে কী ধরনের অসুবিধা হয়েছে, সেগুলো নিয়ে তারা নানা প্রশ্ন করেছেন, আমরা উত্তর দিয়েছি।

জিএম কাদের বলেন, নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা এখনো আছে। বাংলাদেশের অন্যতম দল বিএনপি বলছে নির্বাচন করবে না, আন্দোলন করবে। এখানে সহিংসতা হতে পারে, নানা ধরনের অস্থিরতা তৈরি হতে পারে। এগুলো নিয়ে শঙ্কার বিষয় আছে।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির ভূমিকা কী হবে, সে প্রশ্নের জবাবে জাপা চেয়ারম্যান বলেন, আমরা এখনো অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছি। নির্বাচনে যাব না, এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত এখনো নেওয়া হয়নি। তবে আমরা সামনে অবস্থা দেখে ব্যবস্থা নেব। দলীয় ফোরামে এটা নিয়ে আলাপ-আলোচনা হচ্ছে, সামনে আবারও আলাপ-আলোচনা হবে।

সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচনকালীন সরকারে অংশ নেওয়ার প্রস্তাব এলে জাপার ভূমিকা কী হবে জানতে চাইলে জি এম কাদের বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে যদি গ্রহণযোগ্য কোনো প্রস্তাব আসে, তাহলে সেটা আমরা গ্রহণ করতে পারি। সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের কোনো প্রস্তাব পাইনি।

জাতীয় পার্টি দীর্ঘদিন ধরে সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের দাবি জানাচ্ছে। মার্কিন প্রতিনিধিদলকেও সে কথা জানিয়েছেন জিএম কাদের।

এ ব্যাপারে তিনি বলেন, নির্বাচন পদ্ধতি সংস্কারের লক্ষ্যে এটি একটি ভালো উপায় হতে পারে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্ব পরিস্থিতি যাচাই করতে গত শনিবার ঢাকায় এসেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক নির্বাচনি পর্যবেক্ষক দলের সাত সদস্য। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই) ও ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউট (এনডিআই) যৌথভাবে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ প্রাক-নির্বাচন সমীক্ষা মিশন পরিচালনা করবে। প্রতিনিধিদল এবং তাদের সহায়তাকারীরা ১৩ অক্টোবর পর্যন্ত বাংলাদেশে অবস্থান করবেন।

যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউটের (আইআরআই) প্রতিনিধি দলে রয়েছেন বনি গ্লিক ও জামিল জ্যাফার জো কাও।

ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউটের (এনডিআই) দলে রয়েছেন রিক ইনডারফার্থ, মারিয়া চিন আব্দুল্লাহ ও মনপ্রিত সিং আনন্দ।

সফর শেষে প্রতিনিধিদলটি একটি বিবৃতিও দেবে। নির্বাচন আয়োজন বিষয়ে তাদের যদি কোনো উদ্বেগ থাকে, তা জানাবে এবং বাস্তবসম্মত সুপারিশ থাকলে তা-ও উল্লেখ করবে বলে জানা গেছে।

এর আগে বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচনের পরিবেশসহ নির্বাচনপূর্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনায় গত জুলাইয়ে বাংলাদেশ সফর করে যায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রাক-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল। তাদের সুপারিশের ভিত্তিতে বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যবেক্ষণে পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষক দল না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইইউ। বিষয়টি নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) চিঠি দিয়েও জানিয়েছে সংস্থাটি।