ঢাকা ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ইসরাইল-হামাস সংঘাত

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্ব ফের নতুন সংকটে

* নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১২শ’ * ব্যর্থ নিরাপত্তা পরিষদ
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্ব ফের নতুন সংকটে

ইসরাইল ও হামাসের মধ্যকার সংঘাতে দ্রুত বদলে যেতে পারে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট। করোনা মহামারির অভিঘাত কাটিয়ে উঠতে না উঠতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বে সব কিছু তছনছ করে দিয়েছে। রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যকার লড়াই বন্ধে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ এখনো কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেনি। আশংকার বিষয় হচ্ছে, এই যুদ্ধকে কেন্দ্র করে বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলো দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এসব দেশের মধ্যে বিভক্তি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। রাশিয়ার সঙ্গে অসম লড়াই চালিয়ে যেতে ইউক্রেন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে সামরিক ও অর্থ সহায়তা পাচ্ছে। অপর দিকে রাশিয়া উত্তর কোরিয়ার মতো দেশ থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়া যে অস্ত্রভাণ্ডার প্রস্তুত করে রেখেছে তাতে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে মস্কোর কোনো বেগ পেতে হবে না। তবে ইউক্রেনের অস্ত্রভাণ্ডার দ্রুত কমে আসছে। ফলে কিয়েভ তাদের মিত্র দেশগুলোর কাছে বার বার ধরণা দিচ্ছে। তবে সেটা কতদিন সেটা বিশ্ববাসী ধারণা করতে পারছে না। এদিকে ফিলিস্তিনিগোষ্ঠী হামাস হঠাৎ করে ইসরাইলের অভ্যন্তরে ঢুকে নিবিচারে হত্যাকাণ্ড চালিয়ে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে হামাস এত অস্ত্রশস্ত্র কিংবা সামরিক সহায়তা কোথায় পেল। সেই সঙ্গে ইসরাইলের মতো একটি সামরিক শক্তিধর দেশের বিরুদ্ধে লড়াই করার সাহস কীভাবে অর্জন করল। ইসরাইলের হামলা প্রতিহত করার মতো সামরিক শক্তি ও সামর্থ্য হামাসের আছে বলে দৃশ্যত মনে হয় না। তবে এই যুদ্ধকে কেন্দ্র করে বিশ্ব আবার তালমাটাল অবস্থার মধ্যে পড়তে পারে। যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে সহায়তা করার জন্য যুদ্ধ জাহাজ পাঠিয়েছে। ইসরাইল-ফিলিস্তিনি সংকট কাটিয়ে উঠতে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ বৈঠকে বসলেও সেটি কার্যত ব্যর্থ হয়েছে। এদিকে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে গেছে। এই লড়াই বন্ধ না হলে আগামীতে জ্বালানী তেলে দাম আরো বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ফলে রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধ পরবর্তী বিশ্ব নতুন করে সংকটে পড়ছে।

ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাপন্থি সশস্ত্রগোষ্ঠী হামাসের ভয়াবহ হামলার পর ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাত নতুন রূপ পেতে পারে। একই সঙ্গে তা নতুন ধাপে যেতে পারে বলেও মনে করছেন বিশ্লেষকরা। গত শনিবারের হামাসের হামলার ভয়াবহতা ইসরাইলিদের অবাক করেছে। এটি ছিল একটি নজিরবিহীন কৌশলগত হামলা। এই হামলাকে কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে যে উত্তেজনা বেড়েছে তা অস্বাভাবিক। ইসরাইল-হামাস সংঘাতের অবসান হলেও এর দীর্ঘমেয়াদি ও কৌশলগত প্রভাব থাকবে। এটি সংঘাতের পরিস্থিতির বদলে দিতে পারে। কয়েকশ’ ফিলিস্তিনি যোদ্ধা গাজা উপত্যকার সীমানা অতিক্রম করে ইসরাইলে প্রবেশ করে স্থল, সাগর ও আকাশ পথে। তারা ইসরাইলি শহর ও থানা দখল করে বিস্ময় ছড়ায়। একই সঙ্গে তারা কয়েক হাজার রকেট ছুড়ে ইসরাইলি ভূখণ্ডে। হামাসের পক্ষ থেকে সব ফিলিস্তিনি সংগঠন ও তাদের মিত্রকে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানানো হয়েছে।

গতকালও তাদের মধ্যেকার লড়াই অব্যাহত ছিল। ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ স্বীকার করেছে, বেশ কিছু স্থান ফিলিস্তিনিদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। হামাস বলেছে, তারা সেনাসহ কয়েক ডজন ইসরাইলিকে জিম্মি করেছে। তাদের দাবির সমর্থনে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভিডিও ফুটেজ প্রকাশিত হয়েছে।

ইসরাইলে বিমান হামলা শুরুর পর ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যুদ্ধের ঘোষণা দেন।। ইসরাইলিদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘ইসরাইল একটা দীর্ঘ ও কঠিন যুদ্ধে প্রবেশ করেছে। হামাস যোদ্ধাদের মোকাবিলায় ৩ লাখ রিজার্ভ সৈন্য ডাকা হয়েছে।

শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত হামাসের হামলায় ইসরাইলে নিহতের সংখ্যা ৭০০ ছাড়িয়েছে। আহত হয়েছে ২২০০ এরও বেশি ইসরাইলি। অন্যদিকে, এরই মধ্যে ইসরাইলি হামলায় ফিলিস্তিনে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৪৯৩ জনে দাঁড়িয়েছে, আহত হয়েছে ২ হাজার ৭৫০ জন।

এই পরিস্থিতিকে ১৯৭৩ সালের মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে। প্রায় ৫০ বছর আগে আকস্মিকভাবে ইসরাইলে হামলা চালিয়েছিল মিসর। বর্তমান পরিস্থিতি অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার দুর্বিষহ অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ফলাফল। এদিকে সৌদি আরবের সঙ্গে ইসরাইলের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার সম্ভাবনা ক্রমেই বাড়ছে। ইসরাইল বর্তমান পরিস্থিতিকে নিজেদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব থেকে মনোযোগ ঘুরিয়ে দিতে কাজে লাগাতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। নেতানিয়াহু সরকারের বিতর্কিত বিচারব্যবস্থা সংস্কার নিয়ে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছে। এই সংস্কার ঘিরে পুরো ইসরাইল বিভক্ত হয়ে পড়েছে এবং বড় ধরনের বিক্ষোভ হচ্ছে। কিন্তু এই হামলা নিশ্চিতভাবে ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাতের ধারা পাল্টে দেবে। এদিকে, গাজার ওপর ‘পূর্ণ অবরোধ’ আরোপ করেছে ইসরাইল। দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট জানিয়েছেন, গাজার বিদ্যুৎসংযোগ কেটে দেওয়ার পাশাপাশি সেখানে খাদ্য ও জ্বালানি প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। ২০০৭ সাল থেকেই বায়ু, স্থল ও সমুদ্র তিন দিক থেকেই অবরোধের অধীনে রয়েছে গাজা। হামাসের হামলার পর থেকে গাজার ২০ লাখেরও বেশি বাসিন্দা পানি, বিদ্যুৎ সংকটের পাশাপাশি ওষুধের অভাব ও অস্ত্রোপচারের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

ইসরাইলের সম্ভাব্য পদক্ষেপ হিসেবে প্রথম যে উদ্যোগের কথা বলা হচ্ছে তা হলো, গাজায় উপত্যকায় সেনা মোতায়েন করতে পারে নেতানিয়াহুর সরকার। এর ফলে ২০০৫ সাল থেকে বিদ্যমান উপকূলীয় ছিটমহলটির বর্তমান অবস্থা পাল্টে যেতে পারে। সংঘাতের তীব্রতা বৃদ্ধি পেলে নতুন রণক্ষেত্র তৈরি হতে পারে। বিশেষ করে ইসরাইলের উত্তরাঞ্চলীয় লেবানন সীমান্তে। ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে মোকাবিলার যে প্রক্রিয়া ইসরাইলের রয়েছে তা বদলানো কঠিন হতে পারে। কারণ হামাসের কাছে ইসরাইলি বন্দি রয়েছে।

এ সংঘাতের অবসানে আরব বিশ্ব ও আন্তর্জাতিক উদ্যোগ হয়ত সফল হতে পারে। জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, গাজা উপত্যকায় ইসরাইলের চলমান বিমান হামলার কারণে প্রায় এক লাখ ২৩ হাজার ফিলিস্তিনি নাগরিক বাস্তুচ্যুত হয়েছে। এই হামলা-পাল্টা হামলার ঘটনার পক্ষে বিপক্ষে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংগঠন।

ইসরাইলে হামাসের আকস্মিক বড়ো ধরনের হামলার নিন্দা জানিয়েছে নিরাপত্তা পরিষদের অনেক সদস্য। কিন্তু তারা কোন ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি।

এ কারণে দুঃখ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ফিলিস্তিনি গ্রুপ হামাস গত শনিবার ইসরাইলে হঠাৎ করেই বড়ো ধরনের হামলা চালায়। এতে উভয়পক্ষে অসংখ্য হতাহত এবং হামাস ইসরাইলের অনেককে জিম্মি করে। এ প্রেক্ষিতে নিরাপত্তা পরিষদ গত রোববার জরুরি বৈঠক ডাকে।

নিরাপত্তা পরিষদের রুদ্ধদ্বার বৈঠকের পর মার্কিন সিনিয়র কূটনীতিক রবার্ট উড সাংবাদিকদের বলেছেন, উল্লেখ সংখ্যক দেশ হামাসের হামলার নিন্দা জানিয়েছে। তবে অবশ্যই সকলেই নয়। কূটনীতিকরা বলছেন, নিরাপত্তা পরিষদ বাধ্যবাধকতাপূর্ণ প্রস্তাব ছাড়া কোন ধরনের যৌথ বিবৃতির বিষয়টি বিবেচনা করেনি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দপ্তর পেন্টাগন বলেছে, তারা মার্কিন বিমানবাহী রণতরী ইউএসএস জেরাল্ড আর ফোর্ড এবং এর সঙ্গে থাকা অন্য যুদ্ধজাহাজগুলোকে পূর্ব ভূমধ্যসাগরে ইসরাইল উপকূলে পাঠাচ্ছে। এই অঞ্চলে যুদ্ধবিমানও মোতায়েন করবে দেশটি। গতকাল যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন এ সহায়তার ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, একটি জঙ্গিবিমানবাহী রণতরি ও কয়েকটি যুদ্ধজাহাজ ইসরাইলের কাছাকাছি পাঠানো হচ্ছে। এছাড়া ইসরাইলকে সমরাস্ত্র দেওয়ার ঘোষণাও দিয়েছে পেন্টাগন।

এদিকে হামাসের হামলায় ইসরাইলে বেশ কয়েকজন মার্কিন নাগরিক নিহত হয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। গত রোববার একজন মার্কিন কর্মকর্তা এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন। অবশ্য নিহত মার্কিন নাগরিকদের সঠিক সংখ্যা বা তাদের পরিচয় সম্পর্কে ওই কর্মকর্তা আর কোনও তথ্য দেননি তিনি। সিএনএন অন্তত তিনজন আমেরিকান নাগরিকের নিহত হওয়ার খবর জানিয়েছে।

ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাসের সঙ্গে ইসরাইলের সংঘাতের মধ্যে ইসরাইলি মুদ্রার ব্যাপক দরপতন হয়েছে। মার্কিন ডলারের বিপরীতে শেকেলের দর নেমে গেছে ৮ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে। সংঘাতের মধ্যে শেকেলের প্রায় ৩ শতাংশ দরপতন হয়েছে। মার্কিন মুদ্রার বিপরীতে ইসরাইলি মুদ্রার সবশেষ মান ছিল ৩ দশমিক ৯৫। ইসরাইলের কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে, মুদ্রাবাজারের অস্থিতিশীলতা নিয়ন্ত্রণে ৩ হাজার কোটি ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা বিক্রি করা হবে। এছাড়া, তারল্য বাড়াতে প্রয়োজনে আরও দেড় হাজার কোটি ডলার বাজারে ছাড়া হবে বলে জানিয়েছে তারা। এক বিবৃতিতে ব্যাংকটি বলেছে, এই উদ্যোগ শেকেল বিনিময় হারে অস্থিরতা কমাতে এবং বাজারের প্রয়োজনীয় তারল্য নিশ্চিতে কাজ করবে।

এদিকে, ইসরাইলে হামাসের হামলার ঘটনায় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছে। এর জেরে তেল আবিব স্টক এক্সচেঞ্জে ব্যাপক দরপতন হয়েছে।

গত রোববার দেখা গেছে, ব্লু চিপ কোম্পানির টিএ-৩৫ সূচক কমেছ ৪ দশমিক ৮ শতাংশ। একই সঙ্গে বেঞ্চমার্ক টিএ-১২৫ এর সূচক কমেছে ৫ শতাংশ। অন্যদিকে টিএ-৯০ এর সূচক কমেছে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ। তাছাড়া টিএ-ব্যাংক সূচক এর পতন হয়েছে ৬ দশমিক ৩ শতাংশ। এখানে রয়েছে পাঁচটি বড় ব্যাংক।

সূত্র : বিবিসি, আলজাজিরা ও ইন্টারনেট

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত