ঢাকা ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

গোস্তাখি মাফ করবেন জাহাপনা

মাই লর্ড, আমি জাহান্নামে নয়, বেহেশতে আছি

মাই লর্ড, আমি জাহান্নামে নয়, বেহেশতে আছি

‘কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক, কে বলে তা বহুদূর? মানুষেরি মাঝে স্বর্গ নরক, মানুষেতে সুরাসুর! শেখ ফজলল করিমের ‘স্বর্গ ও নরক’ কবিতার প্রথম দুটি লাইন যথার্থ বলেই আবারও আমার কাছে প্রতীয়মান হলো।

দুনিয়ার জীবনে মানুষ তার অনুভূতিতে স্বর্গ ও নরক অনুভব করে। যিনি তার সৃষ্টিকর্তার নির্দেশিত পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে নিজের অপকর্মের কারণে জীবন-যন্ত্রণায় ছটফট করেন, তার কাছে মহান আল্লাহর এই দুনিয়াটাকে নরক বলে মনে হবে। আর যিনি মহান আল্লাহ নির্দেশিত প্রতিটি কর্ম আল্লাহর নির্দেশিত পন্থায় প্রতিপালন করেন, তিনি এই দুনিয়াকে স্বর্গ বলেই মনে করবেন। সে কারণে শত দুঃখ-কষ্টের মাঝেও আল্লাহর নেক বান্দারা সব সময়ই বলে থাকেন, তিনি আল্লাহ রহমতে ভালো আছেন। কেন না, মহান আল্লাহ তাকে যেভাবে রাখেন, তিনি সেইভাবে থেকে মহান আল্লারই শুকরিয়া আদায় করেন। ক্ষণিকের দুনিয়ায় ভালো-মন্দ থাকার বিষয়টি পুরোটাই নির্ভর করে নিজের ওপর। এটা মানুষের অনুভূতির ব্যাপার। তবে সব সময় মহান সৃষ্টিকর্তাকে রাজি- খুশি করতে ‘ভালো আছি’ এই জবানবন্দি দেয়া দরকার। কেন না, মানুষের জীবনে যা কিছুই ঘটে, সেটা মহান আল্লাহর নির্ধারিত- আমাদের সমাজের আলেম-ওলামাদের বক্তব্যে সেটাই ফুলে উঠে। বাংলাদেশ ‘জাহান্নাম’ হয়ে গেছে- এমনি একটি বক্তব্য উঠে এসেছে দেশের পবিত্র আদালত অঙ্গন থেকে। গত মঙ্গলবার একজন বিচারপতির মন্তব্যে আমার মতো অনেকে বিস্মিত হয়েছেন। সর্বত্র তাকিয়ে দেখেছেন আসলে কি আশপাশে জাহান্নামের আগুনের ফুলকি দেখা যায় কি না? গণমাধ্যমে এসেছে ‘দেশটা তো জাহান্নাম বানিয়ে ফেলেছেন’ একটি মামলায় জামিন শুনানিতে বিচারপতি মো. ইমদাদুল হক আজাদ এমন মন্তব্য করেছেন। পরে তাকে সতর্ক করেছেন দেশের প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। ওই দিন রাতে সতর্ক করার বিষয়টি সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন সূত্র নিশ্চিত করেছে। সুপ্রিমকোর্ট প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, গতকাল মঙ্গলবার বিকালে হাইকোর্ট বিভাগের ওই বিচারপতিকে খাস কামরায় ডেকে সতর্ক করেন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। বিচারপতি ইমদাদুল হক আজাদকে অবসরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত বিচারকাজের সময় মন্তব্য করার ব্যাপারে যত্নশীল হতে বলেছেন প্রধান বিচারপতি। এ সময় আপিল বিভাগের অন্যান্য বিচারপতি সেখানে উপস্থিত ছিলেন। এর আগে দুপুরে বিচারপতি ইমদাদুল হক আজাদের মন্তব্যের বিষয়ে প্রধান বিচারপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করেন অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন।

এরপর বিকালে প্রধান বিচারপতির কার্যালয়ে বিচারপতি মো. ইমদাদুল হক আজাদকে ডাকা হয় বলে জানা যায়। মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের সম্পাদক আদিলুর রহমান খান ও পরিচালক এএসএম নাসির উদ্দিনের করা আপিলের গ্রহণযোগ্যাবিষয়ক শুনানিতে গত মঙ্গলবার সকালে রাষ্ট্রপক্ষের উদ্দেশে বিচারপতি মো. ইমদাদুল হক আজাদের একক হাইকোর্ট বেঞ্চ মন্তব্য করেন, ‘দেশটাকে তো জাহান্নাম বানিয়ে ফেলেছেন।’ ওই মন্তব্যের পর প্রধান বিচারপতির কার্যালয়ে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করেন অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন। ওই মন্তব্য নিয়ে অনলাইন মাধ্যমে প্রকাশিত খবর প্রধান বিচারপতির নজরে আনেন তিনি। ‘দেশটাকে তো জাহান্নাম বানিয়ে ফেলেছেন’ এক শুনানিতে এমন মন্তব্য করা হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি মো. ইমদাদুল হক আজাদের বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল সাংবাদিকদের বলেছেন, গণমাধ্যমের অনলাইন সংস্করণে বিষয়টি দেখে সংশ্লিষ্ট ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলকে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি উত্তরে বলেছেন, মাননীয় আদালত এ কথা বলেছেন। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আমি অত্যন্ত দুঃখিত, ভারাক্রান্ত, মর্মাহত এ কথা শোনার পরে। একজন বিচারক এ ধরনের মন্তব্য করতে পারেন কি না? তিনি সংবিধান সংরক্ষণের জন্য শপথ নেন। তার এ ধরনের অসাংবিধানিক কথা বলা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। আমি মনে করি, তিনি তার শপথ ভঙ্গ করেছেন। আমার সঙ্গে কর্তৃপক্ষের আলাপ হয়েছে। পত্রিকার কপিসহ আমি প্রধান বিচারপতির কাছে দিয়ে এসেছি। জানা গেছে, আগামী রোববার বিচারপতি মো. ইমদাদুল হক আজাদ অবসরে যাবেন। ২০০৪ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের সময় তাকে হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। অবসরের পাঁচ দিন আগে এমন বিস্ফোরক মন্তব্য করে আলোচনায় এলেন তিনি। গণমাধ্যমের এসব খবর পড়ার পর ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়েছে, আমি জাহান্নামে নয়, বেহেশতে আছি। সংশ্লিষ্ট বিচারকের উদ্দেশে বলছি- মাই লড আমাকে ক্ষমা করবেন, আমি আপনার মতো করে এ দেশটাকে ভাবতে পারিনি। আপনি বিচারক আপনার বিচার বিবেচনা আমার চেয়ে ভিন্ন, অন্যন্য এবং ব্যতিক্রম। আপনাদের মতো মানুষই কারণে অকারণে অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।

অথচ আমরা বিএনপির অগ্নিসন্ত্রাস, সাধারণ মানুষ পুড়িয়ে হত্যা করা, গ্রেনেড হামলা, দুর্নীতিকে পাঁচবার চ্যাম্পিয়ন, দলবদ্ধ হয়ে হিন্দু মেয়েদের পাশবিক নির্যাতনের মতো হৃদয় বিদারক ঘটনা দেখে-শুনেও কখনো বলতে পারিনি এদেশ জাহান্নামে রূপ নিয়েছে। দুই কন্যা ছাড়া পরিবারের সদস্য ও নিকট আত্মীয়-স্বজনসহ জাতির পিতাকে হত্যা করার পর খুনিদের উল্লাস কিংবা তাদেরকে বিদেশি মিশনে আকর্ষণীয় চাকরির সুযোগ করে দেয়ার পরও কোনো দিন বলিনি দেশটা জাহান্নাম হয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুষ্টিমেয় লোক ছাড়া এদেশের আপামর মানুষ যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিল। ৩০ লাখ মানুষ প্রাণ দিয়েছেন। আড়াই লাখ মা-বোনোর ইজ্জতের বিনিময়ে আমাদের এই স্বাধীন মাতৃভূমিকে আমরা কখনোই জাহান্নাম বলতে পারিনি। একটি স্বাধীন-সার্বভোম বাংলাদেশের জন্য যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন এবং এখন যারা মানুষের কল্যাণ ও অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য লড়াই করছেন, তারা কখনোই দেশটাকে জাহান্নামের সঙ্গে তুলনা করবেন না।

বিশ্বের উন্নত দেশ হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধ অস্ত্রের গুলিতে দিন-দুপুরে কতজন মারা যায় এবং ১ মিনিটের জন্য বিদ্যুৎ চলে গেলে কতজন নারী তাদের ইজ্জত হারান, সে খবর মার্কিনি নাগরিকরা জানেন। তারপরও তারা স্বীকার করেন না যুক্তরাষ্ট্র জাহান্নামের খাতায় নাম লিখিয়েছে। কেন না প্রতিটি দেশের দেশপ্রেমিক মানুষ তার দেশ এবং মা- মাটিকে ভালোবাসেন। এই ভালোবাসা স্বর্গীয়, কোনোক্রমেই জাহান্নামের বাতায়ন নয়।

সংশ্লিষ্ট বিচারপতিকে ‘মাই লড’ বলে সম্বোধন করে আমি অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে তার প্রতি আর্জি জানাচ্ছি। আপনি দেশকে যারা জাহান্নাম বানালেন, তাদের বিরুদ্ধে স্বপ্রণোদিত কোনো সুয়োমোটো না এনে, কেন একটা স্পর্শকাতর মামলার শুনানিতে অংশ নিলেন। তাহলে জাহান্নামের বাসিন্দা হয়ে বেহেস্তের গীত গাইবেন কীভাবে। আপনার উচিত ছিল, জাহান্নামের এই দেশটাকে বেহেশত বানিয়ে তার পর মামলা পরিচালনা করা। আপনি বিচারক হিসেবে আর কয়েক দিন মাত্র দায়িত্ব পালন করবেন। আপনি অবসরে যাওয়ার আগে একটি সুয়োমোটো দিয়ে যান যে, এই দেশটা জাহান্নামে পরিণত হয়েছে, দেশটাকে বেহেশতে পরিণত করার জন্য কি করা দরকার। আপনি আপনার রিটে কাকে কাকে বিবাদী বানাবেন, সেটা ঠিক করে ইসলামিক ফাউন্ডেশনে পাঠান। সেখানকার আলেম-ওলামারা বসে নির্ধারণ করে দেবেন দেশটাকে বেহেশতে পরিণত করতে কী করতে হবে।

হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনার আমলে বাংলাদেশের ‘জাহান্নাম’ পরিস্থিতি দূর করার জন্য কী কী পদক্ষেপ নিতে হবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, শেখ হাসিনা সেটি নেবেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা সে অনুসারে কাজ করবেন। কেন না, তিনি তার পিতার মতো এই দেশের মানুষের কল্যাণে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। বঙ্গবন্ধু এদেশের স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন আর তার কন্যা শেখ হাসিনা দিচ্ছেন অর্থনৈতিক মুক্তি।

বাংলাদেশ জাহান্নামে পরিণত হয়েছে কি না, সে ব্যাপারে একটা গণভোটের আয়োজন করা যেতে পারে। সেই গণভোটে আপনার মতো তারাই হ্যাঁ সূচক ভোট দেবেন, যারা আওয়ামী লীগের বিগত ১৪ বছরে ভোট বর্জন করে আসছেন। ভাবধারা, চিন্তাচেতনা কিংবা কোনো পক্ষকে খুশি করতে গিয়ে বিচারকের আসনে বসে আপনি দেশটাকে জাহান্নামের সঙ্গে তুলনা করলেও অতি সাধারণ একজন মানুষ হিসেবে আমি ‘বেহেশতে’ আছি এটা রাজপথে মহাসমাবেশ করে বলতে পারব। আমি ঘরে-বাইরে আধুনিক সুযোগ সুবিধা আমি পাচ্ছি। মোবাইল ফোনে ১ টাকা খরচ করে আমি অফিসে বসে আমার সন্তান ও পরিবার-পরিজনের খবর নিচ্ছি। আমার অশীতিপর বৃদ্ধ বাবা মায়ের খবর নিতে পারছি। বিদেশে থাকা আমার সজনদের খোঁজ-খবর নিতে পারছি। প্রচণ্ড গরমে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে অফিসের কাজ করতে পারছি।

ইন্টারনেটে যে কোনো তথ্য যাচাই- বাছাই করে নিতে পারছি। আল্লাহর নেয়ামত সুমিষ্ট ফলমূল ঘরে বসে খেতে পারছি। রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে আধুনিক চিকিৎসা পাচ্ছি। এসবই আমার কাছে মনে হয় বেহেশতের সুখ। ব্যক্তিগত জীবনের যারা সৎ জীবনযাপন করেন, সৎ চিন্তাভাবনা করেন, সমাজে সততাকে প্রতিষ্ঠিত করেন, ভণ্ডামি, নোংরামি কিংবা প্রতারণা না করেন তারাই জীবনে সুখী হয়। তাদের কাছে দুনিয়াটা জাহান্নাম নয় বেহেশত বলে মনে হয়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত