আজ ঢাকা ছাড়ছে মার্কিন প্রাক-নির্বাচনি মিশন

সংসদ নির্বাচনে পাঠাতে পারে পর্যবেক্ষক

প্রকাশ : ১৩ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  আরিফুল ইসলাম

আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠানোর প্রস্তুতি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-নির্বাচনি পর্যবেক্ষক দল ঢাকা সফর সম্পন্ন করেছে। সফরকালে তারা আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিসহ ৭ রাজনৈতিক দল, নির্বাচন কমিশন, সরকারি সংস্থা, বিদেশি কূটনীতিক, সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন সংস্থার সংশ্লিষ্ট লোকজনের সঙ্গে বৈঠক করে। আজ তারা দেশে ফিরে যাচ্ছেন। দেশে গিয়ে নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠাবে কিনা, সে বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবে। সংশ্লিষ্ট সূত্র এসব তথ্য জানিয়েছে।

সূত্র জানায়, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রতিনিধি দলের আগে সফর করে গিয়ে জানিয়েছে, তারা আগামী সংসদ নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠাবে না। ইইউ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সদস্য দেশের মতামত নেয়। আর যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত তারা এককভাবে নেয়। সে ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রে আগামী নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠাবে বলে মনে করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-নির্বাচনি পর্যবেক্ষক দলের কথায় তেমন ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। স্বল্প পরিসরে হলেও তারা পর্যবেক্ষক পাঠাতে পারেন।

গত বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-নির্বাচনি পর্যবেক্ষক দলের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখতে তার সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। পরে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম। তিনি জানান, প্রধানমন্ত্রী পর্যবেক্ষক দলকে বলেছেন, ?আমরা গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছি এবং গণতন্ত্র অর্জন করেছি। গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

পর্যবেক্ষক দলের কাছে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ইতিহাসও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি তাদের জানিয়েছেন, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যার পর সামরিক শাসকরা অস্ত্রের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে বাংলাদেশে রাজনৈতিক দল গঠন করে। ২০০৭-০৮ সালের সামরিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে ফিরতে তাকে বাধা দেয়া হয়। দেশে ফিরলে হত্যারও হুমকি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু প্রাণনাশের হুমকি উপেক্ষা করে তিনি দেশে ফিরেছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি দলের সদস্য বনি গ্লিক বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ বিস্ময়কর অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন করেছে। তারা কূটনীতিকসহ সব স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে কথা বলছেন। তাদের লক্ষ্য হলো সব স্টেকহোল্ডারের কথা শোনা। তারা মার্কিন সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন না, বরং তাদের ব্যক্তিগত জায়গা থেকে এখানে এসেছেন। তবে তারা চান ক্ষমতার হস্তান্তর যেন শান্তিপূর্ণ হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সাবেক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী কার্ল এফ ইন্ডারফুর্থ বলেন, ‘?গণতন্ত্রের কিছু অন্তর্নিহিত সমস্যা রয়েছে। সমস্যাগুলো যুক্তরাষ্ট্রেও রয়েছে।

জানা যায়, এক সপ্তাহের জন্য বাংলাদেশে এসেছিল দলটি। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে পরিচালিত ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই) ও ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক ইনস্টিটিউটের (এনডিআই) প্রতিনিধি দলটি আজ ঢাকা ছাড়ছে। প্রতিনিধি দলের সদস্যরা হলেন, মারিয়া চিন আব্দুল্লা, মারিও মাইত্রি, জেমি ক্যানডেন্স সাক্স স্পাইকারম্যান, আকাশ সিসাসাই কুলোরি, ডেনিয়েল মাইকেল রেইলি, জিওফ্রে পিটার ম্যাকডোনাল্ট।

ঢাকার মার্কিন দূতাবাস জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের জন্য এনডিআইয়ের নীতিমালার ঘোষণা অনুযায়ী, একটি যৌথ প্রাক-নির্বাচন মূল্যায়ন মিশন (পিইএএম) পরিচালনা করতে তারা আসেন।

মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস পরিষ্কার করে বলেছেন যে, তারা বাংলাদেশে অবাধ, নিরপেক্ষ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন দেখতে চায়। সবকিছু মিলে বাংলাদেশের প্রাক-নির্বাচনি পরিবেশ অবাধ, সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের উপযোগী কি না, সেটাই উঠে আসবে তাদের প্রতিবেদনে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক : পর্যবেক্ষক দলটি সবার প্রথমে বৈঠক করেন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে। বৈঠকে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দলকে বলা হয়েছে, বিএনপির পক্ষ থেকে সংবিধানসম্মত কোনো প্রস্তাব দেওয়া হলে ক্ষমতাসীন দলটি সমঝোতা করতে রাজি আছে। সংবিধান লঙ্ঘন করে সমঝোতা নয়।

দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জানান, বিএনপির সঙ্গে সমঝোতার কোনো জায়গা নেই। বৈঠকে মার্কিন প্রতিনিধিদলকে জানানো হয়েছে বিএনপি সমঝোতা-আপসের কোনো পথ খোলা রাখেনি। বিএনপির দাবি সংবিধানসম্মত নয়। সংবিধান লঙ্ঘন করে তো আওয়ামী লীগ সমঝোতা করবে না।

বৈঠকে নির্বাচনিব্যবস্থা, নির্বাচনি পরিবেশ, প্রশাসনের ভূমিকা, বিরোধী নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা-হামলা ও সাজা দেওয়া, রাজনৈতিক সুযোগ, সবার জন্য সমান সুযোগের সম্ভাবনা ও বিএনপির তোলা বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে আওয়ামী লীগের অবস্থান জানতে চায় মার্কিন প্রতিনিধিদল। এসব বিষয়ে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করার পাশাপাশি আইনি যুক্তি তুলে ধরেন আওয়ামী লীগের নেতারা।

এদিকে রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে নির্বাচন পর্যবেক্ষক দলের সঙ্গে বৈঠক হয় দলটির। এ বিষয়ে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী জানিয়েছেন, মার্কিন প্রতিনিধিদলটির আলোচনায় ঘুরেফিরে কথা একটাই এসেছে। তা হলো বাংলাদেশে বিশ্বাসযোগ্য অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে কি না। আর হতে হলে কী কী প্রয়োজন? কীভাবে করা যায়? তিনি বলেন, বিএনপি নিরপেক্ষ সরকারের কথা বলছে। যুক্তরাষ্ট্র বলছে, গ্রহণযোগ্য নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক মানের বিশ্বাসযোগ্য অংশীদারত্বমূলক নির্বাচন হতে হবে। এর সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক বা নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের কোনো ব্যবধান নেই বলে বিএনপি মনে করে।

জাতীয় পার্টির সঙ্গে গুলশানে হোটেল ওয়েস্টিনে বৈঠক করেছে পর্যবেক্ষক দলটি। এ বিষয়ে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের জানান, বৈঠকে প্রতিনিধিদলটি আগামী নির্বাচন কীভাবে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক করা যায়, আলোচনায় সে বিষয়ের জোর দিয়েছে। এ ছাড়া এর আগে এখানে নির্বাচনে কী ধরনের অসুবিধা হয়েছে, সেগুলো নিয়ে তারা নানা প্রশ্ন করেছে।

ঢাকার একটি হোটেলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-নির্বাচন মূল্যায়ন মিশনের সঙ্গে আমার বাংলাদেশ পার্টি এবি পার্টিসহ আরো ৪টি দলের সঙ্গে বৈঠক করে।

নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠক

আগামী সংসদ নির্বাচন বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন ঢাকা সফররত যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দলের প্রতিনিধিরা। এতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বে পুরো কমিশন উপস্থিত ছিলেন। সিইসি বলেন, বৈঠকে আমেরিকার প্রি-অ্যাসেসমেন্ট টিম আমাদের রোল, দায়িত্ব, কর্মকাণ্ড, সরকারের সঙ্গে ইসির কো-অর্ডিনেশন ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। আমরা তাদের আমাদের পক্ষ থেকে ইসির রোল, সরকারের রোল, সরকারের সঙ্গে ইসির কো-অর্ডিনেশন সবকিছু সম্পর্কে জানিয়েছি।

সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক : বৈঠকের পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, মার্কিন দল তার কাছে কিছু বিষয় জানতে চেয়েছে যে- সরকার ঠিকমতো নির্বাচন করতে পারবে কি না ও সেই সক্ষমতা আছে কি না। আর বিরোধী দল নির্বাচনে আসলে ঠিকমতো প্রচারের সুযোগ পাবে কি না।

তারা জানতে চেয়েছে- প্রার্থীরা নিরাপত্তাহীন বোধ করলে কিংবা কোনো দল যদি মনে করে নির্বাচন বাধাগ্রস্ত হবে, তখন সরকার কি করবে? জবাবে আমরা বলেছি, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংসতা আগে হতো, এখন আর এগুলো হয় না। আর আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো সুন্দর নির্বাচনের জন্য তৈরি হয়ে আছে। তফসিল ঘোষণার পরে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী চলবে তারা, সচিবালয়ে ব্রিফিংয়ে বলছিলেন তিনি।

এদিকে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, বর্তমান সরকার অবাধ সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি মার্কিন প্রতিনিধিদলের সঙ্গে।

তিনি বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সঙ্গে সাইবার নিরাপত্তা আইনের কি পার্থক্য আছে তা জানতে চেয়েছে প্রতিনিধি দল। নির্বাচন অবাধ নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ হবে, এজন্য যা যা করার দরকার সরকার সেটা করছে বলে প্রতিনিধি দলকে আশ্বস্ত করার কথাও জানিয়েছেন তিনি। এর বাইরে সিভিল সোসাইটি, নারী প্রতিনিধি, গণমাধ্যম প্রতিনিধিসহ অন্যদের সঙ্গে আলোচনা করেন মার্কিন প্রাক-নির্বাচনি পর্যবেক্ষক মিশন।