ঢাকা ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

নীরব ঘাতক শব্দদূষণে কাটছে দুর্বিষহ জীবন

* আগামীকাল ১ মিনিট ‘শব্দহীন’ থাকবে রাজধানীর ১১টি স্থান * শব্দদূষণে শাস্তির আইন থাকলেও প্রয়োগ নেই
নীরব ঘাতক শব্দদূষণে কাটছে দুর্বিষহ জীবন

সড়কপথে দিনে দিনে বাড়ছে গাড়ি, সেই সঙ্গে বাড়ছে শব্দদূষণ। বিশেষ করে ব্যস্ততম নগরী রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও খুলনায় বাস, প্রাইভেটকার এবং মোটরসাইকেল চালকরা যেন হর্ন বাজানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। গাড়ি চালাতে গিয়ে অকারণেও হর্ন বাজান হচ্ছে। শুধু গাড়ির হর্ন নয়- এইসব শহরে নির্মাণকাজ, গ্রিল ও টাইলস কাটা, মেশিনে ইটভাঙা ও নির্বিচারে মাইক বাজানো হচ্ছে।

বাণিজ্যিক এলাকা থেকে শুরু করে আবাসিক এলাকায় সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত চলে শব্দের তাণ্ডব। দিনকে দিন ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরে শব্দদূষণ যেন আরো তীব্র ও কষ্টদায়ক হয়ে উঠছে। এসব কারণে শব্দদূষণে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় শহরগুলোর তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে রাজধানী ঢাকা। শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে ২০০৬ সালে করা হয় ‘শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা’। এতে রাজধানীতে শব্দের গ্রহণযোগ্য সর্বোচ্চ মাত্রা সময় ও এলাকাভেদে আলাদা করে দেওয়া আছে। নীরব এলাকায় রাতে সর্বোচ্চ মাত্রা ৪০ ডেসিবল আর দিনে ৫০। আবাসিক এলাকায় রাতে ৪৫ ও দিনে সর্বোচ্চ ৫৫ ডেসিবল শব্দ করা যাবে।

উচ্চমাত্রার শব্দের কারণে মানুষের শ্রবণশক্তি হ্রাস, হৃদরোগ, মেজাজ খিটখিটে হওয়া, আলসারে আক্রান্ত ও বিরক্তি বোধ বেড়ে যাচ্ছে। শব্দদূষণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশু ও বয়স্ক নাগরিক। এমনকি মার্তগর্ভে থাকা সন্তানও শব্দদূষণে ক্ষতির শিকার হচ্ছে। অর্থাৎ তাদের শ্রবণশক্তি খুব দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের নাক, কান ও গলা চিকিৎসকরা জানান, উচ্চ মাত্রায় শব্দদূষণ অব্যাহত থাকলে আগামী ৫ বছরে ঢাকা শহরে শ্রবণ সমস্যায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা আরো বাড়তে থাকবে। শব্দের সর্বোচ্চ গ্রহণযোগ্য মাত্রা যেখানে ৬০ ডেসিবেল, সেখানে ঢাকা শহরের বেশিরভাগ এলাকায় এখন শব্দের সার্বক্ষণিক গড় মাত্রা ১০০ ডেসিবেল। এছাড়া মিশ্র এলাকায় যথাক্রমে ৫০ ও ৬০ ডেসিবল, বাণিজ্যিক এলাকায় ৬০ ও ৭০ ডেসিবল শব্দ গ্রহণযোগ্য। শিল্প এলাকায় তা রাতে ৭০ এবং দিনে সর্বোচ্চ ৭৫ ডেসিবল শব্দ করা যাবে।

শব্দদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মানুষকে মুক্ত রাখতে সচেতনতা গড়ার চেষ্টার অংশ হিসেবে আগামীকাল রাজধানীতে ‘১ মিনিট শব্দহীন’ কর্মসূচি পালন করবে সরকার।

গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে পরিবেশ সচিব ড. ফারহিনা আহমেদ বলেন, এই রুমের ভেতরে যে ডেসিবলে শব্দ বাইরে থেকে আসছে এটি; কিন্তু মানমাত্রার উপরেই। ফলে আমরা যদি আইন প্রয়োগ করতে যাই, যদি আমরা দূষণমুক্ত মান নিশ্চিত করতে যাই, দেখবেন সারা দেশ কারগারে পরিণত হয়েছে। এটা তো করা যাবে না। সরকার এনফোর্স করবে, নাগরিকরা মেনে চলবে, স্টেকহোল্ডাররা মেনে চলবে। দুই পক্ষ যখন একটা জায়গায় আসবে তখনই কিন্তু কপ্লায়েন্ট হবে।

বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫-এর ক্ষমতা বলে শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০০৬ প্রণয়ন করা হয়। বিধিমালার আওতায় নীরব, আবাসিক, মিশ্র, বাণিজ্যিক ও শিল্প এলাকা চিহ্নিত করে শব্দের মানমাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। আইন অমান্য করলে প্রথমবার অপরাধের জন্য ১ মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড এবং পরবর্তী অপরাধের জন্য ৬ মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার বিধান রয়েছে; কিন্তু বাস্তবে এই আইনের তেমন প্রয়োগ দেখা যায় না।

বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্সেসের নন কমিউনিকেবল ডিজিজ বিভাগের চিকিৎসক সাইকা নিজাম ২০২০ সালে শব্দদূষণ নিয়ে রাজধানীতে একটি গবেষণা করেন। তিনি বলেন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে হর্নের শব্দ পেয়েছেন গড়ে ৯৫ ডেসিবল আর দক্ষিণ সিটিতে ৯৬। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের একটি বিশেষ অভিযানে পাঁচটি গাড়ি পরীক্ষা করে একটিতে শব্দের মাত্রা সর্বোচ্চ ১১০ ডেসিবল। অন্য চারটি যথাক্রমে ১০১, ৯৯, ৯৮ ও ৯৭ ডেসিবল ছিল।

উচ্চ শব্দের হর্ন বাজারে ছয়লাব : হাড্রলিক হর্ন আমদানি নিষিদ্ধ হলেও দেশের বাজারে ছয়লাব। এতে ক্রেতাদের পছন্দের তালিকায় থাকছে উচ্চ শব্দের হর্ন। তবে পরিবেশ সচিব বলেছেন, আমরা হাইড্রলিক হর্ন জব্দ করছি। আমদানি নিষিদ্ধ এসব হর্ন কীভাবে আসে সে বিষয়ে এনবিআরের সঙ্গে কাজ করছি। স্থানীয়ভাবে উৎপাদন হচ্ছে, তবে সেসব উৎস বন্ধে কাজ করছি। ব্যর্থ বলব না, প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। গাড়ি চলাচল ও অযথা হর্ন বাজানোয় শব্দদূষণ হয়। নির্মাণ খাত, কলকারখানা থেকেও শব্দদূষণ হচ্ছে। পরিবহন খাত থেকে সব থেকে বেশি শব্দদূষণ হওয়ায় বিআরটিএ এবং বিআরটিসির সঙ্গে পরিবেশ মন্ত্রণালয় কাজ করছে।

১ মিনিট শব্দহীন : শব্দদূষণ বন্ধ করি, নীরব মিনিট পালন করি’ স্লোগানে এই কর্মসূচি পালন করা হবে ঢাকার ১১টি স্থানে। এলাকাগুলো হলো : ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনের সামনের রাস্তা, শাহবাগ মোড়, উত্তরা, বিজয় সরণি মোড়, মিরপুর-১০ নম্বর গোলচত্বর, গাবতলী, মগবাজার, মহাখালী, গুলশান-১, কমলাপুর, বৌদ্ধমন্দির ও যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা।

কর্মসূচি চলাকালে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের অধীন দপ্তর ও সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারী, স্কুল-কলেজের স্কাউট সদস্য, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সরকারি দপ্তর ও সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারী, ট্রাফিক পুলিশ ও পরিবহন মালিক সমিতির সদস্যরা ব্যানার, ফেস্টুনসহ উপস্থিত থেকে মানববন্ধন করবেন। এরপর গাড়ি চালকদের মধ্যে শব্দ সচেতনতামূলক লিফলেট, স্টিকার বিতরণ করা হবে। তাদের হর্ন না বাজানোর অনুরোধ করা হবে।

এদিকে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক আলমগীর কবির বলেছেন, শব্দের মাত্রা বজায় রাখতে আবাসিক এলাকা থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিল্প-কারখানা সরাতে হবে। ভূমির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়াও বিআরটিএ থেকে গাড়ি রেজিস্ট্রেশন করার সময় মালিক ও ড্রাইভারদের নিয়ে হর্নের ভয়াবহতা সম্পর্কে সেমিনাারের আয়োজন করার মাধ্যমে তাদের সচেতন করতে হবে। অতিরিক্ত শব্দদূষণের ফলে আমরা ধীরে ধীরে বধির জাতিতে পরিণত হচ্ছি।

তিনি আরো বলেন, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ নেপাল যদি হর্নমুক্ত সিটি ঘোষণা করতে পারে, তবে আমরা কেন পারি না? গাড়িতে এমন প্রযুক্তি ব্যবহার করা উচিত, যাতে সীমার বাইরে শব্দ করলে সেখানে একটা সংকেত দেয়। যেসব গাড়ি শব্দদূষণের জন্য দায়ী সঙ্গে সঙ্গে সেসব গাড়ির চালকদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত